Sunday, September 16, 2018

ইমাম মালিক (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী



ইমাম মালিক (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম, উপনাম ও বংশ :
নাম মালিক, উপনাম আবূ আব্দুল্লাহ। বংশনামা : মালিক বিন আনাস বিন আবূ আমির বিন আমর বিন হারিস আল-আসবাহী। তিনি আরবের প্রসিদ্ধ গোত্র কাহ্ত্বান এর উপগোত্র আসবাহ্ অন্তর্ভূক্ত, এজন্য ‘আল-আসবাহী’ বলে পরিচিত।[1]
জন্ম ও প্রতিপালন :
ইমাম মালিক (রহ.) পবিত্র মদীনা নগরীতে এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষানুরাগী মুসলিম পরিবারে জন্মলাভ করেন। জন্মের সন নিয়ে কিছু মতামত থাকায় ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন : বিশুদ্ধ মতে ইমাম মালিক (রহ.)-এর জন্ম সন হল ৯৩ হিজরী, যে সনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খাদেম আনাস বিন মালিক (রা) মৃত্যুবরণ করেনই।[2]
তিনি পিতা আনাস বিন মালিকের কাছে মদীনায় প্রতিপালিত হন। তাঁর পিতা তাবে-তাবেঈ ও হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন, যার কাছ থেকে ইমাম যুহুরীসহ অনেকেই হাদীস বর্ণনা করেন। খুদ ইমাম মালিকও পিতার নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেন।[3] তাঁর দাদা আবূ আনাস মালিক (রহ.) প্রসিদ্ধ তাবেঈ ছিলেন, যিনি ওমার, আয়িশা ও আবু হুরায়রা (রা.) হতে হাদীস বর্ণনা করেন।[4] তাঁর পিতামহ আমির বিন আমর (রা) প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন।[5] এ সম্ভ্রান্ত দ্বীনী পরিবেশে জ্ঞানপিপাসা নিয়েই তিনি প্রতিপালিত হন।
শিক্ষা জীবন :
রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের পর হতে আজও পর্যন্ত দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র হলো মদীনা। সে মদীনাতে জন্মলাভ করার অর্থ হল দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্রেই জন্ম লাভ করা। বিশেষ করে বংশীয়ভাবে তাঁদের পরিবার ছিল দ্বীনী জ্ঞানচর্চায় অগ্রগামী। এজন্য তিনি শৈশবকাল হতেই শিক্ষা শুরু করেন। বিশেষ করে তাঁর মাতা তাকে শিক্ষার প্রেরণা যোগান। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন : আমি একদিন মাকে বললাম, ‘‘আমি পড়ালিখা করতে যাব! মা বললেন : আস শিক্ষার লেবাস পড়, অতঃপর আমাকে ভাল পোষাক পড়ালেন, মাথায় টুঁপি দিলেন এবং তার উপর পাগড়ী পড়িয়ে দিলেন, এরপর বললেন : এখন পড়া লিখার জন্য যাও।
তিনি বলেন : মা আমাকে ভালভাবে কাপড় পড়িয়ে দিয়ে বলতেন : যাও মদীনার প্রসিদ্ধ আলিম রাবিয়াহর কাছে এবং তাঁর জ্ঞান শিক্ষার আগে তাঁর আদব আখ্লাক শিক্ষা কর।[6] এভাবে তিনি মদীনার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ফকীহদের নিকট হতে শিক্ষালাভ করেন।
ইমাম মালিকের (রহ.) শিক্ষক বৃন্দ : ইমাম মালিক (রহ.) অসংখ্য বিদ্যানের নিকট শিক্ষালাভ করেন। ইমাম যুরকানী (রহ.) বলেন : ‘‘ইমাম মালিক (রহ.) নয়শতর অধিক শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ইমাম মালিক স্বীয় গ্রন্থ মুয়াত্ত্বায় যে সব শিক্ষক হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদেরই সংখ্যা হল ১৩৫ জন, যাদের নাম ইমাম যাহাবী ‘‘সিয়ার’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।[7] তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নিম্নরূপ :
১. ইমাম রাবীয়া বিন আবূ আবদুর রহমান (রহ.)।
২. ইমাম মুহাম্মদ বিন মুসলিম আয্যুহুরী (রহ.)।
৩. ইমাম নাফি মাওলা ইবনু ওমার (রহ.)।
৪. ইব্রাহীম বিন উক্বাহ (রহ.)।
৫. ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ বিন সা’দ (রহ.)।
৬. হুমাইদ বিন কায়স আল ‘আরজ (রহ.)।
৭. আইয়ূব বিন আবী তামীমাহ আসসাখতিয়ানী (রহ.) ইত্যাদি।[8]
ইমাম মালিক (রহ.)-এর ছাত্র বৃন্দ : ইমাম মালিক (রহ.) হলেন ইমামু দারিল হিজরাহ, অর্থাৎ মদীনার ইমাম। অতএব মদীনার ইমামের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য কে না চায়। তাই তাঁর ছাত্র অগণিত। ইমাম যাহাবী উল্লেখযোগ্য ১৬৬ জনের নাম বর্ণনা করেছেন। ইমাম খাতীব বাগদাদী ৯৯৩ জন উল্লেখ করেন।[9] ইমামের প্রসিদ্ধ কয়েকজন ছাত্রের নাম নিম্নে প্রদত্ত্ব হল :
১. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস আশ্শাফেঈ (রহ.)।
২. ইমাম সুফাইয়ান বিন উয়ায়নাহ (রহ.)।
৩. ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রহ.)।
৪. ইমাম আবু দাউদ আত্তায়ালিসী (রহ.)।
৫. হাম্মাদ বিন যায়দ (রহ.)।
৬. ইসমাঈল বিন জাফর (রহ.)।
৭. ইবনু আবী আযযিনাদ (রহ.) ইত্যাদি।[10]
জ্ঞান গবেষণায় ইমাম মালিক (রহ.) :
ইমাম মালিক (রহ.) জন্মগতভাবেই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মেধা শক্তি ছিল খুবই প্রখর। আবূ কুদামাহ বলেন : ‘‘ইমাম মালিক স্বীয় যুগে সর্বাধিক মেধা শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।[11]
হুসাইন বিন উরওয়াহ হতে বর্ণিত : তিনি বলেন : ‘‘ইমাম মালিক বলেন : একদা ইমাম যুহুরী (রহ.) আমাদের মাঝে আসলেন, আমাদের সাথে ছিলেন রাবীয়াহ। তখন ইমাম যুহুরী (রহ.) আমাদেরকে চল্লিশের কিছু অধিক হাদীস শুনালেন। অতঃপর পরেরদিন আমরা ইমাম যুহুরীর কাছে আসলাম, তিনি বললেন : কিতাবে দেখ আমরা কি পরিমান হাদীস পড়েছি, আরো বললেন, গতকাল আমরা যে হাদীস বর্ণনা করেছি, তোমরা কি কিছু পড়েছ? তখন রাবীয়া বললেন : হ্যাঁ, আমাদের মাঝে এমনও ব্যক্তি আছেন যিনি গতকাল আপনার বর্ণনাকৃত সব হাদীস মুখস্ত শুনাতে পারবেন। ইমাম যুহুরী বললেন : কে তিনি? রাবিয়া বললেন : তিনি ইবনু আবী আমীর অর্থাৎ ইমাম মালিক। ইমাম যুহুরী বললেন : হাদীস শুনাও, ইমাম মালিক বলেন : আমি তখন গতকালের চল্লিশটি হাদীস মুখস্ত শুনালাম। ইমাম যুহুরী বলেন : আমার ধারণা ছিল না যে, আমি ছাড়া এ হাদীসগুলো এভাবে আর দ্বিতীয় কেউ মুখস্ত করেছে।
অতএব ইমাম মালিক (রহ.)-এর অসাধারণ পান্ডিত্বের সাথে গভীরভাবে জ্ঞান গবেষণা ও সংরক্ষণ সম্পর্কে আর বেশী কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না।
হাদীস শাস্ত্রে ইমাম মালিক (রহ.) : হাদীস শাস্ত্রে ইমাম মালিক (রহ.) এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, হাদীস সংকলনে অগ্রনায়ক। যদিও তাঁর পূর্বে কেউ কেউ হাদীস সংকলন করেন, যেমন ইমাম যুহুরী, কিন্তু ইমাম মালিক (রহ.)-এর হাদীসের সাধনা, সংগ্রহ ও সংকলন ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এজন্যই তাঁর সংকলিত গ্রন্থকে বলা হয়, ‘‘আল্লাহর কিতাব কুরআনের পর সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ ইমাম মালিকের মুয়াত্ত্বা গ্রন্থ।’’[12]
তিনি হাদীস শিক্ষায় পারিবারিকভাবে উৎসাহী হলেও তাঁর অসাধ্য সাধন এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অনেক অগ্রসর হয়েছেন। শয়নে স্বপনে সব সময় একই চিন্তা, কিভাবে তিনি হাদীস শিক্ষালাভ করবেন। মানুষ যখন অবসরে তখন তিনি হাদীসের সন্ধানে। ইমাম মালিক একদা ঈদের সালাতে ইমাম যুহুরীকে পেয়ে মনে করলেন, আজ মানুষ ঈদের আনন্দে ব্যস্ত, হয়ত ইমাম যুহুরীর কাছে একাকী হাদীস শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যাবে। ঈদের ময়দান হতে চললেন ইমাম যুহুরীর বাসায়, দরজার সামনে বসলেন, ইমাম ভিতর থেকে লোক পাঠালেন গেটে দেখার জন্য, ইমামকে জানানো হল যে, গেটে আপনার ছাত্র মালিক, ইমাম বললেন : ভিতরে আসতে বল। ইমাম মালিক বলেন, আমি ©র্ভতরে গেলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মনে হয় তুমি সালাতের পর বাড়ীতে যাওনি? আমি বললাম : হ্যাঁ যাইনি, জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু খেয়েছ কি? আমি বললাম : না, তিনি বললেন : খাও, আমি বললাম : খাওয়ার চাহিদা নেই। তিনি বললেন, তাহলে তুমি কি চাও? আমি বললাম : আমাকে হাদীস শিখান, অতঃপর তিনি আমাকে সতেরটি হাদীস শিখালেন।[13]
ইমাম মালিক (রহ.) বেশীভাগ সময় একাকী থাকা পছন্দ করতেন, তাঁর বোন পিতার কাছে অভিযোগ করলেন, আমাদের ভাই মানুষের সাথে চলাফিরা করে না। পিতা জবাব দিলেন : মা তোমার ভাই রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীস মুখস্ত করায় ব্যস্ত, তাই একাকী থাকা পছন্দ করে।[14]
হাদীস সংগ্রহে কঠোর সতর্কতা:
ইমাম মালিক (রহ.) হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে সদা ব্যস্ত হলেও যেখানেই বা যার কাছেই হাদীস পেলে তিনি তা গ্রহণ করতেন না, যতক্ষণ না হাদীস বর্ণনাকারীর ঈমান-আক্বীদাহ ও সততা সম্পর্কে অবগত হতে পারতেন। বিশ্বস্ত প্রমাণিত হলে হাদীস গ্রহন করতেন। ইমাম সুফাইয়ান ইবনু উইয়ায়না (রহ.) বলেন : ‘‘আল্লাহ তা’আলা ইমাম মালিককে রহম করুন, তিনি হাদীসের বর্ণনাকারীর ব্যাপারে খুব কঠিনভাবে যাচাই বাছাই করতেন (সহজেই কারো হাদীস গ্রহণ করতেন না)।’’ আলী বিন মাদীনী (রহ.) বলেন : ‘‘হাদীস গ্রহণে কঠোর নীতি ও সতর্কতায় ইমাম মালিকের ন্যায় আর কেউ আছে বলে আমি জানিনা।’’[15] ইমাম মালিক বিদ’আতীদের থেকে হাদীস গ্রহণ করতেন না।[16] এ সতর্কতা শুধু তিনি নিজেই অবলম্বন করেন নি, বরং তিনি অন্যদেরকেও গুরুত্বারোপের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন :
‘‘হাদীস হল দ্বীনের অন্যতম বিষয়, অতএব ভালভাবে লক্ষ কর তোমরা কার নিকট হতে দ্বীন গ্রহণ করছ। আমি সত্তর জন এমন ব্যক্তি পেয়েছি যারা রাসূল (ছাঃ)-এর নামে হাদীস বর্ণনা করে, কিন্তু আমি তাদের কিছুই গ্রহণ করিনি। যদিও তারা অর্থ সম্পদে আমানতদার হয়, কিন্তু এ বিষয়ে তাদেরকে আমি যোগ্য মনে করিনি। অথচ আমাদের মাঝে ইমাম যুহুরীর আগমন হলে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে আমরা তাঁর দরবারে ভীর জমাতাম’’।[17]
সুতরাং ইমামু দারিল হিজরা বা মাদীনার ইমাম মালিক (রহ.) রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে যেমন জীবন উৎসর্গ করেছেন, তেমনি হাদীস সংরক্ষণে খুব কঠোর ভূমিকা রেখেছেন।
হাদীস পালনে ইমাম মালিক (রহ.):
হাদীস শুধু কিতাবের পাতায় নয়, বরং তা বাস্তবে পালনের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলেন ইমাম মালিক (রহ.)। আব্দুল্লাহ বিন বুকাইর বলেনঃ আমি ইমাম মালিককে বলতে শুনেছি তিনি বলেন : ‘‘আমি কোন আলিমের কাছে যখন বসেছি। অতঃপর তার কাছ হতে বাড়ীতে আসলে তার কাছে শুনা সব হাদীস মুখস্ত করে ফেলি এবং ওই হাদীসগুলির মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত বা আমল না করা পর্যন্ত ওই আলিমের বৈঠকে ফিরে যাইনি।’’[18]
হাদীস শিক্ষাদান ও ফতোয়া প্রদান:
ইমাম মালিক (রহ.) শুধু হাদীস শিক্ষা ও আমল করেই ক্ষান্ত হননি, বরং শিক্ষার পাশাপাশি মানুষকে শিক্ষা দান ও ফতোয়া প্রদানে বিড়াট অবদান রেখেছেন। ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন : ইমাম মালিক (রহ.) ২১ বছর বয়সে হাদীসের পাঠদান ও ফতোয়া প্রদানে পূর্ণ যোগ্যতা লাভ করেন।[19] ইমাম মালিক (রহ.) বলেন : ইচ্ছা করলেই শুধু হাদীস শিক্ষা ও ফতোয়া প্রদানের জন্য মসজিদে বসা যায় না, রবং এ ক্ষেত্রে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিতে হবে, তারা যদি উপযুক্ত মনে করেন তাহলে এ কাজের জন্য নিয়োজিত হতে পারে। সত্তর জন বিজ্ঞ পন্ডিত- শাইখের আমার ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদানের পর আমি এ কাজে নিয়োজিত হই।[20] মুস্‘আব বিন আব্দুল্লাহ বলেন : ‘‘ইমাম মালিককে কোন হাদীস জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অযূ করে ভাল পোষাক পড়ে সুন্দরভাবে প্রস্ত্ততি নিতেন, তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাবে বলেন : এ হল রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীসের জন্য সম্মান প্রদর্শন।’’[21] সারা মুসলিম বিশ্ব হতে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র মদীনায় জ্ঞান পিপাসুরা শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান এবং ইমাম মালিকের মত মুহাদ্দিসের নিকট হতে হাদীস শিক্ষালাভ করে ধন্য হতেন।
ইমাম মালিক (রহ.) ফতোয়া প্রদানেও যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করতেন। জটিল বিষয়গুলো দীর্ঘ গবেষণার পর ফতোয়া প্রদান করতেন। ইবনু আব্দুল হাকীম বলেন : ‘‘ইমাম মালিককে (রহ.) কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি প্রশ্নকারীকে বলতেন যাও আমি ওই বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করি।’’ আব্দুর রহমান বিন মাহদী বলেন : ইমাম মালিক বলেন, ‘‘কখনও এমন মাস‘আলা এসেছে যে, চিন্তা-গবেষণা করতে আমার গোটারাত কেটেগেছে।’’[22] ইমাম মালিক (রহ.) কোন বিষয় উত্তর না দেয়া ভাল মনে করলে ‘‘জানি না’’ বলতেও কোন দ্বিধাবোধ করতেন না।[23] কারণ তিনি মনে করতেন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া মানে জান্নাত ও জাহান্নামের সম্মুখীন হওয়া। প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যেন আখিরাতে জবাব দিহিতার সম্মুখীন হতে না হয়।[24]
সঠিক আক্বীদাহ বিশ্বাসে ইমাম মালিক (রহ.) : আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বীদাহ-বিশ্বাসের অন্যতম ইমাম হলেন ইমাম মালিক (রহ.)। বিশেষ করে আল্লাহ তা’আলার সিফাত গুণাবলীর প্রতি ঈমানের যে ক্বায়দা বা নীতি ইমাম মালিক (রহ.) মুতাযিলাদের প্রতিবাদে বর্ণনা করেন, সেটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি। যেমন ইমাম ইবনু আবিল ইয্ আল হানাফী শারহুল আক্বীদাহ আত তাহাবিয়ায় উল্লেখ করেন।[25] কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসের আলোকে ইমাম মালিক (রহ.) ঈমান আক্বীদাহর সকল বিষয়ে হকপন্থীদের সাথে একমত ছিলেন।[26]
ইমাম মালিক (রহ.) সম্পর্কে আলিম সমাজের প্রশংসা :
১. ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেন : ‘‘আলিম সমাজের আলোচনা হলে ইমাম মালিক তাদের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র, কেউ ইমাম মালিকের স্মৃতিশক্তি, দৃঢ়তা, সংরক্ষণশীলতা ও জ্ঞানের গভীরতার সমপর্যায় নয়। আর যে ব্যক্তি সহীহ হাদীস চায় সে যেন ইমাম মালিকের কাছে যায়।’’[27]
২. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) বলেন : ‘‘বিদ্যানদের অন্যতম একজন ইমাম মালিক, তিনি হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে একজন অন্যতম ইমাম, জ্ঞান-বুদ্ধি ও আদাব আখলাকসহ হাদীসের প্রকৃত অনুসারী ইমাম মালিকের মত আর কে আছে?’’[28]
৩. ইমাম নাসাঈ (রহ.) বলেন : ‘‘তাবেঈদের পর আমার কাছে ইমাম মালিকের চেয়ে অধিক বিচক্ষণ আর কেউ নেই এবং হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে অধিক আমানতদার আমার কাছে আর কেউ নেই।’’[29]
ইমাম মালিকের (রহ.) গ্রন্থাবলী:
ইমাম মালিক (রহ.)-এর বেশ কিছু রচনাবলী রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল :
১. আল মুয়াত্ত্বা।[30] হাদীসের জগতে কিছু ছোট ছোট সংকলন শুরু হলেও ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্ত্বা’ সর্ব প্রথম হাদীসের উল্লেখযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য সংকলন। এ গ্রন্থে ইমাম মালিক (রহ.) রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীস, সাহাবী ও তাবেঈদের হাদীস এবং মদীনাবাসীর ইজমা সহ অনেক ফিকহী মাসআলা বিশুদ্ধ সনদের আলোকে সংকলন করেন। তিনি দীর্ঘদিন সাধনার পর, কেউ বলেন চল্লিশ বৎসর সাধনার পর এ মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন। সে সময় বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে হাদীসের গ্রন্থ ‘মুয়াত্ত্বা’ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন : ‘‘কিতাবুল্লাহ অর্থাৎ কুরআন এর পরই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ হল ইমাম মালিকের ‘‘মুয়াত্ত্বা’’।[31] হ্যাঁ, সহীহ বুখারীর সংকলনের পূর্বে মুয়াত্ত্বাই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ ছিল। অবশ্য এখন সহীহ বুখারী সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ।
২. ‘‘কিতাবুল মানাসিক’’,[32]
৩. ‘‘রিসালাতুন ফিল কাদ্র ওয়ার্রাদ আলাল কাদারিয়া’’।[33]
৪. ‘‘কিতাব ফিন্নুজুমি ওয়া হিসাবি মাদারিয্যামানি ওয়া মানাযিলিল কামারি’’।[34]
৫. ‘‘কিতাবুস্সিররি’’।[35]
৬. ‘‘কিতাবুল মাজালাসাত’’।[36] ইত্যাদি সহীহ সনদে প্রমাণিত যে, এ সব ইমাম মালিক (রহ.)-এর সংকলিত ও রচিত গ্রন্থ। ইহা ছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থ রয়েছে।[37]
ইমাম মালিক (রহ.)-এর মৃত্যুবরণ : ইমাম মালিক (রহ.) ১৭৯ হিঃ রবিউল আউয়াল মাসে ৮৬ বছর বয়সে মদীনা মুনাওয়ারায় মৃত্যুবরণ করেন। এবং তাকে মদীনার কবরস্থান ‘‘বাকী’’তে দাফন করা হয়।[38] আল্লাহ তাঁকে রহম করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দান করুন। আমীন!
– আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী

[1] তারতীবুল মাদারিক, ১/১০২ পৃঃ, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৪৮ পৃঃ, আল-আনসাব লিস্সাম আনী, ১/২৮৭ পৃঃ, আত্-তামহীদ, ১/৮৯ পৃঃ, মানাকিব মালিক লিয্যাওয়াবী, ১৬০-১৬২ পৃঃ, আল-ইনতিকা, ৯-১১ পৃঃ ইত্যাদি।
[2] তারতীবুল মাদারিক, ১/১১০ পৃঃ, মানাকিব মালিক লিয্যাওয়াবী, ১৫৯ পৃঃ।
[3] মান্হাজু ইমাম মালিক, ২২ পৃঃ।
[4] তারতীবুল মাদারিক, ১/১০৭ পৃঃ।
[5] আল ইসাবাহ ৭/২৯৮ পৃঃ।
[6] তারতীবুল মাদারিক, ১/১১৯ পৃঃ।
[7] সিয়ারা আলামুন্নুবালা, ৮/৪৯ পৃঃ।
[8] সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৪৯-৫১ পৃঃ।
[9] তারতীবুল মাদারিক, ১/২৫৪ পৃঃ। সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৫২ পৃঃ।
[10] সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৫২-৫৪ পৃঃ।
[11] আত্-তামহীদ, ১/৮১ পৃঃ।
[12] আত্তামহীদ, ১/৭৬-৭৯ পৃঃ, আল-হুলিয়াহ, ৬/৩২৯ পৃঃ, অবশ্য এ মন্তব্য সহীহ বুখারীর পূর্বে, সহীহ বুখারী সংকলনের পর বুখারী সর্ববিশুদ্ধ গ্রন্থ।
[13] তারতীবুল মাদারিক, ১/১২১ পৃঃ।
[14] তারতীবুল মাদারিক, ১/১১৯ পৃঃ।
[15] আল ইরশাদ লিল খালিলী, ১/১১০-১১২ পৃঃ।
[16] আল মুহাদ্দিস আল ফাসিল, (৪১৪-৪১৬) পৃঃ, আল ইনতিকা ১৬ পৃঃ, আত্-তামহীদ, ১/৬৭ পৃঃ।
[17] আল মুহাদ্দিস আল ফাসিল, (৪১৪-৪১৬) পৃঃ, আল ইনতিকা ১৬ পৃঃ, আত্-তামহীদ, ১/৬৭ পৃঃ।
[18] ইত্হাফুস সালিক দ্রঃ মানহাজু ইমাম মালিক, ৩৪ পৃঃ।
[19] সিয়ারু আলামিন্নুবালা, ৮/৫৫ পৃঃ।
[20] আল-হুলিইয়্যাহ, ৬/৩১৬ পৃঃ।
[21] তার তীবুল মাদারিক, ১/১৫৪ পৃঃ।
[22] আল ইনতিকা, ৩৭-৩৮ পৃঃ।
[23] তায্ইনুল মামালিক, ১৬-১৭ পৃঃ।
[24] আল ইনতিকা, ৩৭ পৃঃ।
[25] শারহুল আক্বীদাহ আত তাহাবীয়াহ, ১/১৮৮ পৃঃ।
[26] বিস্তারিত দ্রঃ মানহাজুল ইমাম ফি ইছবাতিল আক্বীদাহ- ডঃ সউদ বিন আব্দুল আযীয আদ দা‘জান।
[27] আল ইনতিকা, ২৩, ২৪ পৃঃ।
[28] তারতীবুল মাদারিক, ১/১৩৩ পৃঃ।
[29] আল্ ইনতিকা, ৩১ পৃঃ।
[30] তানাবীরুল হাওয়ালিক, ১/৭ পৃঃ।
[31] তারতীবুল মাদারিক, ১/১৯১-১৯৬ পৃঃ, আত্তামহীদ, ১/৭৬-৭৯ পৃঃ।
[32] তায্ইনুল মামালিক, ৪০ পৃঃ, মালিক লি আমীন আল খাওলী, ৭৪৫ পৃঃ।
[33] তারতীবুল মাদারিক, ১/২০৪ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৮৮ পৃঃ।
[34] তারতীবুল মাদারিক, ১/২০ ৫ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৮৮ পৃঃ।
[35] তারতীবুল মাদারিক, ১/২০৫ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৮৯ পৃঃ।
[36] তাযইনুল মামালিক, ৪০ পৃঃ, মালিক লি আমীন আল খাওলী, ৭৪৬ পৃঃ।
[37] মানহাজু ইমাম মালিক ফি ইছবাতিল আকীদাহ, ৫১-৫৫ পৃঃ।
[38] আত্তামহীদ, ১/৯২ পৃঃ, তারতীবুল মাদারিক, ২/২৩৭-২৪১ পৃঃ, সিয়ারু আলামিন্নুবালা, ৮/১৩০-১৩৫ পৃঃ।

Saturday, September 15, 2018

ভালবাসা দিবস সম্পর্কে সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের ফতোয়া

ভালবাসা দিবস সম্পর্কে সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের ফতোয়া
( ফতোয়া নং ২১২০৩ তারিখঃ ২৩-১১- ১৪২০ হি. )
 ফতোওয়াটি সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদে বিশ্লেষণের পর এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে যে, কুরআন সুন্নাহর স্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, ইসলামে ঈদ বা উৎসবের দিন মাত্র দু’টি। সালাফে সালেহীনগণও এ বিষয়ে একমত হয়েছেন। ইসলামে স্বীকৃত ঈদ দুটির একটি হল ঈদুল ফিতর, অপরটি হল ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ। উল্লিখিত ঈদ দু’টি ব্যতীত যত ঈদ বা উৎসব আছে, হোক না তা কোন ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত, বা কোন গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত, বা কোন ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত, তা বিদআত। মুসলমানদের তা পালন করা বা পালন করতে বলা বৈধ নয় এবং এ উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ করা ও এ ব্যাপারে কিছু দিয়ে সাহায্য করাও নিষেধ। কেননা এ ধরনের কাজ আল্লাহ তা’আলার সীমা লঙ্ঘন বৈ অন্য কিছু হবে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করবে সে নিজের উপর অত্যাচার করবে। এ ধরনের কালচার বিধর্মীদের অনুসরনের কল্পে গ্রহণ করা হলে অপরাধ আরো মারাত্বক হবে। কারণ এর মাধ্যমে তাদের সদৃশ্যতা গ্রহণ করা এবং তাদেরকে এক ধরনের বন্ধু বানানো হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে এ থেকে বারণ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,   من تشبه بقوم فهو منهم  যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করল সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য।
ভালবাসা দিবস পালন করাও এ নিষেধের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এটি খৃষ্টানদের উৎসব। যে মুসলমান আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার জন্য এ কাজ করা দেয়া বা এই দিনে কাউকে ফুল বা অন্যকোনো উপহার দেয়া বৈধ নয়। বরং তার কর্তব্য হল আল্লাহ এবং তার রাসূলের হুকুম পালন করা এবং আল্লাহর শাস্তি ও গযব আসে এমন কাজ থেকে নিজে দূরে থাকা ও অন্যদের দূরে রাখা।
অতএব এ দিবসকে কেন্দ্র করে পানাহার করা, ক্রয়-বিক্রয় করা, কোন কিছু প্রস্তুত করা বা উপঢৌকন দেয়া, চিঠি-পত্র চালাচালি করা ও প্রচার-পত্র বিলি করা অবৈধ। এ সমস্ত কাজের মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করা হয়।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ المائدة2
ফতোয়াটি যারা সত্যায়ন করেছেন :
সৌদি আরবের গবেষণা ও ফতোয়া প্রদান বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ:
আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আলে শেখ
২.সদস্য: সালেহ বিন ফাওজান আল-ফাওজান
সদস্য: আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-গদইয়ান
৪. সদস্য: বকর বিন আব্দুল্লাহ আবু জায়েদ

Thursday, September 13, 2018

বইঃ আশুরা ও কারবালা

বইঃ আশুরা ও কারবালা
লেখকঃ আবু আহমেদ সাইফুদ্দিন বেলাল
বর্ননা: সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ বইটিতে আশুরা ও কারবালা অর্থ, ফজিলত, রোজা রাখার নিয়ম, বিধান, কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস, কারবালা কেন্দ্রিক বিদাত, কুসংস্কার ও মিথ্যা কেচ্ছা-কাহিনী, কারবালা ও কিছু জাল-য‘য়ীফ হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আসাকরি বইটি আমাদের সকল পাঠকদের অনেক উপকারে আসবে।

বইঃ আল্লাহ ও রাসূল (সা) সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা

এসব ভ্রান্ত আক্বীদার বিপক্ষে তেমন প্রামাণ্য বই বাংলা ভাষায় পিডিএফ প্রকাশিত হয় নি। এজন্য আমরা নিয়ে আসছি এই সুন্দর বইটি। এতে সুন্দর ভাবে আক্বীদাগুলো তুলে ধরেছে। এর মধ্যে বিভ্রান্ত আক্বীদাগুলোরও খন্ডন করা হয়েছে।

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো :
আল্লাহ সম্পর্কে আক্বীদা
  • আল্লাহ কি সর্বত্র বিরাজমান ?
  • ইমামগণের অভিমত
  • যুক্তির নিরিখে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নন
  • আল্লাহ কি নিরাকার ?
  • আল্লাহর হাত
  • আল্লাহর পা
  • আল্লাহর চোখ
  • আল্লাহর চেহারা
  • মুমিনগণের আল্লাহকে দেখা
  • আল্লাহর আকার সম্পর্কে ইমামগণের অভিমত
রাসূল (সা) সম্পর্কে আক্বীদা
  • রাসুল (সা) মাটির তৈরী না নূরের তৈরী
  • রাসূল (সা) কি গায়েবের খবর রাখেন ?
  • রাসূল (সা) কি মানুষের মাঝে উপস্থিত হতে সক্ষম ?
  • রাসূল (সা) সম্পর্কে জাল হাদীসগুলোর বর্ণনা প্রভৃতি।
আল্লাহ আমাদের আমল ও আক্বীদা শুদ্ধ করুন।

শিরক (اَلشِّرْكُ)

রচনায়: নাফি
আলহামদুলিল্লাহ্ ওয়াসসলাতু ওয়াসসালামু ‘আলা রসূলিল্লাহ্ (স:)
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং সলাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (স:) এর উপর। অতঃপর শিরকের মত মহাপাপকাজ থেকে সতর্ক করার জন্য মুসলিম সমাজে সংঘটিত কয়েকটি শিরকী কার্যক্রমের বর্ণনা কুর’আন ও সহীহ হাদীসের আলোকে এই লিফলেটটিতে তুলে ধরা হলো। এতে কুর’আনের রেফারেন্স বুঝানোর জন্য সূরাহ্-সংখ্যা ও আয়াত-সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন: [১২:১০৬] দ্বারা ১২ নং সূরাহ্ অর্থাৎ ‘সূরাহ্ ইউসুফ’ এর ১০৬ নং আয়াত বুঝানো হয়েছে।
শিরকের অর্থশাব্দিক অর্থে শিরক/শিরক (اَلشِّرْكُ) মানে অংশীদারিত্ব; কোন কিছুতে অংশীদার সাব্যস্ত করা। ইসলামের পরিভাষায় এর অর্থ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাথে কোন বিষয়ে (তাঁর রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে, তাঁর ইবাদাতের ক্ষেত্রে কিংবা তাঁর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে) কোন অংশীদার বা সমকক্ষ স্থির করা।
শির্কের ব্যাপকতাআমাদের সমাজে অনেকের ধারণা শির্ক বলতে শুধু মূর্তি পূজাকেই বুঝানো হয়। কিন্তু ঈমান আনার পাশাপাশি মানুষ তার কথা, চিন্তা ভাবনা, নিয়্যত বা কর্মের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে প্রতিনিয়ত শির্ক করে যাচ্ছে। আল্লাহ্’র তাওহীদ সম্পর্কে সহীহ জ্ঞানের অভাব, প্রচলিত রীতি-নীতি রসম-রেওয়াজের অন্ধ অনুসরণ, তথাকথিত ওলী-বুযুর্গদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি শির্ক বিস্তারের কারণ। আল্লাহ্ বলেন: অধিকাংশ লোক আল্লাহ্’র প্রতি ঈমান আনা সত্ত্বেও মুশরিক। [১২:১০৬] আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন: যারা ঈমান এনেছে এবং নিজ ঈমানকে যুলম (শির্ক) দিয়ে কলুষিত করেনি প্রকৃতপক্ষে তাদের জন্যই রয়েছে শান্তি-নিরাপত্তা এবং তারাই হচ্ছে হিদায়াতপ্রাপ্ত।” [৬: ৮২]
আয়াতের মর্মার্থ:  যাদের ঈমানের সঙ্গে শির্কের সামান্যটুকুও মিশ্রণ নেই তাদেরকেই শুধু হিদায়াত ও নিরাপত্তাপ্রাপ্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
শির্কের প্রকারভেদশির্ক মূলত দু’প্রকার: বড় শির্ক (اَلشِّرْكُ الأَكْبَرُ) ও ছোট শির্ক (اَلشِّرْكُ الأَصْغَرُ)। ইবাদাত সমূহের যে কোন ইবাদাত আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা বড় শির্ক। বড় শির্ক যে কোন ব্যক্তিকে সাথে সাথেই ইসলামের গণ্ডী থেকে বের করে দেয়। আন্তরিক তাওবা (تَوْبَةً نَّصُوحًا: [৬৬:৮]) ছাড়া আল্লাহ্ তা’আলা এ ধরনের শির্ক কখনো ক্ষমা করবেন না। ছোট শির্ক বলতে এমন কাজ ও কথাকে বুঝানো হয় যাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডী থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দিবেনা বটে, তবে তা কবীরা গুনাহ্ তথা মহাপাপ এবং তা বলবৎ রাখলে বড় শির্কের দিকে নিয়ে যায়। ছোট শির্কের মধ্যে একটি বিশেষ প্রকার হচ্ছে ‘গুপ্ত শির্ক’ (الشرك الخفي) অর্থাৎ ইবাদাত প্রদর্শন করার ইচ্ছা বা ‘রিয়া’।
শির্ক করার শাস্তি: 
“নিশ্চয়ই শির্ক হলো বড় যুলম।” [সূরাহ লুকমান, আয়াত ১৩] শির্কের মাধ্যমে মানুষের সব সৎ আমল নষ্ট হয়ে যায়। [সূরাহ যুমার, আয়াত ৬৫] শির্কে লিপ্ত ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম; জাহান্নামই হবে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা।
কুর’আন থেকে দালীল: আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
 ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করবেন না। তবে তিনি এটা ছাড়া অন্য সব (গুনাহ্) যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করবেন।’’ [৪:৪৮]
 ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করে আল্লাহ্ তা’আলা তার উপর জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং জাহান্নামকে করেন তার ঠিকানা। এরূপ অত্যাচারীদের জন্য তখন আর কোন সাহায্যকারী থাকবে না।’’ [৫:৭২]
হাদিস থেকে দালীল: রসূল (স:) বলেন, “যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যু বরণ করলো যে, সে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে শরীক করছে তাহলে সে নিশ্চিতভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” [বুখারী ১২৩৮, ৪৪৯৭, ৬৬৮৩ মুসলিম ৯২]
কতিপয় শির্কের তালিকা: 
 আহ্বান ফরিয়াদের শির্কপুণ্যার্জন বা মানুষের নিজের সাধ্যের বাইরে কোন পার্থিব লাভের আশায় বা কোন পার্থিব ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কাউকে আহ্বান করা বা কারো কাছে দুআ করা শির্ক। গাছ, পাথর, বিভিন্ন ‘মাজারের’ কচ্ছপ, কুমির ইত্যাদি অক্ষমদের কাছে চাওয়া, মনের আবেদন বলা, তাদের বরকতময় মনে করাও শির্কের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: তার চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত কে, যে আল্লাহ্’র পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না? আর তাদের আহ্বান সম্পর্কেও তারা অবহিত নয়। [৪৬:৫]
 জবাইয়ের শির্ক: একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর নৈকট্য লাভের জন্য বা অন্য কারোর নামে (নাবী, ওলী, বুযুর্গ বা জিনের নামে) কোন পশু জবাই করা শির্ক। “আপনি বলুন: আমার সলাত, আমার কোরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহ্র-ই জন্যে। তাঁর কোন অংশীদার নেই।” [৬:১৬২-১৬৩; দ্রষ্টব্য ৬:১২১]
 মানতের শির্ক: একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য বা অন্য কারোর নামে কোন কিছু মানত করা শির্ক। বর্তমান যুগে যারা তথাকথিত ওলী-বুযুর্গদের উদ্দেশ্যে বা তাদের কবরের জন্য মানত বা উৎসর্গ করে যাচ্ছে তাদের ও মক্কার মুশরিকদের মধ্যে সামান্যটুকুও পার্থক্য নেই। আল্লাহ্ মক্কার মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন: “মুশরিকরা আল্লাহর দেয়া শস্য ও পশু সম্পদের একাংশ আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে অতঃপর তাদের ধারণানুযায়ী বলে এ অংশ আল্লাহর জন্য আর এ অংশ আমাদের শরীকদের (তাদের ভ্রান্ত উপাস্যদের)।” [৬:১৩৬] কিন্তু মু’মিন শুধু মাত্র আল্লাহ’র উদ্দেশ্যে মানত করে:  দ্রষ্টব্য [৩:৩৫]।
 আনুগত্যের শির্কশরীয়তের গ্রহণযোগ্য কোন দালীল ছাড়াই হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েযের ব্যাপারে আলেম, বুযুর্গ, নেতা / উপরস্থ কারোর সিদ্ধান্ত/নীতি অন্ধভাবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়া শির্ক; যেমন: সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার বা মদ জাতীয় হারাম বস্তুকে বিভিন্ন যুক্তি তর্ক দ্বারা হালাল করা, পুরুষ ও মহিলার ওয়ারিসি সম্পত্তির সমবন্টন কিংবা পর্দাহীনতার নীতি সমর্থন ও পালন এসবই আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে শির্ক। আল্লাহ্ বলেন: “তারা আলিম ও ধর্ম যাজকদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে আল্লাহকে ছেড়ে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহ্ (ঈসা) কেও।” [৯:৩১] অথচ “সকল সৃষ্টি আল্লাহ্র-ই এবং হুকুমের অধিকারীও একমাত্র তিনি।” [৭:৫৪; আরো দ্রষ্টব্য ১২:৪০]
 তাওয়াক্কুল ভরসার শির্কমানুষের অসাধ্য ব্যাপার সমূহ সমাধানে বা বিপদ-আপদে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর উপর ভরসা করা শির্ক। পীর ফকির কে সম্মান করে বা দেনেওয়ালা বিশ্বাস করে তার কাছে সন্তান, ব্যবসায় উন্নতি চাওয়া, তাকদীর ফেরানো, তাদেরকে মুশকিল আসানকারী মনে করা সবই শির্কের অন্তর্ভুক্ত। শির্কমুক্ত ঈমানের শর্ত হচ্ছে: “তোমরা একমাত্র আল্লাহ্’র উপরই ভরসা করো যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো।” [৫:২৩; দ্রষ্টব্য ৮:২]
 শাফায়াত / সুপারিশের শির্কআল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর কাছে পরকালের সার্বিক মুক্তির জন্য কোন সুপারিশ কামনা করা শির্ক, যেমন: শাফায়াত লাভের আশায় পীর, হুজুর, ইমামদের কাছে মুরীদ হওয়া শির্ক। “সমস্ত সুপারিশ আল্লাহ্রই ক্ষমতাধীন।” [৩৯:৪৪; আরো দ্রষ্টব্য ২:২৫৫, ৬:৫১, ১০:৩, ১১:১০৫, ২০:১০৯, ২১:২৮, ৩২:৪, ৫৩:২৬, ৭৪:৪৮, ৭৮:৩৮] কিয়ামতের দিন রসূল (স:) এর সুপারিশ পাওয়ার ভাগ্য শুধু তাদের হবে যারা শির্কমুক্ত অবস্থায় ইন্তিকাল করবে। [বুখারী ৯৯ (ইল্’ম অধ্যায়), ৬৫৭০ (আর-রিক্বক), মুসলিম, ঈমান অধ্যায় ১৯৯ (দারুসসলাম ৪৯১), তিরমিযী: নং ২৪৪১, ৩৬০২]
 ওসীলার শির্ক মৃত ব্যক্তির (এমনকি নাবী, রসূল, অলীদের) অসীলা দেওয়া বা মাধ্যম সাব্যস্ত করা শির্ক। “আল্লাহ্-কে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা সবাই তোমাদের মতই বান্দা।” [৭:১৯৪; দ্রষ্টব্য ১৭:৫৭]
 কসমের শির্ক: আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে কসম কাটা (যেমন: আমার মায়ের কসম, কুর’আনের কসম, নাবীর কসম) বা কুর’আন ছুয়ে শপথ করা শির্ক। “যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুর কসম খাবে সে মুশরিক হয়ে যাবে।” [তিরমিযী ১৫৩৫; দ্রষ্টব্য বুখারী ২৬৭৯, ৬১০৮, ৬৬৫০]
 ভক্তিভালবাসার শির্কসলাতে দাঁড়ানোর মত অন্যের সামনে বা স্মৃতি স্তম্ভ, স্মৃতি সৌধ, শহীদ-মিনার, শিখা-চিরন্তন বা শিখা-অনির্বাণের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা পেশ করা/নিরবতা পালন করা এ সবই শির্ক। “মানুষের মধ্যে অনেকেই এমন যে, তারা আল্লাহ্র সাথে অন্যান্যকে শরীক করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে যেমন ভালবাসা হয়ে থাকে আল্লাহ্র প্রতি।” [২:১৬৫] আল্লাহ্-কে ভালোবাসার নিদর্শন সমূহ: আল্লাহ্’র ইচ্ছাকে নিজ ইচ্ছার উপর প্রাধান্য দেয়া এবং সকল বিষয়ে আল্লাহ্’র বিধি-বিধান ও রসূল (স:) এর সুন্নাহ্ মেনে চলা [৯:২৪, ৩:৩১, ৪৮:২৯, ৫:৫৪, ৪:৫৯]। প্রসঙ্গত: উল্লেক্ষ্য “যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট যে, মানুষ তার জন্য মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকুক তাহলে সে যেন নিজ বাসস্থান জাহান্নামে বানিয়ে নেয়।” [তিরমিযী, কিতাবুল আদাব ২৭৫৫]
১০ ভয়ের শির্কএকমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া কেউ (যেমন: কোন মূর্তি, মৃত ‘কামেল’ ব্যক্তি, অদেখা কোন জিন, ‘জিন্দা পীর’ বা কবরে শায়িত পীর) অপ্রকাশ্যভাবে দুনিয়া বা আখিরাত সংক্রান্ত কোন ক্ষতি সংঘটন করতে পারে বলে অন্ধ বিশ্বাস করে তাকে ভয় পাওয়া শির্ক। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: “নিশ্চয়ই এ শয়তান; যে সবসময় তোমাদেরকে নিজ বন্ধুদের ব্যাপারে ভয় দেখিয়ে থাকে। তোমরা ওদেরকে ভয় করোনা। শুধু আমাকেই ভয় করো যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো।” [৩:১৭৫] তেমনি ভাবে ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্যকে ভয় বা লজ্জা করা শির্ক (মানুষ কি বলবে? যদি সলাত পড়ি তাহলে কি চাকুরী থাকবে? দাড়ি রাখলে তো অন্যেরা হাসে, পর্দা করলে মানুষ উপহাস করে); যেখানে আল্লাহ্ বলছেন: “তাদেরকে ভয় করোনা; শুধু আমাকেই ভয় করো।” [৫: ৩]
১১ হিদায়াতের শির্কআল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কেউ কাউকে হিদায়াত দিতে পারে (বা নিয়ে নিতে পারে) এমন বিশ্বাস করা অথবা এ বিশ্বাসে কারোর নিকট হিদায়াত কামনা করা শির্ক। এমনকি আমাদের প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (স:) ও নিজ ইচ্ছায় কাউকে হিদায়াত দিতে পারেননি। আল্লাহ্ তা’আলা রসূল (স:) কে উদ্দেশ্য করে বলেন: “তাদেরকে সুপথে আনার দায়িত্ব তোমার উপর নেই, বরং আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন।” [২:২৭২; দ্রষ্টব্য ২৮:৫৬]
 কবর পূজার শির্ককবরে শায়িত তথাকথিত কোনো ওলী বা বুযুর্গের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বা এমনিতেই কবরের চারপাশে তাওয়াফ করা, বিনম্রভাবে কবরের সামনে দাঁড়ানো, কবরের মুরাকাবা করা, কবরবাসীর উদ্দেশ্যে আহ্বান/ফরিয়াদ, সাজদাহ, টাকা-শিন্নি দেয়া, ইসালে সওয়াব করা এসবই শির্ক। আশ্চর্য! কবরের মৃত ব্যক্তি নিজেরই কোনো উপকার করতে পারে না সে কিভাবে অন্যের সমস্যার/বিপদের সমাধান করবে? আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: “তারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য যাদেরকে ডাকে তারা কিছুই সৃষ্টি করে না; বরং ওরা নিজেরাই সৃজিত। তারা প্রাণহীন, মৃত তাদের কোনই চেতনা নেই কবে পুনরুত্থিত হবে।” [১৬:২০-২১]
  খেয়ালখুশি তথা নফসের’ অনুসরণের শির্ক: ‘যে তার খেয়াল-খুশীকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে’ [৪৫:২৩], সে-ই এই শির্ক করছে।  এই শ্রেণীর উদাহরণ:
(সলাত ত্যাগের শির্কনিজের খেয়াল-খুশিকে প্রাধান্য দিয়ে ইচ্ছাকৃত/অলসতা বশত নিয়মিতভাবে দৈনন্দিনের ফরয সলাত আদায় না করা মুশরিকের কাজ [৩০:৩১]
(শুধুমাত্র দুনিয়ার জন্য ও স্বার্থে কাজ করা, যেমন: পড়াশুনা করছি শুধু ভালো চাকুরীর জন্য, মাতাপিতার সেবা করছি সমাজের জন্য। কিন্তু জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধু এক আল্লাহ্’র জন্য ইবাদত, সৎকর্ম [৫১:৫৬, ৬৭:২, ৩১:১৪]
 আল্লাহ্ নিয়ামত অস্বীকার করার শির্ককোন নিয়ামত একমাত্র আল্লাহ্’র অনুগ্রহ স্বীকার না করে তা নিজ/অন্য কারোর মেধা বা যোগ্যতার পাওনা বলে দাবি করা শির্ক [১৬:৫৩, ১৬:৮৩; ১৭:৬৬, ৪১:৫০, ২৮:৭৮,৮১;বুখারী ৩৪৬৪]
১৫ তাবিজকবচের শির্কসমস্যা-মুসিবত ও রোগ-শোক দূর করার জন্য কিংবা সৌভাগ্য আনয়নের জন্য তাবিজ-কবচ, তাগা-বালা, পাথর, রিং, সুতা, নকশা ব্যবহার করা শির্ক। “বলো: তোমরা কি ভেবে দেখেছ যে, আল্লাহ্ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা কি সেই অনিষ্ট দূর করতে পারবে? বা তিনি আমার প্রতি রহমত করতে চাইলে তারা কি সে রহমত বন্ধ করতে পারবে? বলো, আমার পক্ষে আল্লাহ্ই যথেষ্ট।” [৩৯:৩৮] “যে তাবিজ ঝুলালো সে শির্ক করল।” [আহমাদ ১৬৯৬৯, আস্-সিলসিলাহ আস্-সহীহ্ ৪৯২]
১৬ যাদুর শির্কসকল প্রকার কালো যাদু, যাদু করানো, যাদুকরদের সম্মান করা শির্ক। যাদুকরেরা জিনদের নামে পশু জবাই, তাদেরকে  সিজদা এরকম সব বড় শির্কের মাধ্যমে শয়তান জিনদের প্রিয়ভাজন হয় এবং তাদের সাহায্য নিয়ে পরস্পরের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, কাউকে জ্ঞানশুন্য করে ফেলা ইত্যাদি ক্ষতি করে থাকে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: “বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল, তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত।” [২:১০২]
১৭ আল্লাহ্ সিফাতের শির্কবিভিন্ন ভাবে মানুষ এই শির্ক করে থাকে, যেমন:-
(একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও কোন নাবী, ওলী বা পীর-বুযুর্গ সব কিছু শুনতে বা দেখতে পান বা অন্তরের গোপন কথা বুঝতে পারেন এমন মনে করা শির্ক। এতে করে আল্লাহ্’র সাথে সমকক্ষ দাঁড় করানো হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ্’র জন্য প্রযোজ্য সিফাত্গুলোর সাথে: সর্ব-শ্রোতা (السَّمِيعُ), সর্ব-দ্রষ্টা (الْبَصِيرُ) এবং সর্ব-জ্ঞানী (الْعَلِيمُ); দ্রষ্টব্য [২:১২৭, ৩:১৬৩, ২:২৯]।
(একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়াও কোন নাবী, ওলী, গাওস, ক্বুতুব, আব্দালের এ বিশ্ব পরিচালনায় অথবা এর কোন কর্মকাণ্ডে হাত আছে (যেমন: ‘বুযুর্গের’ এক হুকুমে বৃষ্টি দেয়া, তুফান বন্ধ করা ইত্যাদি) এমন বিশ্বাস / মনে করা শির্ক। সমগ্র বিশ্বের নিয়ন্ত্রক একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা; দ্রষ্টব্য [১০:৩, ১০:৩১, ১৩:২, ৩২:৫]
(গণক, ভবিষ্যৎ বক্তা, ভাগ্যপরীক্ষকের কাছে যাওয়া, রাশি, তারকা-নক্ষত্র, জোতিষী, হস্তরেখা দিয়ে ভাগ্য যাচাই শির্ক। একইভাবে কোন নাবী, ওলী বা পীর-বুযুর্গ গায়েব জানেন এমন মনে করাও শির্ক। যা কোন ধরনের মানবেন্দ্রিয় বা মানব তৈরী প্রযুক্তি কর্তৃক উপলব্ধ বা জ্ঞাত হওয়া সম্ভবপর নয় তাই গায়েব (যেমন: গর্ভস্থ সন্তান ছেলে বা মেয়ে তা প্রযুক্তি দ্বারা জানা সম্ভব কিন্তু সে সন্তান কেমন মানুষ হবে, মুত্তাকি হবে কি হবে না তা ‘গায়েব’)। আল্লাহ্ বলেন: “বলো, আল্লাহ্ ব্যতীত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে কেউ গায়েবের খবর জানে না।” [২৭:৬৫; আরো দ্রষ্টব্য: ৬:৫০ ও ৬:৫৯, ৩১:৩৪]।
() একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া কেউ কাউকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিতে পারে/কেউ কাউকে ধনী বা গরিব বানাতে পারে এমন মনে করা শির্ক: [৩:২৬; ১৩:২৬, ১৭:৩০]।
১৮ আল্লাহ্ নামের শির্কআল্লাহ্ তা’আলা কে তাঁর নাম বাদ দিয়ে অন্য নামে যেমন: দুয়া’র সময় ‘হে খোদা’, ‘হে বিধাতা’ ‘হে পাক-পরওয়ারদিগার’ ইত্যাদি নামে ডাকা শির্ক। কুরআন আর সহীহ্ হাদীস থেকে আল্লাহ্’র যে সব নাম (আসমা-উল-হুসনা) আমরা জানতে পারি সে সব নাম দিয়েই আল্লাহ্-কে ডাকতে হবে আর এটাই বৈধ অসীলা।  এ মর্মে আল্লাহ্ আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন: “আর আল্লাহ্র জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকো; আর তাদেরকে বর্জন কর যারা তাঁর নামের মধ্যে বিকৃতি ঘটায়। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে।” [৭:১৮০] একমাত্র আল্লাহ্র জন্য প্রযোজ্য আল্লাহ্র সিফাতি নামে কোনো মানুষের নাম রাখা ও তাকে ডাকা গুরুতর পাপ যেমন: ‘আব্দুল’ ব্যবহার না করে ‘রাব্বি’ ‘রহমান’ ‘রকিব’ ‘রহিম’ ‘গফফার’ ‘খালেক’ ‘রাজ্জাক’ ইত্যাদি নাম রাখা / সংক্ষেপ করে এসব নামে মানুষকে ডাকা।
১৯ নাবী মুহাম্মদ (🙂 এর প্রতি অতিমানবীয় গুণআরোপের শির্করসূল (স:) কে () নূরের নাবী, ()জিন্দা নাবী/হায়াতুন্নাবী, () আলিমুল গায়েব মনে করা শির্ক। () “বলো: আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ।” [১৮:১১০] () “নিশ্চয়ই তুমিও মরণশীল, তারাও মরণশীল।”  [৩৯:৩০; দ্রষ্টব্য ৩:১৪৪] () “বলো, আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন তাছাড়া আমার নিজের ভালো বা মন্দ করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আর আমি যদি গায়েবের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম, ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না।” [৭:১৮৮]
২০ কথাকুসংস্কার  মতবাদের শির্ক:
(অতীতে সংঘটিত ঘটনার ক্ষেত্রে ‘যদি’ ব্যবহার করা শির্ক; কারণ, এ ধরনের কথা তাক্বদীরে অবিচল বিশ্বাসের বিরোধী। যেমন: ‘যদি (মৃত) লোকটাকে অমুক দেশে/হসপিটালে নিয়ে যেত তো সে বেঁচে যেত’ ইত্যাদি। আবার যুগ/সময়/বাতাস ইত্যাদিকে গালি দেওয়াও শির্ক। এছাড়া অনেক কবিতা/গান ভয়াবহ শির্কপূর্ণ, যেমন: ‘খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া [বিদ্রোহী কবিতা, কাজী নজরুল ইসলাম]  
() কুসংস্কার (যেমন: হাত চুলকালে টাকা আসে), অশুভ আলামত (যেমন: কুকুর/কাক ডাকলে মানুষ মারা যায়/ক্ষতি হয়) ইত্যাদি বলা/বিশ্বাস করা শির্ক। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: “আল্লাহ্ যদি তোমাকে কষ্ট দিতে চান তাহলে তিনি ছাড়া তা দূর করার কেও নেই। আর যদি তিনি তোমার কোন কল্যাণ করতে চান তাহলে তাঁর অনুগ্রহের গতিরোধ করার সাধ্য কারোরই নেই।” [১০:১০৭; ৩:১৫৪, ৩১:৬, ৪৫:২৪, বুখারী ৬১৮১, মুসলিম ২২৪৬, তিরমিযী ২২৫২]
(i. শক্তির অবিনাশিতাবাদ, ii. বিবর্তনবাদ/প্রকৃতিবাদ, iii. গণতন্ত্র (সকল ক্ষমতার উত্স জনগণ), সমাজতন্ত্র, ইসলামী-গণতন্ত্র (স্ববিরোধী-শব্দ) এরকম যাবতীয় তন্ত্র ও মতবাদ বিশ্বাস করা শির্ক; i. “সবকিছুই ধ্বংসশীল একমাত্র আপনার মহিমাময় ও মহানুভব রবের মুখমন্ডল (সত্তা) ছাড়া” [৫৫:২৬-২৭] ii. “আল্লাহ্ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একজন ব্যক্তি থেকে।” [৭:১৮৯] iii. “নিশ্চয়ই আল্লাহ্’র নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম।” [৩:১৯]; আরো দ্রষ্টব্য: [৩:৮৫, ৫:৩, ১২:৪০]।
পরিশেষে:
اللَّهُمَّ  إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ أَعْلَم      [আহমাদ ১৯৬০৬]
 “হে আল্লাহ! আমি জ্ঞাতসারে আপনার সাথে শির্ক করা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই এবং অজ্ঞতাসারে (শির্ক) হয়ে গেলে তার জন্য ক্ষমা চাই।”

দাওয়াতি কাজ সকল মুসলিমের জন্য ফরজ এবং সাধারণ মানুষদের দাওয়াতি কাজের কতিপয় পদ্ধতি

  ▬▬▬✪✪✪▬▬▬ প্রশ্ন: সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ কি সবার উপরে ফরজ? যাদের দ্বীনের জ্ঞান নেই যেমন জেনারেল লাইনে পড়া মানুষ কিন্তু দ্বীন জানার...