Showing posts with label ইসলামি প্রবন্ধ. Show all posts
Showing posts with label ইসলামি প্রবন্ধ. Show all posts

Friday, June 18, 2021

সগিরা গুনাহ, ভয়াবহতা এবং কতিপয় উদাহরণ


 

সগিরা গুনাহ, ভয়াবহতা এবং কতিপয় উদাহরণ
▬▬▬◄❖►▬▬▬
প্রশ্ন: সগিরা বা ছোট গুনাহ কাকে বলে? এর ভয়াবহতা কতটুকু? সচরাচর মানুষ যে সব সগিরা গুনাহ করে সেগুলো কি কি? কিছু উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলে উপকৃত হবো আশা করি।
উত্তর :
নিম্নে সগিরা বা ছোট গুনাহের পরিচয়, এর ভয়াবহতা এবং কতিপয় উদাহরণ তুলে ধরা হল:
🌀 সগিরা (ছোট) গুনাহ কাকে বলে?
▪শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া রহ. বলেন, "এ মাসয়ালায় (সগিরা বা ছোট গুনাহের পরিচয়ের ব্যাপারে) ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত কথাটি সবচেয়ে সঠিক। এটি আবু উবাইদ ও ইমাম আহমদ প্রমুখ উল্লেখ করেছেন। আর তা হল:
أن الصغيرة ما دون الحدين: حد الدنيا وحد الآخرة
“সগিরা বা ছোট পাপ বলা হয় ঐ পাপকে, যা দুনিয়ার দণ্ড ও আখিরাতের দণ্ড (অবধারিত হয় এমন পাপ) থেকে নিম্ন পর্যায়ের।"
[অর্থাৎ ছোট গুনাহ বলতে বুঝায়, যে সকল অপরাধের ক্ষেত্রে দুনিয়ায় আইনগত দণ্ড বিধি নেই (যেমন, হাত কাটা, পাথর মেরে মৃত্যু দণ্ড দেয়া, বেত্রাঘাত করা ইত্যাদি) অনুরূপভাবে আখিরাতেও নির্ধারিত কোনও দণ্ড বা শাস্তির কথা বলা হয় নি। যেমন: কবরের আজাব, জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ ইত্যাদি]
▪আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমিন রহ. বলেন,
الكبائر هي ما رتب عليه عقوبة خاصة بمعنى أنها ليست مقتصرة على مجرد النهي أو التحريم، بل لا بد من عقوبة خاصة مثل أن يقال من فعل هذا فليس بمؤمن، أو فليس منا، أو ما أشبه ذلك، هذه هي الكبائر، والصغائر هي المحرمات التي ليس عليها عقوبة. انتهى
"কবিরা বা বড় গুনাহ বলা ঐ সকল গুনাহকে যেগুলোর ব্যাপারে বিশেষ কোনও শাস্তি আরোপের বিধান রয়েছে। অর্থাৎ যেগুলো শুধু নিষেধ বা হারামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং তাতে অবশ্যই বিশেষ শাস্তি রয়েছে। যেমন: যে এ কাজ করবে সে ইমানদার নয় অথবা সে আমাদের দলভুক্ত নয় ইত্যাদি। এগুলো হল কবিরা গুনাহ। আর সগিরা বা ছোট গুনাহ হল ঐ সকল হারাম কাজ যেগুলোর জন্য শাস্তি নাই।"
সুতরাং আলেমদের বক্তব্যের আলোকে আমরা বলতে পারি, যে সকল গুনাহ কবিরা পর্যায়ের নয় সেগুলোই সগিরা গুনাহ। তাহলে সগিরা গুনাহ সম্পর্কে জানতে হলে আগে কবিরা গুনাহ সম্পর্কে জানতে হবে।
▪কোনও কোনও আলেম বলেন, "যে সব গুনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না সেগুলো কবিরা গুনাহ আর যে সব গুনাহ তওবা ছাড়া বিভিন্ন প্রকার নেক আমলের দ্বারা মাফ হয় সেগুলো সগিরা গুনাহ।"
🌀 সগিরা বা ছোট গুনাহের ভয়াবহতা:
➤ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« إِيَّاكُمْ وَمُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ فَإِنَّمَا مَثَلُ مُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ كَقَوْمٍ نَزَلُوا فِي بَطْنِ وَادٍ، فَجَاءَ ذَا بِعُودٍ، وَجَاءَ ذَا بِعُودٍ حَتَّى أَنْضَجُوا خُبْزَتَهُمْ، وَإِنَّ مُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ مَتَى يُؤْخَذْ بِهَا صَاحِبُهَا تُهْلِكْهُ».
‘সাবধান! গুনাহকে তুচ্ছ মনে করার ব্যাপারে সর্তক হও। কেননা গুনাহকে তুচ্ছ মনে করার উদাহরণ হল:
একদল লোক কোন এক পাহাড়ের উপত্যকায় যাত্রা বিরতি করলো। এরপর সেখানে কেউ একটা কাঠি নিয়ে এলো, আরেকজন আরেকটা কাঠি নিয়ে এলো।তারপর তারা (এই ছোট ছোট কাঠিগুলো জমা করে সেগুলো দ্বারা) রুটি পাকালো।
ঠিক তদ্রূপ যে সব গুনাহকে তুচ্ছ ভাবা হয় সেগুলোই এতে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে।“ [মুসনাদ আহমাদ ৫/৩৩১। সহীহুল জামে‘, নাসিরুদ্দিন আলবানি, আল মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় প্রকাশ, হাদিস নং: ২৬৮৬।]
➤ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إِيَّاكُمْ وَمُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ ، فَإِنَّهُنَّ يَجْتَمِعْنَ عَلَى الرَّجُلِ حَتَّى يُهْلِكْنَهُ
“তোমারা ছোট গুনাহ থেকেও দূরে থাকবে। কেননা, এগুলো জমা হয়ে মানুষকে ধ্বংস করে ছাড়ে।” (সহীহুল জামে লিল আলবানি, হা/২৬৮৭-সহীহ)
➤ বিজ্ঞ আলিমগণ বলেছেন: ছোট গুনাহকে যদি কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে বারবার করে বা তুচ্ছ মনে করে করে তখন তা আর ছোট থাকে না বরং তা বড় গুনাহে পরিণত হয়।
যেমন: ইমাম নওবী রহ. সহীহ মুসলিম এর ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন:
رُوِيَ عَنْ عُمَر وَابْن عَبَّاس وَغَيْرهمَا رَضِيَ اللَّه عَنْهُمْ : لا كَبِيرَة مَعَ اِسْتِغْفَارٍ ، وَلا صَغِيرَة مَعَ إِصْرَار
مَعْنَاهُ : أَنَّ الْكَبِيرَة تُمْحَى بِالاسْتِغْفَارِ , وَالصَّغِيرَة تَصِير كَبِيرَة بِالإِصْرَارِ اهـ
উমর রা. এবং ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে। তারা বলেছেন: ইস্তিগফার তথা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা হলে কোনও কবিরা (বড়) গুনাহ অবশিষ্ট থাকে না আর কোনও গুনাহ বারবার করা হলে তা আর সগিরা (ছোট) থাকে না।"
এ কথার অর্থ হল: বড় গুনাহ ইস্তিগফার (আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা) এর মাধ্যমে মুছে যায় আর ছোট গুনাহ বারবার করার মাধ্যমে বড় গুনাহে পরিণত হয়।"
➤ ছোট গুনাহগুলোকে তুচ্ছ মনে না করা আল্লাহর নির্দেশনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَن يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّـهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ عِندَ رَبِّهِ
“আর কেউ আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্যে উত্তম।” (সূরা হজ্জ: ৩০)
➤ কবি বলেন: (আরবি কবিতা)
خل الذنوب صغيــــــرها
وكبيـرها فهو التـــــقى
واصنع كمـــــــاش فوق أرض
الشــــوك يحذر ما يرى
لا تحــــقرن صغيـــــرة
إن الجبـــال من الحــصى
সরল অর্থ:
ছোট -বড় সকল পাপকর্ম পরিত্যাগ কর।
এরই নাম ‘আল্লাহ ভীতি’।
আর পথ চল ঠিক সেভাবে যেভাবে একজন মানুষ
কণ্টকময় রাস্তা দিয়ে সর্তকতার সাথে পথ চলে।
ছোট বলে কোন পাপকেই তুচ্ছ মনে করো না।
কেননা, বড় বড় পাহাড়গুলো (এত বিশাল আকার ধারণ করেছে)
ছোট-ছোট নুড়ি পাথর দ্বারাই।
🌀 সগিরা বা ছোট গুনাহের কতিপয় উদাহরণ:
সগিরা বা ছোট গুনাহের সীমা-সংখ্যা নাই। তবুও নিম্নে বহুল প্রচলিত কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হল:
◈ নামাজরত অবস্থায় এদিক ওদিকে দৃষ্টিপাত করা।
◈ নামায অবস্থায় কাপড়, দাড়ি, বা শরীরের কোন অঙ্গ নিয়ে খেলা করা।
◈ জুমার ২য় আযানের সময় বেচাকেনা করা।
◈ কোন ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোনও মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাবের উপর তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে অন্যজন প্রস্তাব করা।
◈ বেচাকেনার ক্ষেত্রে কেউ দরদাম করছে এমতাবস্থায় তার শেষ হওয়ার আগে আরেকজন এসে দরদাম শুরু করা।
◈ কোন পর নারীর দিকে দৃষ্টিপাত করা।
◈ স্ত্রীকে এক বৈঠকে একাধিক তালাক দেয়া।
◈ ঋতু চলাকালীন সময়ে তালাক দেয়া।
◈ অতিরিক্ত ঝগড়া-ঝাটি করা।
◈ গীবত শুনে চুপ থাকা।
◈ পাপাচারী লোকদের সাথে ( সংশোধন ও দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া) উঠবস করা।
◈ খোলা স্থানে কিবলার দিকে মুখ করে বা কেবলাকে পেছনে করে পেশাব-পায়খানা করা।
◈ বিনা প্রয়োজনে উপকার হীন কথাবার্তা বলা ইত্যাদি।
পাপ ছোট না বড় সে দিকে না তাকিয়ে আমাদের উচিৎ সব ধরণের পাপাচার থেকে বিরত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। তারপরও শয়তানের কুমন্ত্রণা ও কু প্রবৃত্তির তাড়নায় কোনও পাপাচার করে ফেললে তৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত হৃদয়ে সেই ক্ষমাশীল দয়াময় প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা আবশ্যক। তাহলে তিনি ক্ষমা করবেন বলে আশা করা যায়।
পরিশেষে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই জনৈক মনিষীর চমৎকার একটি বাণী:
لا تَنْظُرْ إِلَى صِغَرِ الْخَطِيئَةِ ، وَلَكِنِ انْظُرْ إِلَى عَظَمَةِ مَنْ تَعْصِي
"পাপের ক্ষুদ্রতার দিকে না তাকিয়ে যার অবাধ্যতা করছ তার বিশালত্বের দিকে তাকাও।"
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ছোট-বড় সকল প্রকার গুনাহ থেকে বাঁচার তাওফিক দান করুন এবং জেনে-না জেনে যে সকল গুনাহ করে ফেলি সেগুলো ক্ষমা করুন। আমীন।
▬▬▬◄❖►▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল, সৌদি আরব

দায়েমি (সার্বক্ষণিক) ফরজ


 

দায়েমি (সার্বক্ষণিক) ফরজ
▬▬▬▬◢◯◣▬▬▬▬
প্রশ্ন: পুরুষ ও নারীদের দায়েমি (সার্বক্ষণিক) ফরজগুলো কি কি?
উত্তর:
দায়েমি ফরজ অর্থ: এমন ফরজ যা প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন এবং সার্বক্ষণিক ভাবে পালন করা আবশ্যক। নারী-পুরুষের প্রকৃতি ও সৃষ্টিগত কিছু পার্থক্য ছাড়া উভয়ের উপর অবশ্য পালনীয় ফরজ বিধানগুলো প্রায় একই রকম।
নিম্নে কুরআন-হাদিসের নির্যাস থেকে উভয়ের জন্য আলাদা আলাদাভাবে কতিপয় সার্বক্ষণিক পালনীয় ফরজ কাজ তুলে ধরা হল:
❑ পুরুষদের দায়েমি ফরজ: (১৮টি)
যেমন:
◈ ১. সার্বক্ষণিক ঈমানের অবস্থায় থাকা।
◈ ২. সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করা।
◈ ৩. সর্বাবস্থায় শিরক, বিদআত এবং সব ধরণের আল্লাহর নাফরমানি ও পাপাচার থেকে দূরে থাকা।
◈ ৪. পরনারী থেকে দৃষ্টি হেফাজত করা
◈ ৫. হালাল স্ত্রী ছাড়া লজ্জা স্থান হেফাজত করা।
◈ ৬. স্ত্রী-সন্তানদের হক আদায় করা এবং যথাসাধ্য ভালোভাবে তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা
◈ ৭. হালাল পন্থায় অর্থ উপার্জন করা (অর্থ উপার্জনে সব ধরণের হারাম পন্থা পরিহার করা)
◈ ৮. স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে অন্যায় কাজ করতে দেখলে বা এ সম্পর্কে অবগত হলে তাদেরকে বাধা দেয়া, তাদেরকে দীনের সঠিক জ্ঞান দান করা ও ইসলামের উপর প্রতিপালন করা। স্ত্রী অন্যায়-পাপাচারে জড়িত থাকলে তাকে নসিহত করা। এতে কাজ না হলে তার বিরুদ্ধে শরিয়ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
◈ ৯. মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করা, ভালো কথা বলা অথবা চুপ থাকা এবং গিবত, চুগলখোরি, গালাগালি, অশ্লীল ও নোংরা কথাবার্তা, মিথ্যা কথা, মিথ্যা সাক্ষ্য, কারও মৃত্যুতে বিলাপ করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা।
◈ ১০. সর্বাবস্থায় আল্লাহ, রাসূল ও দীনের প্রতি ভালবাসা অটুট রাখা।
◈ ১১. স্ত্রী সহবাস, স্বপ্নদোষ বা অন্য কোনও কারণে গোসল ফরজ হলে গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা।
◈ ১২. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমজান মাসে রোজা এবং অন্যান্য ফরজ ইবাদতগুলো যথা সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করা।
◈ ১৩. দাড়ি রাখা। (দাড়ি কাটা, ছাঁটা,মুণ্ডন করা হারাম।)
◈ ১৪. নিজের শরীরে হক আদায়ের পাশাপাশি পিতা-মাতার আনুগত্য (যদি তা আল্লাহর নাফরমানি ও সাধ্যাতিরিক্ত না হয়) এবং মুসলিমদের পারস্পারিক হক সমূহ আদায় করা।
◈ ১৫. দীন সম্পর্কে কমপক্ষে এতটুকু জ্ঞান অন্বেষণ করা যা দ্বারা দৈনন্দিন ফরজ ইবাদত সমূহ সুন্দরভাবে সম্পাদন করা করা সম্ভব হয়।
◈ ১৬. সর্বক্ষেত্রে হালাল-হারাম বিধান মেনে জীবন যাপন করা।
◈ ১৭. কাফেরদের সাদৃশ্য অবলম্বন না করা (ধর্মীয়, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির ক্ষেত্রে)।
◈ ১৮. কখনো আল্লাহর নাফরমি মূলক কাজ বা পাপাচার ঘটে গেলে অনতিবিলম্বে আন্তরিক অনুশোচনা সহকারে আল্লাহর কাছে তওবা করা ইত্যাদি।
❑ মহিলাদের দায়েমি ফরজ: (১৬টি)
যেমন:
❂ ১. সার্বক্ষণিক ঈমানের অবস্থায় থাকা।
❂ ২. সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করা।
❂ ৩. সর্বাবস্থায় শিরক, বিদআত এবং সব ধরণের আল্লাহর নাফরমানি ও পাপাচার থেকে দূরে থাকা।
❂ ৪. পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে নিজেকে হেফাজত করা (পূর্ণাঙ্গ পর্দা করা)।
❂ ৫. স্বামী ছাড়া নিজের লজ্জা স্থান হেফাজত করা।
❂ ৬. স্বামীর আনুগত্য করা এবং তার সন্তান-সন্ততি, অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণ করা।
❂ ৭. সন্তান-সন্ততিকে অন্যায় কাজ করতে দেখলে বা এ সম্পর্কে অবগত হলে তাদেরকে বাধা দেয়া, তাদেরকে দীনের সঠিক জ্ঞান দান করা ও ইসলামের উপর প্রতিপালন করা। স্বামীকে অন্যায়-পাপাচারে জড়িত থাকলে তাকে নসিহত করা এবং সংশোধনের চেষ্টা করা।
❂ ৮. মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করা, ভালো কথা বলা অথবা চুপ থাকা। সেই সাথে গিবত, চুগলখোরি, গালাগালি, অশ্লীল ও নোংরা কথাবার্তা, মিথ্যা কথা, মিথ্যা সাক্ষ্য, কারও মৃত্যুতে বিলাপ করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা।
❂ ৯. সর্বাবস্থায় আল্লাহ, রাসূল ও দীনের প্রতি ভালবাসা অটুট রাখা।
❂ ১০. স্বামী সহবাস, স্বপ্নদোষ, হায়েজ-নিফাস থেকে মুক্ত হলে বা অন্য কোনও কারণে গোসল ফরজ হলে গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা।
❂ ১১. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমজান মাসে রোজা এবং অন্যান্য ফরজ ইবাদতগুলো যথা সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করা।
❂ ১২. দীন সম্পর্কে কমপক্ষে এতটুকু জ্ঞান অন্বেষণ করা যা দ্বারা দৈনন্দিন ফরজ ইবাদত সমূহ সুন্দরভাবে সম্পাদন করা করা সম্ভব হয়।
❂ ১৩. সর্বক্ষেত্রে হালাল-হারাম বিধান মেনে জীবন যাপন করা ইত্যাদি।
❂ ১৪. নিজের শরীরে হক আদায়ের পাশাপাশি অবিবাহিত অবস্থায় পিতামাতার এবং বিয়ের পর স্বামীর আনুগত্য (যদি তা আল্লাহর নাফরমানি ও সাধ্যাতিরিক্ত না হয়) এবং মুসলিমদের পারস্পারিক হক সমূহ আদায় করা।
❂ ১৫. কাফেরদের সাদৃশ্য অবলম্বন না করা (ধর্মীয়, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির ক্ষেত্রে)।
❂ ১৬. কখনো আল্লাহর নাফরমি মূলক কাজ বা পাপাচার ঘটে গেলে অনতিবিলম্বে আন্তরিক অনুশোচনা সহকারে আল্লাহর কাছে তওবা করা ইত্যাদি।
আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষ উভয়কে তাদের উপর অর্পিত অবধারিত দায়েমি ফরজ ইবাদতগুলো পূর্ণ ইখলাসের সাথে সম্পাদন করার তওফিক দান করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
-আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব

কুরবানি সংক্রান্ত প্রচলিত ১৭টি ভুল


 কুরবানি সংক্রান্ত প্রচলিত ১৭টি ভুল

লেখক: আব্দুর রাকীব মাদানী
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিহিল কারীম, আম্মা বাদঃ
অতঃপর এই সংক্ষিপ্ত লেখায় আমরা কুরবানি সংক্রান্ত কতিপয় ভুল-ত্রুটি আলোকপাত করার ইচ্ছা করেছি, যেন এই ইবাদতটি আমরা সঠিক ভাবে সম্পাদন করতে পারি এবং ভুল-ত্রুটি থেকে দূরে থেকে পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হতে পারি। ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।
◈ ১-কুরবানির উদ্দেশ্যে ভুল:
কুরবানি একটি ইবাদত কারণ মহান আল্লাহ তা পছন্দ করেন এবং আমাদের তা করার আদেশ দেন। আল্লাহ বলেন: (তাই তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে স্বলাত পড় এবং কুরবানি কর।) [সূরা কাউসার/২] এই রকম প্রত্যেক ইবাদত কবুলের প্রথম শর্ত হল, ইবাদতে ইখলাস থাকা। অর্থাৎ ইবাদতটি খাঁটি ভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হওয়া। তাই কুরবানি করার উদ্দেশ্য হবে শরীয়া নির্দিষ্ট পশু নির্দিষ্ট সময়ে জবাই করার মাধ্যমে আল্লাহকে রাযী-খুশী করা। কিন্তু তিক্ত সত্য হচ্ছে সমাজের বহু লোক কুরবানি দেয় গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে, যা তাদের কথা-বার্তায় অনেক সময় প্রকাশও পায়। তারা বলে: কুরবানি না দিলে গ্রাম-সমাজের লোকেরা কি বলবে! সেদিন সবাই গোশত খাবে আর আমার বাচ্চা-কাচ্চারা কি খাবে! আর অনেকে দেয় সমাজে প্রসিদ্ধ হবার উদ্দেশ্যে ও নাম পাবার আশায়। তাই বাজারের সেরা পশু ক্রয় করে পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে বা প্রচারের আশা করে। অথচ আল্লাহ বলেন:
لَنْ يَنَالَ اللَّـهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَـٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ
অর্থ: “আল্লাহর কাছে ঐসবের গোশত এবং রক্ত পৌঁছে না বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (আল্লাহ ভীরুতা)।” [আল হজ্জ/৩৭]
◈ ২-অনেক সামর্থবান ব্যক্তি কুরবানি তো করে কিন্তু ফরয ইবাদত হজ্জকে বেমালুম ভুলে যায়:
যিল হজ্জ মাসের ১০ম তারিখ যেদিন কুরবানির দিন সেদিন কিন্তু হজ্জেরও বিশেষ দিন। প্রত্যেক সামর্থবান মুসলিমের প্রতি হজ্জ করা ফরয। কিন্তু এমন অনেকে আছে যারা প্রতি বছর কুরবানি তো ধুমধামের সাথে করে থাকে কিন্তু তাদের উপর হজ্জ করা যে জরুরি তা বেমালুম ভুলে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আল্লাহর জন্য উক্ত ঘরের হজ্জ করা লোকদের উপর আবশ্যক যার সে পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে আর যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে, (সে জেনে রাখুক) নিঃসন্দেহে আল্লাহ জগত সমূহের প্রতি অমুখাপেক্ষী।”[আল ইমরান/৯৭]
◈ ৩-যিল হজ্জ তথা কুরবানির মাসের প্রথম দশকের বিভিন্ন ফযিলত উপেক্ষা করে শুধু কুরবানি করতে আগ্রহী হওয়া:
উল্লেখ্য যে, যিল হজ্জ মাসের ১ম দশক খুবই ফযীলতপূর্ণ দশক। অনেক উলামার মতে, আল্লাহর নিকট যিল হজ্জ মাসের প্রথম দশকের দিনের সৎ আমল সমূহ রমাযানের শেষ দশকের দিনের ইবাদতের থেকেও উত্তম। [শারহুল্ মুমতি, ইবনু উসাইমীন,৬/৪৭০] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “কোনো এমন দিন নেই, যাতে এই দশকের তুলনায় সৎ আমল আল্লাহর নিকট বেশী পছন্দনীয়। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন: আল্লাহর রসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও কি বেশী পছন্দনীয় নয়? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও বেশী পছন্দনীয় নয় কিন্তু সেই ব্যক্তি যে তার জান ও মাল নিয়ে বের হয় এবং তা নিয়ে আর পুনরায় ফেরত আসে না”। [বুখারী, দুই ঈদ অধ্যায়, নং (৯৬৯)/আবু দাঊদ নং (২৪৩৮)]
উপরোক্ত হাদিসের মর্মার্থ ব্যাপক, তাই সকল ধরণের সৎ আমল এই দশকে বেশী বেশী করণীয়। যেমন,
হজ্জ ও উমরাহ। কারণ এটি হজ্জের মাস এবং উক্ত আমল দুটির ফযিলত ও অপরিসীম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “এক উমরা আর এক উমরার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের কাফ্ফারা স্বরূপ। আর (মাবরূর) গৃহীত হজ্জের বদলা জান্নাত ছাড়া কিছু নয়”। [বুখারী, নং ১৭৭৩ মুসলিম নং ১৩৪৯]
সিয়াম পালন। যেহেতু হাদিসে সৎ আমল কথাটি ব্যাপক আর রোযা হচ্ছে সৎ আমল, তাই অনেকে এই দশকের প্রথম থেকে নবম দিন পর্যন্ত রোযা পালন উত্তম মনে করেছেন।[শারহু মুসলিম, নবভী, ৮/৭৫] বিশেষ করে আরাফার দিনে। কারণ আরাফার দিনের রোযা বিগত ও আগত এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা স্বরূপ। [মুসলিম, নং ১১৬২]
এই দশকে তাকবীর পাঠ করা। [বিস্তারিত এই পয়েন্টের পরে]
কুরবানি করা।
দুআ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকর-আযকার, সদকা, আত্মীয়তা বজায় রাখা ইত্যদি।
কিন্তু আমদের অনেকেই উপরোক্ত আমল সমূহের প্রতি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে কেবল কুরবানি করার জন্য, পশু ক্রয় করা ও তা কুরবানি দেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকি!
◈ ৪-এই পুরো দশকে সাধারণত: এবং তাশরীকের দিন গুলিতে ফরয নামাযান্তে বিশেষ করে তাকবীর পড়ার সুন্নতকে অবহেলা করা:
এই দিনগুলি হচ্ছে বিশেষ করে আল্লাহকে স্মরণ করার দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তাই এতে বেশী বেশী তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) এবং তাহমীদ (আল্ হামদুলিল্লাহ) পাঠ কর”। [আহমদ, নং ৬১৫৪, আহমদ শাকির সহীহ বলেছেন] অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “এগুলি পানাহার এবং আল্লাহর যিকরের দিন”। [আবু দাঊদ (২৪১৯, নাসাঈ ৩৯৯৫)
এই ১৩ দিনে দুই ধরণের তাকবীর পাঠ সুন্নাহ:
একটি হলঃ সাধারণ তাকবীর পাঠ, যা ১ম যিল হজ্জ থেকে ১৩ই যিল হজ্জের সূর্য ডোবা পর্যন্ত যে কোনো সময় পাঠ করা সুন্নাহ। আর একটি হল মুক্বায়্যাদ (শর্তযুক্ত) তাকবীর পাঠ। আর তা হচ্ছে, প্রত্যেক ফরয নামাযান্তে তাকবীর পাঠ যা, আরাফার দিন ফজর নামাযের পর থেকে শুরু হয়ে ১৩ই যুল হজ্জের আসর নামায পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। (এটা তাদের জন্য যারা হজ্জ পালনকারী নয়) আর হাজীদের ক্ষেত্রে এই মুক্বায়্যাদ তাকবীর কুরবানির দিন যোহর থেকে শুরু হবে এবং তাশরীকের শেষ দিন আসর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। [মাজমুউ ফাতাওয়া,২৪/২৫৩, মুলাখ্খাস আল ফিকহী, ১৩২-১৩৩]
একাধিক সাহাবা থেকে এই তাকবীরের শব্দগুলি প্রমাণিত, তন্মধ্যেঃ
◉ ক-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার কাবীরা। [বায়হাক্বী,৩/৩১৬, ফাতহুল বারী, ২/৪৬২]
◉ খ-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ। [মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা (৫৬৩৩)]
◉ গ- আল্লাহু আকবার কাবীরা, আল্লাহু আকবার কাবীরা, আল্লাহু আকবার ওয়া আজাল্ল, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। [মুসান্নাফ নং (৫৬৪৬)]
এই দশকে ইবনু উমার ও আবু হুরাইরা (রাযিঃ) বাজারে বের হতেন, তারা তাকবীর দিতেন এবং অন্য লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীর পড়তেন। [বুখারী, ঈদাইন অধ্যায়, তা’লীকান]
আজ আমাদের সমাজে এই সুন্নাহ মৃতপ্রায়। আমাদের এই সুন্নাহ পুনর্জীবিত করার সচেষ্ট হওয়া উচিৎ।
◈ ৫-যে ব্যক্তি কুরবানী করার নিয়ত করেছে এবং যিল হজ্জ মাসের চাঁদ দেখা দিয়েছে এমন ব্যক্তির কুরবানী না করা পর্যন্ত চুল, চামড়া ও নোখ কাটা থেকে বিরত না থাকা:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
“যখন (যিল হজ্জ মাসের) দশক শুরু হবে এবং তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করবে, তখন সে যেন তার চুল, চামড়া ও নোখের কোনো কিছু না কাটে”। [মুসলিম, আযাহী অধ্যায়, নং ১৯৭৭]
তাই যে ভাই কুরবানী করতে চায়, সে যেন উপরে বর্ণিত কোনো কিছু না কাটে। কিন্তু যে নিজে কুরবানীদাতা নয় বরং তার পক্ষ থেকে বাড়ির গার্জিয়ান দেয়, যেমন ধরুন পরিবারের সদস্যরা তাহলে তারাও কি উপরের আদেশের অন্তর্ভুক্ত? শাইখ ইবনে উসায়মীন (রাহেঃ) মনে করেনঃ উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা কেবল তার জন্য যে স্বয়ং কুরবানী দাতা আর যাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় তাদের উপর সে সব কর্তন করা অবৈধ নয়। তিনি মনে করেনঃ হাদীসে নিষেধাজ্ঞা স্বরূপ যেই সম্বোধন রয়েছে তা দ্বারা কেবল তাকে বুঝানো হয়েছে, যে প্রকৃতপক্ষে কুরবানীদাতা আর যাদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়া হয়, তারা এই সম্বোধনের অন্তর্ভুক্ত নয়। [শারহুল মুমতি, ৭/৪৮৬-৪৮৭]
আবার এমনও লোক দেখা যায়, যারা কুরবানী করতে ইচ্ছুক তাই এই দশকে দাড়ি কাটে না কিন্তু কুরবানী করার পর দাড়ি কেটে ফেলে। এমন লোকের জানা উচিৎ যে, দাড়ি সব সময় রাখাই হচ্ছে মুমিনের কর্তব্য। তা এই দশকে রেখে সওয়াব পাওয়ার আশা করা অযৌক্তিক। অতঃপর কুরবানীর সাথে সাথে দাড়ির কুরবানী একটি শরীয়ত গর্হিত কাজ।
◈ ৬-এই দশকে রক্ত প্রবাহ করা বা রক্ত দেখা নিষেধ মনে করা:
কিছু সমাজে এমনও ধারণা আছে যে, যিল হজ্জ মাসের চাঁদ উঠলে কোনো পশু যবাই করা যাবে না বা রক্ত দেখা যাবে না; যতক্ষণ কুরবানী না দেওয়া হয়। এই কারণে সেই সময় তাদের বাড়িতে মেহমান আসলে তারা মুরগী, ছাগল, গরু ইত্যাদি জবেহ করে মেহমানের আপ্যায়ন না করে গোশত ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা আপ্যায়ন করে থাকে। মনে রাখা উচিৎ, হালাল পশু-পাখি সাধারণ লোকদের জন্য সব সময় হালাল। এই দশকে রক্ত প্রবাহ করা যাবে না-মর্মে শরীয়ায় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আর শরীয়া যা নিষেধ করে নি তা নিষেধ মনে করাও নিষেধ।
◈ ৭-গরু বা উটে ভাগে কুরবানী করাকে সফরের সাথে নির্দিষ্ট মনে করাঃ
উট ও গরুতে শরীক হয়ে কুরবানী দেওয়া প্রমাণিত।
عن جابر بن عبد الله، قال: حججنا مع رسول الله صلى الله عليه و سلم، فنحرنا البعير عن سبعة، والبقرة عن سبعة. رواه مسلم
আবদুল্লার পুত্র জাবির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হজ্জ করলাম। অতঃপর সাত জনের পক্ষে একটি উট নহর করলাম এবং সাত জনের পক্ষে একটি গাভী। [মুসলিম, অধ্যায়, হাজ্জ, অনুচ্ছেদ নং ৬২, হাদীস নং ৩৫১]
কিন্তু এই রকম ভাগে কুরবানী দেওয়াটা কেবল সফরের সাথে নির্দিষ্ট আর মুকীম অর্থাৎ নিজ বাসস্থানে অবস্থানকারীরা ভাগে কুরবানী দিতে পারে না মনে করা একটি ভুল ফতোয়া। এমন পার্থক্য না তো হাদীস থেকে বুঝা যায় আর না কোনো সালাফ এমন বলেছেন আর না মুহাদ্দিস ও ফুকাহাগণ করেছেন। তাই এই বিষয়ে এমন পার্থক্য করা একটি অভিনব ও সালাফদের জ্ঞান ও বুঝের বিপরীত ফতোয়া। ফুকাহাদের মধ্যে কেবল লাইস এমন মন্তব্য করলে ইবনু হাযম বলেনঃ ‘এবং লাইস সফরে কুরবানীতে শরীক হওয়া বৈধ মনে করেন। আর এটা এমন তাখসীস/নির্দিষ্টকরণ যার কোন অর্থ হয় না’। [আল্ মুহাল্লা,৪/৩৮১]
প্রকাশ থাকে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যাবতীয় কথা ও কাজ আম তথা ব্যাপক অর্থ বহন করে, যতক্ষণ তা কোনো কিছুর সাথে নির্দিষ্ট না করা হয়।
এটা প্রমাণিত যে, ইসলামে মুসাফিরের জন্য কিছু বিধানে কতিপয় ছাড় ও সুবিধা রয়েছে, যেমন সফর অবস্থায় নামায কসর করা, জুমআর নামায ফরজ না হওয়া, রোযা ছেড়ে দেয়া, মোজার উপর মাসাহ করার সময়-সীমা মুকীমের তুলনায় বেশী থাকা ইত্যাদি। এ জাতীয় যে সব বিষয়ে মুসাফিরের জন্য বিশেষ ছাড় রয়েছে তা আমাদের পূর্ববর্তী উলামা ও ফকীহগণ বর্ণনা করে গেছেন কিন্তু তারা কেউই ভাগা কুরবানীকে সফরের বিধানের মধ্যে উল্লেখ করেন নি আর না এমন বলেছেন যে, মুসাফিরদের জন্য ছাড় হল যে, তারা ভাগা কুরবানী দিতে পারে।
◈ ৮-উট কিংবা গরু কুরবানী দেওয়ার সময় সাত ভাগের কোনো ভাগে আক্বীকা উদ্দেশ্য করা:
আক্বীকা একটি এমন ইবাদত, যার সময় নির্ধারিত আর তা হচ্ছে বাচ্চার জন্মের সপ্তম দিন। আর এক হাসান হাদীস অনুযায়ী সাত তারিখে না পারলে ১৪ তারিখে আর তাতেও সম্ভব না হলে ২১ তারিখে। [স্বাহীহুল জামি আস্ স্বগীর ৪০১১] এই ভাবে কুরবানীর সময়ও নির্ধারিত আর তা হল, যিল হজ্জ মাসের ১০ তারিখ এবং ১১, ১২ ও ১৩ তরিখ। যে সব ইবাদত বিশেষ দিন ও তারিখের সাথে সম্পর্কিত তা অন্য দিনে করলে বিদআত ও অগ্রহণীয় বিবেচিত হবে। তাই উপরোক্ত তারিখ ছাড়া অন্য দিনে কুরবানী দিলে কুরবানী হবে না; কারণ কুরবানীর দিন তারিখ শরীয়া কর্তৃক নির্ধারিত। এই ভাবে আক্বীকার দিন-তারিখও নির্ধারিত, তাহলে তা সেই সময়ে না করলে অন্য দিনে করলে কি ভাবে কবুল হতে পারে? শরীয়ত কি কারণ ছাড়াই সেই সময় নির্ধারণ করেছেন? অন্যদিকে যারা সেই নির্ধারিত সময়ে আক্বীকা না দিয়ে কুরবানীর দিনে কুরবানীর ভাগে আক্বীকা দেয়, তারা তাদের সন্তানের আক্বীকা দিতে আন্তরিক তো, না সুযোগের অপব্যবহার করে, কোনোরূপে দায়ভার থেকে মুক্তির চেষ্টা করে?
যারা এই বলে কুরবানীর ভাগায় আক্বীকা দেওয়ার পক্ষপাতী যে, দুটিই নৈকট্যের কাজ তাই একত্রে দেওয়া যায়। তাদের মনে রাখা উচিৎ যে, এমন মন্তব্য দলীলের মুকাবিলায় একটি কিয়াস/অনুমান, যা পরিত্যাজ্য এবং এটাও মনে রাখা উচিৎ যে, কোনও কাজ শুধু নৈকট্যের হলেই গ্রহণীয় হয় না যতক্ষণে তা নবীর তরীকায় সম্পাদন না করা হয়। আর কুরবানীর সাথে আক্বীকা দেওয়া নবীর তরীকা নয়।
◈ ৯-এমন মনে করা যে, একটি ছাগল কিংবা একটি ভেড়ার কুরবানী কেবল এক জনের পক্ষ থেকে হয়; একটি পরিবারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হয় না:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ছাগল কুরবানী দিয়েছেন এবং সাহাবাগণও একটি ছাগল নিজ ও নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে যবাই করতেন, তাতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা যাই হোক না কেন। আবু আইয়্যুব আনসারী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে মানুষ তার ও তার বাড়ির সদস্যদের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানী করতেন, নিজে খেতেন এবং অপরকে খাওয়াতেন’। [তিরমিযী, আযাহী অধ্যায়, নং (১৫০৫)/ইবনু মাজাহ]
উল্লেখ্য যে, সবচেয়ে উত্তম কুরবানী হচ্ছে, একটি পূর্ণ উটের কুরবানী অতঃপর একটি পূর্ণ গরুর কুরবানী অতঃপর একটি পূর্ণ ছাগল কিংবা ভেড়ার কুরবানী অতঃপর উট কিংবা গরুর এক অংশের কুরবানী। [মুগনী ১৩/৩৬৬]
◈ ১০-মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা:
এই প্রসঙ্গটির কয়েকটি দিক রয়েছেঃ
◆ ক- কোনো মৃতের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্ররূপে একটি আলাদাই কুরবানী দেওয়া। যেমন, একটি ছাগল বা গরু বা গরু কিংবা উটের কোনো বিশেষ এক-দুই ভাগ মৃতের জন্য দেয়া। মৃতের জন্য এমন স্বতন্ত্র কুরবানী বৈধ নয়। সত্যিকারে কুরবানীর সুন্নতটি জীবিতদের জন্য এটা মৃতদের জন্য নয়। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মৃত প্রিয়া স্ত্রী খাদীজা (রাযিঃ), তাঁর মৃত প্রিয় চাচা হামযা (রাযিঃ) এবং মৃত প্রিয় সন্তানাদির কারোর পক্ষ থেকে কুরবানী দেন নি। বরং তিনি নিজের ও নিজ পরিবারে পক্ষ থেকে কুরবানী দিতেন।
◆ খ-এমন ব্যক্তি যে কাউকে মৃত্যুর পূর্বে অসীয়ত করে যায় যে, সে মারা গেলে তার পক্ষ থেকে যেন সে কুরবানী দেয়, তাহলে সেই মৃত ব্যক্তির অসীয়ত অনুযায়ী এবং তার অসীয়ত বাস্তবায়নে কুরবানী করা বৈধ। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “অতঃপর যে ব্যক্তি তা শুনার পর অসীয়তে পরিবর্তন ঘটাবে, তবে তার গুনাহ তাদেরই উপর বর্তাবে, যারা তার পরিবর্তন ঘটাবে।” [সূরা বাক্বারা/১৮১]
আলী (রাযীঃ) হতে প্রমাণিত রয়েছে যে, তিনি দুটি ভেড়া কুরবানী দেন এবং বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অসীয়ত করে গেছেন যেন আমি তার পক্ষ থেকে কুরবানী দেই, তাই আমি তার পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়ে থাকি”। [আবু দাঊদ, তিরমিযী, হাদীটিকে শাইখ আলবানী যয়ীফ বলেছেন]
◆ গ-জীবিতদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়ার সময় পরিবারের মৃতদেরও সওয়াবে ভাগিদার করার নিয়ত করা। এমন করা একটি বিতর্কিত বিষয়। কেউ এটাকে বৈধ বলেন আর কেউ অবৈধ। বৈধতার পক্ষে দলীল হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানী দিতেন ও বলতেনঃ “হে আল্লাহ! এটা মুহাম্মদের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মদের পরিবারের পক্ষ থেকে”। [মুসলিম] অথচ পরিবারের অনেকেই ইতিপূর্বে মৃত্যু বরণ করেছিল। আর যারা অবৈধ মনে করেন, তাদের নিকট দলীলটি স্পষ্ট নয় এবং তার পরে খুলাফায়ে রাশেদীন থেকে এমন করা প্রমাণিত নয়। [শারহুল মুমতি ৭/৪৭৯-৪৮০]
◈ ১১-কুরবানীর সময় শুধু ১০ম যিল হজ্জকে মনে করাঃ
কুরবানীর সময় ১০ম যিল হজ্জে ঈদের নামায সমাপ্ত হলে শুরু হয় এবং তাশরীকের শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ ই যিল হজ্জের সূর্যাস্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। যদিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ম তারিখেই কুরবানী করতেন কিন্তু তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এও বলেছেনঃ “এবং তাশরীকের সমস্ত দিন কুরবানীর দিন”। [আহমদ, স্বহীহুল জামি, আলবানী নং ৪৫৩৭]
তাই কোনো ব্যক্তি যদি ১০ম যিল হজ্জে কোনো কারণে কুরবানী না করতে পারে তাহলে, তাশরীকের যে কোনো দিনে কুরবানী করতে পারে।
◈ ১২-কুরবানীর পশু ক্রয় করার পর যদি তা দোষ যুক্ত হয়ে যায় (যেমন লেংড়া হয়ে যায়, কানা হয়ে যায়..) কিংবা মারা যায় কিংবা হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়, তাহলে তার পরিবর্তে কুরবানী দেওয়া জরুরি মনে করা:
উপরের বিষয়গুলি যদি কুরবানীদাতার অবহেলায় ও তার কারণে ঘটে। যেমন সেই পশুকে এমন ভাবে প্রহার করেছে যে, পা ভেঙ্গে গেছে বা চোখ অন্ধ হয়ে গেছে কিংবা খোলা মাঠে ছেড়ে রেখেছে তাই হারিয়ে গেছে কিংবা যেখানে মানুষ রাতে পশু রাখে সেখানে না রেখে গোয়াল ঘরের বাইরে খোলা স্থানে বেঁধে রাখার কারণে চুরি হয়ে গেছে কিংবা এমন উঁচু স্থানে বেঁধে রেখেছে যেখান থেকে পড়ার আশংকা ছিল, তাই পড়ে মারা গেছে , তাহলে তাকে তার পরিবর্তে অন্য কুরবানী দেওয়া জরুরি। আর যদি তা তার অবহেলায় না ঘটে বরং সে দোষ হীন পশু ক্রয় করেছিল কিন্তু ক্রয় করার পর দোষ যুক্ত হয়েছে, তাহলে তার উপর এর বদলে অন্য কুরবানী জরুরি নয়, সেটা দিলেই যথেষ্ট হবে। এই পার্থক্যের কারণ হল, কোনও পশু যখন কুরবানীর নিয়তে ক্রয় করা হয়, তখন সেটা কুরবানী করা পর্যন্ত তার কাছে আমানত হিসাবে থাকে। আর আমানতের বিধান হল, যদি আমানতদার নিজ অবহেলায় আমানত নষ্ট করে তাহলে তার উপর জামানত/দণ্ড জরুরি হয়। আর যদি তার অবহেলায় তা নষ্ট না হয়, তাহলে তার উপর দণ্ড জরুরি হয় না। [আল মুগনী,১৩/৩৭৩, শারহুল মুমতি,৭/৪৭৫-৪৭৬]
◈ ১৩-অমুসলিমকে কুরবানীর গোশত দেওয়া অবৈধ বা অপছন্দ মনে করাঃ
অমুসলিমকে তার অভাবের কারণে, প্রতিবেশী হওয়ার কারণে এমনকি তার মন জয় করার উদ্দেশ্যে তাকে কুরবানীর গোশত দান করা বা সাদাকা করা বৈধ। হ্যাঁ, তবে সে যদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হয়, তাহলে তার বিধান ভিন্ন। [সউদী স্থায়ী উলামা পরিষদের ফতোয়া ১১/৪২৪]
◈ ১৪-জেনে-বুঝে দোষ যুক্ত পশু ক্রয় করাঃ
চার প্রকার দোষ ওয়ালা পশুর কুরবানী বৈধ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “ চার প্রকার (দোষ থাকলে) কুরবানীতে বৈধ নয় –অন্য বর্ণনার শব্দে এসেছে যথেষ্ট নয় – স্পষ্ট টেরা, স্পষ্ট রোগা, স্পষ্ট খোঁড়া, অতি দুর্বল (অতি বয়সের কারণে মজ্জাহীন হাড় ওয়ালা) [আবু দাঊদ নং ২৮০২, তিরমিযী নং ১৪৯৭, নাসাঈ ৪৩৬৯]
এই দলীলের আলোকে এটাও বুঝা যায় যে, যেই পশুর দোষ এর থেকেও বেশী ও বড় সেসব পশুর কুরবানীও নাজায়েয। যেমন অন্ধ, পা ভাঙ্গা, চলতে অক্ষম ইত্যাদি।
উপরোক্ত দলীলের আলোকে এটাও বুঝা যায় যে, বর্ণিত দোষ থেকে নিম্ন পর্যায়ের দোষ থাকলে তার কুরবানী বৈধ কিন্তু উত্তম নয়। যেমন কান কাটা, শিং ভাঙ্গা, লেজ কাটা, চামড়া কাটা পশু। এমন দোষ থাকলে তা কুরবানীতে মাকরূহ।
এর পরেও অনেককে দেখা যায়, কিছু মানুষ স্পষ্ট খোঁড়া বা একেবারে বয়স্ক পশু কুরবানীর জন্য খরীদ করে!
◈ ১৫-কুরবানী জবাই করা সংক্রান্ত ভুল সমূহঃ
নিজে যবাই না করে অন্যের মাধ্যমে যবাই করা; অথচ কুরবানী একটি ইবাদত আর ইবাদত নিজে করা বেশী ভাল। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে কুরবানী করতেন। তবে কেউ যদি যবাই করতে ভয় পায় বা ছুরি চালাতে না জনে তাহলে তার বিধান ভিন্ন।
অযু ছাড়া যবাই না করা; অথচ যবাই করার জন্য অযু না তো জরুরি আর না মুস্তাহাব। তাই যবাইয়ের উদ্দেশ্যে অযু জরুরি বা মুস্তাহাব মনে করা বিদআহ। [সউদী স্থায়ী ফতোয়া কমিটি, ১১/৪৩৩-৪৩৫]
কুরবানীর পশুর সামনে ছুরি-চাকু ধার দেওয়া, পশুর সামনে উন্মুক্ত ভাবে তা ধারণ করা, এক অপরের সামনে যবাই করা, যবাই করার পর নিস্তেজ না হতেই চামড়া ছাড়ানো শুরু করা এবং নির্মম ভাবে যবাই করা মারূহ। [হাকেম, ত্বাবারানী, আহমদ, ইবনু মাজাহ (৩১৭২)]
অন্যের কুরবানী যবাই করার সময় তাঁদের নাম লেখা ও তা কুরবানীর পশু যবাই করার পূর্বে পড়া জরুরি মনে করা। যেমন, বলা যে এই গরুতে ৭ জনের নাম দেন। মনে রাখা উচিৎ, যে বা যারা কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশুটি ক্রয় করেছে এবং যত ভাগ কুরবানী দেয়ার নিয়ত করেছে, তার সেই নিয়ত অনুযায়ী সে বদলা পাবে এবং তার নিয়ত আল্লাহ অবশ্যই জানেন।
এখন অন্য কোনো ব্যক্তি যদি তাদের কুরবানীটা যবাই করে দেয়, তাহলে সে শুধু কুরবানীদাতার পক্ষ থেকে যবাই করার কাজের প্রতিনিধি মাত্র। বিদায় হজ্জে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রকম ষাটাধিক সাহাবীর কুরবানী করেছিলেন, তাতে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নাম জিজ্ঞেস করেন নি যে, এটা কার কার পক্ষ থেকে, এই উটে তোমরা কতজন শরীক রয়েছো, নাম উল্লেখ কর, ইত্যাদি। বরং তিনি সাধারণ ভাবে যবাই করে গেছেন। তবে এটাও প্রমাণিত যে, তিনি অনেক ক্ষেত্রে যবাই করার পর বলতেনঃ “এটা আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের মধ্যে তাদের পক্ষ থেকে যারা কুরবানী দেয় নি”। [আহমদ, আবু দাঊদ, তিরমিযী] তাই যার কুরবানী অন্য যবাই করছে, সে যবাই দেয়ার সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবারের পর তার নাম বলতে পারে যে এটা অমুক বা অমুক অমুকের পক্ষ থেকে। কিন্তু যবাই করার পূর্বে তা বলার নিয়ম নেই।
কুরবানী দাতা সে একটি পূর্ণ পশু কুরবানী দিক বা ভাগা কুরবানী দিক কুরবানী দেওয়ার সময় সে তা নিজ ও পরিবারের সকলের পক্ষ থেকে নিয়ত করবে। অর্থাৎ সেই কুরবানীর সওয়াব সকলে পাক, তা নিয়ত করবে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাগল কুরবানী দেওয়ার পর বলেনঃ “হে আল্লাহ! এটা মুহাম্মদ, মুহাম্মদের পরিবার এবং মুহাম্মদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবূল কর”। [আহমদ, মুসলিম] এখন যারা প্রতি ভাগে একটা করে নাম নেয়, তারা বুঝাতে চায় যে, এটি এক জনের পক্ষ থেকেই হচ্ছে অন্যরা এর সওয়াব পাবে না; অথচ কুরবানীদাতা তার কুরবানীতে নিজ ও নিজ পরিবার সকলের সওয়াব কামনা করবে, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করতেন।
কুরবানীর পশু যবাই করার জন্য বিশেষ কোনো দুআ আছে মনে করা। অথচ সাধারণ পশু যবাই করার সময় যেমন আল্লাহর নাম নেওয়া জরুরি তেমন কুরবানীতেও তাই জরুরি। তাই ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার’ বলে যবাই করলেই হয়ে গেল। যবাই করার পূর্বে (ইন্নী ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া…) বলা ও যবাই শেষে (আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল…) বলা মুস্তাব, জরুরি নয়।
‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার’ বলে পশুর গলার চামড়া কেটে দিয়ে কশাইকে বাকি যবাই সম্পন্ন করতে দেওয়া। এটি আসলে কশাইর মাধ্যমে যবাই করা গণ্য হবে। কারণ শারঈ যবাই তখন হবে যখন, পশুর শ্বাসনালী, খাদ্যনালী ও এর দুই পাশের মোটা রগ দুটি কর্তন করা হবে। আর এখানে যবাইকারী ব্যক্তি শুধু চামড়া কাটে আর প্রকৃতপক্ষে যবাইর কাজ কশাই করে। অন্য দিকে এই সময় কশাই সাধারণতঃ আল্লাহর নাম নেয় না।
কশাইকে কুরবানীর গোশত দেওয়া নিষেধ বলতে কশাইকে কাজের মজুরি স্বরূপ দেওয়া নিষেধ বুঝায়। সে তার মজুরি হিসাবে টাকা কিংবা অন্য কিছু নিতে পারে। কিন্তু কুরবানীর গোশত যেমন অন্যকে দান হিসেবে দেয়া মুস্তাহাব তেমন তাকেও দেওয়া মুস্তাহাব।
কুরবানী যবাই করার পর পশুর রক্ত, গোবর, হাড়, চামড়া প্রভৃতি মাটির উপর যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যাতে দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং মানুষের কষ্ট হয় এমনকি পশুদেরও কষ্ট হয়।
◈ ১৬-কুরবানীর গোশত জরুরি ভিত্তিক তিন ভাগে বিভক্ত করে সমাজকে বিতরণ করতে দেওয়া:
কিছু সমাজে জরুরি ভিত্তিক এমন নিয়ম নির্ধারণ করা হয়েছে যে, তাদের গ্রামে বা সমাজে যারাই কুরবানী দিবে, তাদেরকে অবশ্যই তাদের কুরবানীর গোশত তিন ভাগে বিভক্ত করতে হবে। অতঃপর এক ভাগ যতক্ষণ সামাজে জমা না দেওয়া হয় ততক্ষণ তারা বাড়িতে গোশত নিয়ে যেতে পারবে না বা এই ধরণের অন্য নিয়ম।
◉ প্রথমতঃ শরীয়া কুরবানীর গোশতকে তিন ভাগে বিভক্ত করা জরুরি করে নি। “তোমরা নিজে খাও, অপরকে খাওয়াও এবং জমা রাখ”। [বুখারী, আযাহী, নং ৫৫৬৯] এবং অন্য হাদীস “তোমরা নিজে খাও, জমা রাখ এবং দান কর”। [মুসলিম নং ১৯৭১] এই হাদীসদ্বয়ের মাধ্যমে কুরবানীর গোশতের খাত বুঝা যায়, তা আবশ্যিক ভাবে তিনভাগে বিভক্ত করা বুঝায় না।
◉ দ্বিতীয়তঃ “অপরকে খাওয়াও বা সাদাকা কর” সম্বোধনটি প্রত্যেক কুরবানীদাতাকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছে; সমাজ নেতাদের নয়। তাই কুরবানী দাতা নিজে কুরবানীর গোশতের বণ্টন করবে-এটাই হাদীসের মর্ম। কিন্তু সমাজ বিতরণ করার দায়িত্ব নিলে তাদের জন্য এটা বৈধ; তবে জরুরি নয়।
এই সামাজিক নিয়মের সমস্যা হল, তারা জোরপূর্বক মানুষের কাছ থেকে কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক জমা দেয়ার নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়। অথচ সাদাকা ও দান আল্লাহর উদ্দেশ্যে খাঁটি মনে স্বেচ্ছায় না দিলে কবুল হয় না। অনুরূপ কারও কাছ থেকে কোনো কিছু জোরপূর্বক নেওয়া এবং তা দান করাও নিষেধ। তাই এই নিয়মে সাদাকা কারীর ইখলাস ও আন্তরিকতা থাকে না ‌বরং থাকে সামাজিকতার অবৈধ চাপ।
এই আবশ্যপালনীয় সামাজিক নিয়মের আর একটি সমস্যা হল, সমাজ যখন কুরবানীর গোশত জমা করে বিতরণ করে, তখন বিভিন্ন গ্রামের ফকির-মিসকিন উপস্থিত হয় এবং তাদের ভাগ্যে আসে দু-চার শ গ্রাম গোশত। তাই তাকে সেই দিনে আবারও ভিক্ষা করার ন্যায় ঘুরতে হয় পাঁ দশ গ্রাম। অথচ প্রত্যেক গ্রামে কুরবানীদাতা স্বয়ং যদি তার আশেপাশে বসবাসকারী পরিচিতদের দুই-চার জনকে গোশত বিতরণ করে এই ভাবে অন্যরাও বিতরণ করে তাহলে গ্রামের সকল অভাবীর বাসায় গোশত পৌঁছে যাবে। তাদেরকে সে দিন লজ্জা, কষ্ট, তিরষ্কার মাথায় নিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।
আরো একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে যা আমরা অনেকে অনুভব করি না। তা হল, অনেকে একটি ছাগল বা একটি গরুর ভাগ কুরবানী দেয়। তারা খুব বেশী তো ৮/১০ কেচিরেরে গোশত পায়। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ বা আধা যদি সমাজিক নিয়মের কারণে তাদের দিতে হয়, তাহলে তার কাছে অবশিষ্ট থাকে ৫-৬ কে.জি.। এখন বাড়িতে-৭-৮ জন সদস্য সংখ্যা হলে অনুমান করুন তো তারা দু বেলা তৃপ্তি সহকারে গোশত খেতে পারবে কি? তারা নিজ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের দিতে পারবে কি? তাই এমন বহু লোক ভারাক্রান্ত মনে সমাজের নির্ধারিত অংশ জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে। অথচ এই দিনগুলি পানাহারের দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “তাশরীকের দিনগুলি খান-পান ও আল্লাহর যিকরের দিন”। [মুসলিম, নং ১১৪১] তাই তারা প্রথমে আনন্দ করে খাবে এটা ঈদুল আযহার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। অতঃপর অন্যকেও দিবে। এমন লোক কুরবানী দাতা হলেও তাদের কুরবানীর গোশত হাদিয়া স্বরূপ দেওয়া উচিৎ।
◈ ১৭-কুরবানীর চামড়া বিক্রয় করাঃ
উল্লেখ্য যে, কুরবানীর পশুর সব কিছুই আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তাই তার কোনো অংশ বিক্রয় নিষেধ। যেমন তার গোশত বিক্রয় নিষেধ তেমন তার চামড়া বিক্রি করাও নিষেধ। আলী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা কুরবানীর উটের দায়িত্ব দেন এবং আদেশ করেন, যেন আমি সেই উটের গোশত, চামড়া, পরিধেয়, সাদাকা/দান করে দেই এবং কশাইকে তা থেকে কিছু না দেই”। [মুসলিম নং ১৩১৭]
তাই স্বয়ং কুরবানীদাতা কুরবানীর চামড়া দ্বারা উপকৃত হবে কিংবা ফকীর মিসকীনকে দান করে দিবে কিংবা কাউকে হাদিয়া করে দিবে। এটাই হবে চামড়ার সঠিক খাদ। কিন্তু যদি সমাজের অবস্থা এমন হয় যে, স্বয়ং কুরবানী দাতা তা ব্যবহার করতে জানে না কিংবা ফকীর মিসকীনরাও চামড়া নেয় না, তাহলে কি করণীয়? এমতাবস্থায় কুরবানীর চামড়া নষ্ট না করে যদি তা বিক্রয় করে অন্যকে দান করা হয়, তাহলে এটা প্রয়োজনার্থে ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৈধ হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ যার মূল্য রয়েছে তা একেবারে নষ্ট করে দেয়ার চাইতে উপকৃত হওয়া ভাল। তাছাড়া এই ক্ষেত্রে কুরবানীদাতা স্বয়ং সেই চামড়ার মূল্য ভক্ষণকারী নয়; বরং সে সেই মূল্য সাদাকাকারী। হাসান, নাখঈ, আওযায়ী এবং ইমাম আবু হানীফা (রাহেঃ) কুরবানীর চামড়া বিক্রয় করার পক্ষে মত দিয়েছেন এবং ইবনে উমার (রাযিঃ) এর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি চামড়া বিক্রি করতেন এবং তার মূল্য সাদাকা করতেন। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ ১৩/৩৮২]
উল্লেখ্য যে, কুরবানীর চামড়ার মূল্যের খাত ব্যাপক। কারণ তা সাধারণ সাদাকার অন্তর্ভূক্ত। তাই তা ফকির, মিসকিনকে দেয়া সহ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় যে কোনও সওয়াবের খাতে ব্যবহার করা যাবে। [আল্লাহই ভাল জানেন]

Thursday, February 4, 2021

অন্যের ব্যাপারে সুধারনা করুন

 রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-


অনুবাদ: মোঃ মুনিমুল হক    |    সম্পাদনা: ‘আব্‌দ আল-আহাদ | প্রকাশনায়ঃ কুরআনের আলো ওয়েবসাইট | ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ ইবনে গাফফার

অন্যের কল্যাণ কামনা করার মতো হৃদয়ের প্রশান্তি দায়ক ও সুখকর অনুভূতি আর নেই। অন্যের ব্যাপারে কুধারনা করলে বা তাদের ব্যাপারে অকল্যাণ কামনা করলে এক ধরনের মানসিক চাপ এবং তার দরুন শারীরিক ক্ষতির আশংকা থাকে। কিন্তু মনের মধ্যে অন্যের কল্যাণ এবং মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা থাকলে আমাদেরকে সেই মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে পারি।

অন্যের জন্য শুভকামনা হৃদয়কে সুন্দর করে; সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনকে করে দৃঢ়; অন্তরকে রাখে প্রসন্ন ও হিংসার কালিমামুক্ত। নবী করীম (সা) বলেন:
“অনুমান করা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ অনুমান হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা। আর বেঁচে থাকো অন্যের দোষ খোঁজা থেকে, এবং অন্যের উপর গোয়েন্দাগিরি করা থেকে, বেঁচে থাকো (মন্দ কাজে) প্রতিযোগিতা করা থেকে, বেঁচে থাক অপরের হিংসা করা থেকে, অপরকে ঘৃণা করা থেকে এবং একে অপরকে পরিহার করা থেকে; এমনভাবে থাকো যেন তোমরা পরস্পর ভাই এবং আল্লাহ্‌র দাস”।  [আল-বুখারী; খণ্ড ৮, অধ্যায় ৭৩, হাদীস নং ৯২]
আমরা মুসলমানরা যদি এই হাদীসের শিক্ষা মেনে চলতাম, তবে আমাদের শত্রুরা কখনোই তাদের কুখ্যাত “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের বিভক্ত করতে সক্ষম হতো না।

অন্যের জন্য দো‘আ করা

বিভিন্নভাবে অন্যের মঙ্গলকামনা করা যায়। সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো একে অপরের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দো‘আ করা। নাবী করীম (সাঃ) সর্বদা তার উম্মতের জন্য আল্লাহ্‌র নিকট দো‘আ করতেন।

নিজেকে অন্যের পরিস্থিতিতে কল্পনা করা

অন্যের কথা ও কাজ সম্পর্কে কোনো কিছু ভাবার আগে আমরা যদি নিজেকে অন্যের জায়গায় বা পরিস্থিতিতে কল্পনা করি, তার জায়গায় আমি হলে কী করতাম সেটা ভাবি, তবে খারাপ পরিস্থিতিতেও অন্যের সম্পর্কে ভালো চিন্তা করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। কোরআন আল-কারীমে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন:
“তোমরা যখন একথা [‘আয়েশার (রা) বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা] শুনলে, তখন ঈমানদার পুরুষ ও নারীগণ কেন নিজেদের লোক সম্পর্কে উত্তম ধারণা করনি এবং বলনি যে, এটা তো নির্জলা অপবাদ?” [সূরা আন-নূর, ২৪:১২]

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বিশ্বাসীদের এমনভাবে সম্বোধন করছেন, যেন তারা এক অভিন্ন সত্তা। তাই তারা যখন তাদের ভাইদের সাথে মিলিত হয় এবং সালাম জানায় এটা অনেকটা এরূপ যেন তাদের নিজেদেরকেই সালাম জানালো তারা:
“অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করো, তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া।” [সূরা আন-নূর, ২৪:৬১]

অন্যের কথার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা করা
অন্যের কথাকে সর্বোত্তম উপায়ে ব্যাখ্যা করাটা হলো মু’মিনদের অন্যতম গুণ। ‘উমার (রা) বলেন,
“তোমার বিশ্বাসী ভাইয়ের কোনো কথাকে খারাপ অর্থে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভালো অর্থে নেওয়ার সুযোগ থাকে।”

ইমাম আশ-শাফে‘ঈ (রহ) অসুস্থ থাকাকালীন একদিন তার ভাইয়েরা তাকে দেখতে আসলো। তাদের একজন বলল, “আল্লাহ্‌ আপনার অসুস্থতা/দুর্বলতাকে আরো শক্তিশালী করে দিন। [যদিও সে বুঝাতে চেয়েছিল যে, আল্লাহ্‌ যেন তার দুর্বলতাকে কমিয়ে দেন]”
আর ভালো অর্থে নেবার সুযোগ না থাকলেও অন্যের ভালো কামনা করাই হলো সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচায়ক।

আশ-শাফে‘ঈ (রহ) বললেন, “আল্লাহ্‌ যদি আমার দুর্বলতাকে আরও শক্তিশালী করেন (বাড়িয়ে), তবে তো আমি মরেই যাব।”
তখন লোকটি বলল, “আল্লাহ্‌র কসম! আপনার ভালো হোক, আমি সেটাই চেয়েছিলাম।”
আশ-শাফে‘ঈ (রহ) বললেন, “যদিও তুমি আমাকে আহত করেছ, আমি জানি যে, আমার ভালো হোক সেটাই তুমি চেয়েছ।”
এভাবে অপরের কথাকে ভালো অর্থে নেওয়াই হলো সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ববোধের লক্ষণ। যদিও অনেক সময় এমন অনেক কথাই থাকে যার ভালো কোনো অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ থাকে না।

অন্যের বিরূপ মন্তব্য বা কাজের কারণ খুঁজে বের করা
কেউ যখন কথা বা কাজের মাধ্যমে অন্যকে বিরক্ত করে বা কষ্ট দিয়ে বসে, তখন আক্রান্ত ব্যক্তির উচিৎ তার সেই রকম ব্যবহারের এমন কোনো কারণ খোঁজার চেষ্টা করা, যাতে করে সেই ব্যক্তির উপর তার রাগ না থাকে বা তার সম্পর্কে ভালো চিন্তা করা যায়। এটাই হলো মু’মিনদের গুণ। মু’মিন ব্যক্তি এমন যে, অন্যের সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা করার আগে বা অন্যকে খারাপ বলার আগে, তার সম্পর্কে অন্ততপক্ষে ৭০টা ভালো কিছু ভাবার চেষ্টা করবে।
ইবনে সিরিন (রহ) বলেন,
“তুমি যদি জানতে পারো যে, কেউ তার কথা বা কাজের মাধ্যমে তোমার ক্ষতি করেছে, তাহলে তোমার উচিৎ সে কেন এমন করল তার উপযুক্ত কারণ খুঁজে বের করা; যদি কোনো কারণই খুঁজে না পাও, তবে তোমার বলা উচিৎ, ‘হয়তো এমন কোনো কারণ ছিল যা আমি জানি না।’ ’’

যদি আমরা অন্যের (কথা বা কাজের)  ভালো দিকটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, তবে তা আমাদের অন্যের ব্যাপারে অনুমানভিত্তিক খারাপ ধারণা করার মতো পাপ থেকে বেঁচে থাকব।

অন্যের উদ্দেশ্য নিয়ে অমূলক ধারণা থেকে বেঁচে থাকা
অন্যের ভালো দিক সম্পর্কে ভাবতে হলে কোনো কথা বা কাজের পিছনে অন্যের উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে ধারণা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা মনের উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহ্‌ জানবেন।; একমাত্র তিনিই তার বিচার করবেন। তাই আরেকজনের মনে কী আছে না আছে তা নিয়ে গবেষণা করা আমাদের জন্য শোভনীয় নয়। অন্যের উদ্দেশ্য কী সে ব্যাপারে অমূলক সন্দেহ করা থেকে বাঁচতে হবে আমাদের।

অন্যের খারাপ দিক ভাবার কুফল সম্পর্কে সজাগ থাকা
যে সারাক্ষণ অন্যের মন্দ বিষয় নিয়ে ভাবে বা অনুসন্ধান করে, তার মনে অশান্তি লেগেই থাকে। কেননা, এমনটি করার ফলে সে দিনদিন তার আপনজন ও বন্ধুবান্ধবদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। কারও অনিচ্ছাকৃত ভুল হতেই পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা অনেকেই নিজের ভালো আর অন্যের খারাপটা নিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত। এ ব্যপারে কোরআন আল-কারীমে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন:
“অতএব, তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। তিনি ভালো জানেন কে সংযমী।” [সূরা আন-নাজম, ৫৩:৩২]

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্‌ ইহুদীদের (যারা নিজেদের পূত-পবিত্র ঘোষণা করেছিল) সম্পর্কে বলেন:
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা নিজেদেরকে পূত-পবিত্র বলে থাকে, অথচ পবিত্র করেন আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা তাকেই? বস্তুতঃ তাদের উপর সুতা পরিমাণ অন্যায়ও হবে না।  [সূরা আন নিসা, ৪:৪৯]

তবে চাইলেই অন্যের ভালো ভাবা যায় না, এর জন্য দরকার সচেতনভাবে নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে অন্যের ভালো দিক নিয়ে ভাবার অভ্যাস তৈরি করা। নিজের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। কেননা, শয়তান সারাক্ষণ আমাদের পিছে লেগে থেকে যেন আমরা অন্যের ব্যাপারে খারাপ ভাবি; এভাবে সে যখনই সুযোগ পায়, কুপ্ররোচনার মাধ্যমে আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে দেয়। তাই সবসময় আগে অপরের ভালোদিকটি চিন্তা করার মাধ্যমে শয়তানের প্ররোচনা থেকে দূরে রাখতে হবে নিজেদের। আল্লাহ্‌ আমাদের সকলকে অপর মুসলিম ভাই এবং বোনদের ভালোদিকটি চিন্তা করার মাধ্যমে একটি সুন্দর এবং সুস্থ হৃদয়ের অধিকারী হবার তৌফিক দান করুন!

Monday, November 30, 2020

ইসলামে রসিকতা

 প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না

রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

লেখক : আখতারুজ্জামান মুহাম্মদ সুলাইমান, ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানুষের জীবনাচারের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে তাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে মিশে আছে হাসি-তামাশা ও আনন্দ-রসিকতা। এ ক্রিড়া-কৌতুক ও আনন্দ-রসিকতা  মানুষের জীবনে বয়ে আনে এক অনাবিল প্রান চাঞ্চল্য ও উদ্যমতা। মানুষকে করে ঘনিষ্ঠ। তাদের আবদ্ধ করে এক অকৃত্রিম ভালবাসার মায়াডোরে। আনন্দ-রসিকতার এ মহোময় ক্রিয়াটি সম্পাদিত হয় সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব, সাথী-সঙ্গী, নিজ সন্তানাদি ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মাঝে।বরং কোন মানুষই এ আনন্দঘন কর্ম থেকে মুক্ত নয়। তবে কেউ কম আর কেউ বেশি।

আল্লাহ তাআলার বান্দা হিসাবে আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্বকে সাজাতে হবে মহান আল্লাহ তাআলার নির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী। যাতে আমাদের মধ্যে আল্লাহ তাআলার উবূদিয়্যত (দাসত্ব) পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয়। বর্তমানে মানুষের মাঝে হাসি-তামাশার প্রচলন একটু বেশি।তাই তার ধরণ-প্রকৃতি, হুকুম ও প্রকার এবং এ বিষয়ে শরয়ী দৃষ্টিকোণ কি সে সম্পর্কে জানা আবশ্যক হয়ে দাড়িয়েছে। যাতে মুসলমানরা সেগুলো মেনে চলতে পারে ও একঘেয়েমি দূরকারী এ সুন্দর পদ্ধতি পরিত্যাগ করতে না হয়। এবং এর শরয়ী দিকনির্দেশনা অবলম্বন করে যেন পুণ্য অর্জন করতে পারে পাশাপাশি নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখতে পারে।

 রসিকতা তিন প্রকার:

 (১) অনুমোদিত এবং প্রশংসাযোগ্য রসিকতা : আর সেটি হচ্ছে, যা ভাল উদ্দেশ্যে, সৎ নিয়তে এবং শরয়ী নিয়ম নীতি অবলম্বন করে সম্পাদন করা হয়। যেমন মাতা-পিতার সাথে আদবের সহিত রসিকতা করা অথবা স্ত্রী, সন্তানদের সাথে, অনুরূপ বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তাদের অন্তরে আনন্দ-খুশির উপস্থিতির জন্য রসিকতা করা। এগুলির দ্বারা রসিকতাকারীর পুণ্য লাভ হয়।

 এই প্রকার রসিকতার অনুমোদনে প্রমাণাদি :

ক) হানযালাহ রা. এর হাদীস এ আছে তিনি বলেন : হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হানযালাহ মুনাফেক হয়ে গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: কীভাবে? আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমরা যখন আপনার কাছে থাকি আর  আপনি আমাদেরকে বেহশত-দোযখের কথা স্মরণ করান, মনে হয় যেন চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি। যখন আপনার নিকট থেকে চলে যাই আর আমাদের স্ত্রী সন্তান সন্ততি এবং বিভিন্ন সাংসারিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তখন এর অনেক কিছুই ভুলে যাই। তখন  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন যার হাতে আমার জান তার শপথ: আমার নিকট থাকা কালীন সময়ে তোমাদের অবস্থা যেমন হয় যদি তোমরা সর্বদা ঐ অবস্থায় থাকতে এবং জিকিরের সাথে পূর্ণসময় অতিবাহিত করত, তাহলে অবশ্যই ফেরেশতারা তোমাদের বিছানায় ও চলার রাস্তায় তোমাদের সাথে করমর্দন করত। কিন্তু হে হানযালাহ কিছু সময় এভাবে কিছু সময় ঐ ভাবে। কথাটি তিনবার বললেন। [মুসলিমঃ৪৯৩৭]

 খ) যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. এর হাদীসে এসেছে: খন যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বিবাহ করলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন: হে যাবের তুমি কি বিবাহ করেছ? আমি বললাম: হ্যাঁ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: কুমারী না বিধবা? আমি বললাম: বিধবা। রাসূলুল্লাহ বললেন: তুমি কুমারী মেয়ে বিবাহ করলে না কেন?  কুমারী মেয়েকে বিবাহ করলে সে তোমার সাথে হাসি-তামাশা করত, আর তুমিও তার সাথে হাসি-তামাশা করতে পারতে। [ মুসলিমঃ ৩৫০১;ইঃফাঃ ]

 গ) আয়েশা রা. এর হাদীসে এসেছে: কোন এক সফরে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলেন। আয়েশা রা. বলেন : আমি রাসূলের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রবৃত্ব হলাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পিছনে ফেলে দিলাম। অত:পর যখন আমার শরীর মোটা হয়ে গেল আবার প্রতিযোগিতা করলাম রাসূল বিজয়ী হলেন। তখন বললেন: এই বিজয় ঐ বিজয়ের পরিবর্তে (শোধ)। [ আবু দাউদঃ২২১৪ ]

 ঘ) আনাস রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে আছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার তাকে এ বলে সম্বোধন করেছিলেন:(( হে দুই কান বিশিষ্ট ব্যক্তি)) হাদীসের একজন বর্ণনাকারী আবু উসামা বলেন:অর্থাৎ রাসূল তার সাথে রসিকতা করছিলেন। [ তিরমিজিঃ ৩৫ ]

 ঙ) আনাস রা. থেকে বর্ণিত: কোন এক ব্যক্তি রাসূলুল¬হ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একটি (ভারবাহী জন্তু) বাহন চাইলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন আমি তোমাকে একটি উটের বাচ্চার উপর চড়িয়ে দেব। সে বলল: হে আল্লাহ্লর রাসূল আমি উটের বাচ্চা দিয়ে কি করব? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: উটতো উটের বাচ্চা ছাড়া আর কিছু জন্ম দেয় না। বুখারিঃ ১৯১৪ ]

 (২) নিন্দাযোগ্য রসিকতা : অর্থাৎ যে রসিকতা মন্দ উদ্দেশ্যে এবং অসৎ নিয়তে অথবা শরীয়তের নির্ধারিত রীতি ভঙ্গ করে সম্পাদন করা হয় । এর উদাহরণ: যেমন মিথ্যা মিশ্রিত রসিকতা, অথবা অন্যকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে কৃত রসিকতা।

 (৩) মুবাহ রসিকতা : ঐ রসিকতা যার কোন সঠিক উদ্দেশ্য নেই, ভাল নিয়তও নেই, কিন্তু শরীয়তের নির্ধারিত গণ্ডি থেকে বের হতে হয় না এবং নিয়মও ভঙ্গ করা হয়না।পাশাপাশি অতিরিক্ত পরিমাণেও করে না যে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে । এমন রসিকতা প্রশংসাযোগ্যও নয় আবার নিন্দাযোগ্যও নয়। সুতরাং এর ভিতর কোন পুণ্য নেই। কারণ পুন্য পাওয়ার যে নীতিমালা অর্থাৎ সঠিক উদ্দেশ্য এবং সৎ নিয়ত তা এখানে পাওয়া যায়নি অনুরূপভাবে কোন গুনাহও হবেনা কারণ  শরীয়তের বিরুদ্ধাচারণ করা হয়নি বা কোন নীতি ভাঙ্গা হয়নি।

 রসিকতার কতিপয় নীতিমালা ও আদব :

প্রথমত : রসিকতা করার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরত্ব দিতে হবে :

১। ভাল নিয়ত অর্থাৎ রসিকতা করার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মনে মনে এমন ধারণা পোষন করবে যে সে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন এমন একটি ভাল কাজ করছে। যেমন রসিকতার মাধ্যমে নিজ ভাই, স্ত্রী, পিতা বা এমন কারো অন্তরে খুশি-আনন্দ প্রবেশ করিয়ে তাদের কর্ম চঞ্চল করে তোলা। অথবা উক্ত তামাশা করার মাধ্যমে কাউকে একটি ভাল কাজের নিকটবর্তী করে দেয়া।অথবা নিজ আত্মাকে ভালকাজের জন্য শক্তি সঞ্চয়ের লক্ষ্যে প্রফুল্ল করা। বা এরূপ যে কোন ভাল নিয়ত পোষন করা। আর এ মহান মূলনীতির প্রমাণ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী: সমস্ত কাজের ফলাফল নিয়তে উপর ভিত্তি  করে নিরোপিত হয়।

২। সত্যকে অত্যাবশ্যকীয় করে নেয়া অর্থাৎ রসিকতা করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সত্য ও বাস্তবধর্মী রসিকতা করবে এবং মিথ্যা পরিহার করবে।

 আবু হুরাইরা রা. বলেন: লোকেরা বলল: হে আল্লাহর রাসূল আপনি কি আমাদের সাথে রসিকতা করছেন? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি সত্য ছাড়া বলি না। তিরমিজিঃ১৯১৩ ]

 ৩। রসিকতা করার ক্ষেত্রে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান বোধ থাকতে হবে, মানুষকে তার যোগ্য মর্যাদা দিতে হবে এবং প্রতিপক্ষের মন-মানসিকতা বুঝতে হবে। সকল মানুষ ঠাট্টা-রসিকতা পছন্দ করে না।

 দ্বিতীয়ত: রসিকতার সময় যে সমস্ত বিষয় থেকে বেচে থাকতে হবে।

১। মিথ্যা, ঠাট্টার ছলে হোক আর উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই হোক মিথ্যা সর্বাবস্থায়ই হারাম এবং শরীয়তের দৃষ্টিকোন থেকে খুবই নিকৃষ্ট কাজ। মানুষকে হাসানোর জন্য যে মিথ্যা বলে তার প্রতি বিশেষ শাস্তির কথা এসেছে। আর এটা এই জন্য যে এটি খুবই বিপদজনক, সাথীদেরকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি এর ভিতর খুব সহজেই জড়িয়ে পড়া যায়, এবং এর মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা যায়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ধ্বংস ঐ ব্যক্তির জন্য যে মানুষকে হাসানোর জন্য কথা বলে অতঃপর মিথ্যা বলে, তার ধ্বংস অনিবার্য, তার ধ্বংস অনিবার্য। [ তিরমিজিঃ২২৩৭ ]

শরীয়ত মিথ্যা বলার এ কুঅভ্যাসকে শুধু এখানে নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠাট্টা-রসিকতার মত বিষয়েও এটি পরিত্যাগ করতে সকলকে দারুন ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বলেছেন: আমি জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বিশেষ ঘরের জিম্মাদারী গ্রহন করছি ঐ ব্যক্তির জন্যে যে সর্বোতভাবে মিথ্যা পরিহার করেছে এমনকি রসিকতার মাঝেও। আবু দাউদঃ ৪১৬৭ ]

 ২। হাসি-রসিকতার ক্ষেত্রে  বাড়া-বাড়ি এবং পরিমাণে এত অধিক করা যে মজলিসটিই হাসি-তামাশার মজলিসে রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং মূল লক্ষ-উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয় বিষয়াদি চাপা পড়ে যায়। আর এটি ব্যক্তির পরিচয় ও বৈশিষ্টে পরিনত হয়। এরূপ পর্যায়ের মজা-রসিকতা নিন্দনীয়। কেননা এতে সময় নষ্ট হয়। ব্যক্তিত্বের প্রভাব নষ্ট হয়ে যায়, বৈশিষ্ট্য পূর্ণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব শেষ হয়ে যায়, অবশ্যই ইহা মিথ্যায় পতিত করে। অন্যকে ছোট করা হয়, ছোটরা বড়দের উপর সাহসী হয়ে উঠে। অন্তর মরে যায় এবং মুসলমান যে ধরনের বাস্তব ও উপকারী গুনাগুন দ্বারা অলংকৃত থাকার কথা তা তার থেকে দূরে সরে যায়।

 ৩। বেগানা নারীদের সাথে ঠাট্টা করা। কেননা এটা ফিতনা ও অশ্লীলতায় পড়ার কারণ এবং অন্তর হারামের দিকে ধাবিত করে।

 ৪। অন্যের ক্ষতি সাধন করা, কষ্ট দেওয়া বা অধিকার হরণ করা, অথবা এমন আঘাত করা যা সীমা লঙ্ঘন করে অথবা এমন জিনিস দ্বারা ঠাট্টা করা যার দ্বারা ক্ষতি হতে পারে যেমন পাথর বা অস্ত্র।

 এ ধরনের ঠাট্টা হিংসা বিদ্বেষ তৈরি করে বরং কখনও ঝগড়ার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ঠাট্টাকে তখন আর ঠাট্টা মনে করা হয়না বাস্তব মনে করা হয় আর ভালোবাসা পরিবর্তিত হয়ে যায় হিংসায় । পছন্দ মোড় নেয় অপছন্দের দিকে । আল্লাহ বলেনঃ আমার বান্দাদেরকে বলে দিন তারা যেন যা উত্তম এমন কথাই বলে। শয়তান তাদের মাঝে সংঘর্ষ বাধায়। সুরা আল ইসরাঃ৫৩ ]

 ইবনে কাসীর (রা:) বলেন: আল্লাহ তাআলা তার মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন পরস্পরে কথা বলার সময় নরম এবং ভাল কথা বলবে। তারা যদি এমন না করে তাহলে শয়তান তাদের মাঝে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেবে।

 ৫। শরীয়তের বিষয়াদি নিয়ে রসিকতা করা। শরীয়তের বিষয়ে রসিকতা করাকে উপহাস ও বিদ্রুপ হিসাবে ধরা হয় যা মূলত: কুফরী এবং এগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রক্ষা করুন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন: আর যদি তুমি তাদের কাছে জিজ্ঞেস কর তবে তারা বলবে আমরাতো কথার কথা বলছিলাম এবং কৌতুক করছিলাম। আপনি বলুন : তোমরা কি আল্লাহর সাথে তার হুকুম আহকামের সাথে এবং তার রাসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে, ছলনা করো না, তোমরা যে কাফের হয়ে গেছ, ঈমান প্রকাশ করার পর। [ সুরা তাওবাহঃ৬৫-৬৬ ]

 অনুরূপ ভাবে দ্বীনের ধারক বাহক তথা সাহাবা , উলামা, সালেহীন প্রমুখদের বেলায়ও হুকুম তাই। অর্থাৎ তাদের চাল চলন, কথা বার্তা, আচার আচরন, ফতোয়া ইত্যাদি নিয়ে কেউ ঠাট্টা বিদ্রুপ করলে তারও ঈমান থাকবে না।

Copied from QuranerAlo.com


দাওয়াতি কাজ সকল মুসলিমের জন্য ফরজ এবং সাধারণ মানুষদের দাওয়াতি কাজের কতিপয় পদ্ধতি

  ▬▬▬✪✪✪▬▬▬ প্রশ্ন: সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ কি সবার উপরে ফরজ? যাদের দ্বীনের জ্ঞান নেই যেমন জেনারেল লাইনে পড়া মানুষ কিন্তু দ্বীন জানার...