Showing posts with label জীবনী ও ইতিহাস. Show all posts
Showing posts with label জীবনী ও ইতিহাস. Show all posts

Friday, June 18, 2021

ড. শাইখ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া (হাফিযাহুল্লাহ)


 

ড. শাইখ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া (হাফিযাহুল্লাহ): ইলম ও দাওয়াহ এর ময়দানে এক উজ্জল নাম
▬▬▬▬◢◯◣▬▬▬▬
১৯৬৯ সালে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলাধীন ধনুসাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সরকারী মাদ্‌রাসা-ই আলীয়া ঢাকা হতে ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত কামিল (হাদীস) পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
তারপর মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স, এম-ফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রি (আকিদাহ) অর্জন করেন।
তিনি ‘আল কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর’ নামে কুরআনের বৃহৎ খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, যা কিং ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং প্রেস সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত।
ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর তার লিখিত, অনূদিত ও সম্পাদিত বহু সংখ্যক বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া’র আইন ও শরী‘আহ অনুষদভুক্ত আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। [উৎস: rokomari]
তিনি বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষায় সাড়া জাগানো নির্ভরযোগ্য একজন বড় স্কলার। দাওয়াহর ময়দানে তার স্বক্রিয়তা ও সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী তার দাওয়াত ও ইলাম থেকে উপকৃত হচ্ছে আল হামদুলিল্লাহ।
❑ তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়ে বিস্তারিত:
◈ PhD in ‘Aqidah (Creed)
Faculty of Da‘wah & Usuluddin. Islamic University of Madinah Munawwarah, Saudi Arabia. Specialization: Comparative Religion.
◈ Master’s & MPhil in ‘Aqidah (Creed)
Faculty of Da‘wah & Usuluddin. Islamic University of Madinah Munawwarah, Saudi Arabia.
◈ Bachelor’s degree in Shari‘ah (Islamic law)
Faculty of Shari‘ah. Islamic University of Madinah Munawwarah, Saudi Arabia. Grade: Excellent
◈ Kamil in Hadith
2-year diploma in prominent six hadith books From Bangladesh Madrasah Education Board, Dhaka Grade: 1st Class (1st in whole Bangladesh, combined merit list)
[উৎস: শাইখে অফিসিয়াল ওয়েব সাইট]
◍ শাইখের ফেসবুকে আইডি
◍ অফিসিয়াল পেইজ
◍ ওয়েব সাইট
◍ রকমারীতে শাইখের কতিপয় বই: (বিক্রয়)
◍ ইসলাম হাউজে শাইখের লিখিত ও সম্পাদিত কতিপয় ফ্রি বই (২৭১টি আইটেম)
◍ অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল
◍ টুইটার একাউন্ট
আল্লাহ তাকে হায়াতে তাইয়েবা দান করুন এবং হিংসুকদের হিংসা ও সকল অনিষ্ট থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
أحسبه كذلك ولا أزكي على الله أحدا.
আল্লাহ আলাম।
সংকলনে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব

Tuesday, September 18, 2018

শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ)-এর জীবনী


লেখক: আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী
পরিচয়, জন্ম ও প্রতিপালন:
তিনি হলেন শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সুলায়মান বিন আলী বিন মুহাম্মাদ আত্ তামীমী (রঃ)। হিজরী ১১১৫ সালে তিনি নজদ অঞ্চলের উয়াইনা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। শিশুকালে তিনি স্বীয় পিতার নিকট প্রতিপালিত হন। তাঁর পিতা, চাচা এবং দাদাসহ পরিবারের অনেকেই বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। সে হিসাবে তিনি একটি দ্বীনি পরিবেশে প্রতিপালিত হন। সে সময় শাইখের পরিবারের আলেমগণ শিক্ষকতা, ফতোয়া দান, বিচারকার্য পরিচালনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি দায়িত্ব পালন করতেন। এ সমস্ত বিষয় দ্বারা সম্মানিত শাইখ শিশুকালেই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
শাইখের প্রখর মেধা ও প্রথামিক শিক্ষা:
তিনি উয়ায়নাতেই এবং পিতাসহ স্বীয় পরিবারের আলেমদের থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিশুকালেই তার মধ্যে বিরল ও অনুপম মেধার আলামত পরিলক্ষিত হয়। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর, বুঝশক্তি ছিল খুবই তীক্ষè এবং চিন্তাশক্তি ছিল খুবই গভীর। এ কারণেই তিনি অল্প বয়সেই ইলম অর্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। শৈশব কালেই তিনি সুদৃঢ় ঈমান ও দ্বীন পালনের প্রতি বিশেষ যত্মবান ছিলেন। ছোট বেলাতেই তিনি তাফসীর, হাদীছ এবং বিজ্ঞ আলেমদের কিতাবগুলো প্রচুর অধ্যয়ন করতেন। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সালফে সালেহীনদের আছারই ছিল শাইখের জ্ঞান অর্জনের মূল উৎস। দর্শন, সুফীবাদ, মানতেক ইত্যাদির সংস্পর্শ থেকে শাইখ ছিলেন সম্পূর্ণ দূরে। কারণ তিনি যেই পরিবার ও পরিবেশে প্রতিপালিত হন, তা ছিল বিকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা, পাপাচার এবং কুসংস্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
শাইখের যুগে আরব উপদ্বীপের অবস্থা:
শাইখের যুগে নজদ ও তার আশেপাশের অঞ্চলে ব্যাপক আকারে শির্ক-বিদআত ও কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ে। আইয়্যামে জাহেলীয়াতের সকল প্রকার শির্কই পুনরায় আরব উপদ্বীপে নতুন পোষাকে প্রবেশ করে। গাছ, পাথর কবর এবং অলী-আওলীয়ার এবাদত শুরু হয়। এই দৃশ্য দেখে তিনি মর্মাহত হন এবং এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সুদৃঢ় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
শাইখের চারিত্রিক গুণাবলী:
আমানতদারী, সত্যবাদিতা, মানুষের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ, দানশীলতা, ধৈর্যশীলতা, দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা এবং তার মধ্যে আরো এমন চারিত্রিক উন্নত ও বিরল গুণাবলীর সমাহার ঘটেছিল, যা তাকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করেছিল। ইতিহাসে যে সব মহাপুরুষ স্বীয় কর্মের মাধ্যমে প্রসিদ্ধতা অর্জন করেছেন তাদের খুব অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যেই এই চারিত্রিক গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি খুব বিনয়ী ছিলেন, সায়েল ও অভাবীদের প্রয়োজন পূরণে বিশেষ তৎপর ছিলেন।
তাঁর বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে কঠোরতা, অজ্ঞতা এবং দ্বীন পালনে দুর্বলতা ইত্যাদি যেসব অভিযোগ করে থাকে, শাইখ ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
উচ্চশিক্ষা ও ভ্রমণ:
উয়ায়নার আলেমদের কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ সমাপ্ত করার পর তিনি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য হিজায ও শাম (সিরিয়া) ভ্রমণ করেন। যৌবনে পদার্পন করে তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফে গমণ করেন। হজ্জ শেষে মদীনায় গিয়ে তিনি শাইখ আব্দুল্লাহ বিন ইবরাহীম বিন সাইফ নামক প্রখ্যাত আলেমের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধির নিকট ইলমে হাদীছের জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি ইরাকের বসরায় গমণ করেন এবং সেখানকার শাইখ মাজমুয়ীর নিকট তাওহীদ ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। সেখানে থাকা অবস্থাতেই তিনি শির্ক ও বিদআত বিরোধী প্রকাশ্য আলোচনা শুরু করেন। ফলে বসরার বিক্ষুদ্ধ বিদআতীরা তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেয়।
উয়াইনায় ফিরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস এবং দাওয়াতী কাজে মনোনিবেশ:
ইরাক থেকে ফিরে এসে শাইখ নিজ জন্মস্থান উয়ায়নায় বসবাস করতে থাকেন। তখন উয়ায়নার শাসক ছিলেন উছমান বিন মুহাম্মাদ বিন মুআম্মার। তিনি উছমানের নিকট গেলেন। উছমান শাইখকে স্বাগত জানালেন এবং বললেনঃ আপনি আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতে থাকুন। আমরা আপনার সাথে থাকবো এবং আপনাকে সাহায্য করবো। উছমান এমনি আরো ভালো কথা বললেন, শাইখের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করলেন এবং তাঁর দাওয়াতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেন।
উছমানের আশ্বাস পেয়ে শাইখ মানুষকে আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দান, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ করাসহ কল্যাণের দিকে আহবান করতে থাকলেন। শাইখের দাওয়াত উয়ায়নার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী সকল গ্রামের মানুষ শাইখের কাছে আসতে থাকলো এবং নিজেদের ভুল আকীদাহ বর্জন করে শাইখের দাওয়াত কবুল করতে লাগল।
ঐ সময় জুবাইলা নামক স্থানে যায়েদ বিন খাত্তাব নামে একটি মিনার ছিল। যায়েদ বিন খাত্তাব ছিলেন উমার (রাঃ)এর ভাই। তিনি মিথ্যুক নবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। পরবর্তীতে অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকেরা তার কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করে। কালক্রমে তা এক দেবতা মন্দিরে পরিণত হয়। এতে বিভিন্ন ধরণের মানত পেশ করা হতো এবং কাবা ঘরের ন্যায় তাওয়াফও করা হতো। সেখানে আরো অনেক কবর ছিল। আশেপাশের গাছপালারও এবাদত হতো।
একদা শাইখ আমীর উছমানকে বললেনঃ চলুন আমরা যায়েদ বিন খাত্তাবের কবরের উপর নির্মিত গম্বুজটি ভেঙে ফেলি। কেননা এটি অন্যায়ভাবে এবং বিনা দলীলে নির্মাণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এই কাজের প্রতি কখনই সন্তুষ্ট হবেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর কোন কিছু নির্মাণ করতে এবং কবরকে মসজিদে পরিণত করতে নিষেধ করেছেন। এই গম্বুজটি মানুষকে গোমরাহ করছে, মানুষের আকীদাহ পরিবর্তন করছে এবং এর মাধ্যমে নানা রকম শির্ক হচ্ছে। সুতরাং এটি ভেঙে ফেলা আবশ্যক।
আমীর উছমান বললেনঃ এতে কোন অসুবিধা নেই। অতঃপর উছমান বিন মুআম্মার গম্বুজটি ভাঙ্গার জন্য ৬০০ সৈনিকের একটি বাহিনী নিয়ে বের হলেন। শাইখও তাদের সাথে ছিলেন।
উছামানের বাহিনী যখন জুবাইলিয়ার নিকটবর্তী হলো এবং জুবাইলিয়ার অধিবাসীরা জানতে পারলো যে, যায়েদ বিন খাত্তাবের মিনার ভাঙ্গার জন্য একদল লোক আগমণ করেছে তখন তারা গম্বুজটি রক্ষা করার জন্য বের হলো। কিন্তু আমীর উছমান এবং তাঁর সৈনিককে দেখে তারা ফিরে গেল। উছমানের সৈনিকরা গম্বুজটি গুড়িয়ে দিল। শাইখের প্রচেষ্টায় এই মিনারটি ভেঙে ফেলা হয় এবং তিনি শাইখ নিজেও ভাঙ্গার কাজে অংশ নেন।
আলহামদুলিল্লাহ। চিরতরে শির্কের একটি আস্তানা বিলুপ্ত হলো। এমনি শির্কের আরো অনেক আস্তানা আল্লাহ তাআলা সম্মানিত শাইখের মাধ্যমে বিলুপ্ত করলেন।
ব্যভিচারের হদ্দ (শাস্তি) কায়েম:
উয়ায়নাতে অবস্থানকালে এক মহিলা একদিন তাঁর কাছে এসে স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে ব্যভিচারের অপরাধ স্বীকার করে বিচার প্রার্থনা করে। মহিলাটির অবস্থা স্বাভাবিক কি না, তা জানার জন্য তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। যখন তিনি জানতে পারলেন, মহলিাটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং তার মাথায় কোন পাগলামী নেই, তখন মহিলাটিকে বললেনঃ সম্ভবতঃ জবরদস্তি করে তোমার সাথে এই অপকর্ম করা হয়েছে। সুতরাং তোমার বিচার প্রার্থনা করার দরকার নেই। অবশেষে মহিলাটি জোর দাবী জানালে এবং বার বার স্বীকার করতে থাকলে তিনি লোকদেরকে নির্দেশ দিলে তারা পাথর মেরে মহিলাটিকে হত্যা করে ফেলে।
উয়ায়নাতে উছমান বিন মুআম্মারের সহযোগিতায় ও সমর্থনে শাইখের সংস্কার আন্দোলন যখন পুরোদমে চলতে থাকে, তখন আহসার শাসক সুলায়মান বিন আব্দুল আযীযের কাছে এই খবর পৌঁছে গেল। শাইখের বিরোধীরা সুলায়মানকে জানিয়ে দিল যে, শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ব্যক্তি কবরের উপর নির্মিত গম্বুজগুলো ভেঙে ফেলছে এবং ব্যভিচারের শাস্তিও কায়েম করছে। আহসার আমীর এতে রাগান্বিত হলো এবং সে উয়ায়নার আমীর উছমানকে এই মর্মে পত্র লিখলো যে, আপনি অবশ্যই এই লোকটিকে (শাইখকে) হত্যা করবেন। অন্যথায় আমরা আপনাকে খিরাজ (টেক্স) দেয়া বন্ধ করে দিবো।
উল্লেখ্য যে, আহসার এই গ্রাম্য অশিক্ষিত শাসক উছমানকে বিরাট অংকের টেক্স প্রদান করতো। তাই উছমান পত্রের বিষয়টিকে খুব বড় মনে করলেন এবং এই আশঙ্কা করলেন যে, শাইখের দাওয়াতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখলে আহসার খিরাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের পক্ষ হতে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ ঘেষণারও ভয় রযেছে।
তাই তিনি শাইখকে পত্রের বিষয় অবগত করলেন এবং আহসার শাসকের পত্র মুতাবেক আমরা আপনাকে হত্যা করা সমীচিন মনে করছিনা। আপনাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করাও এখন থেকে আর সম্ভব হবেনা। কারণ আমরা আহসার শাসক সুলায়মানকে খুব ভয় করছি। আমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও সক্ষম নই। সুতরাং আপনি যদি আমাদের কল্যাণ ও আপনার নিজের কল্যাণ চান, তাহলে আমাদের নিকট থেকে চলে যান।
শাইখ তখন বললেনঃ আমি যেই বিষয়ের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি, তা তো আল্লাহর দ্বীন। এটিই তো কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহএর দাবী। যে ব্যক্তি এই দ্বীনকে মজবুতভাবে ধারণ করবে, ইহার সাহায্য করবে এবং দৃঢ়তার সাথে এই দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সাহায্য করবেন এবং তাঁর শত্র“দের উপর তাকে বিজয় দান করবেন। সুতরাং আপনি যদি ধৈর্য ধারণ করেন এবং দ্বীনের উপর অটল থাকেন এবং এই দাওয়াতের প্রতি সাহায্য ও সমর্থন অব্যাহত রাখেন, তাহলে আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাকে অচিরেই বিজয় দান করবেন এবং এই গ্রাম্য যালেম শাসক ও তার বাহিনী থেকে আপনাকে রক্ষা করবেন। সেই সাথে আল্লাহ আপনাকে তার অঞ্চল ও তার গোত্রের শাসনভার আপনার হাতেই সোপর্দ করবেন।
এতে উছমান বললেনঃ হে সম্মানিত শাইখ! তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই এবং তার বিরোধীতা করার মত ধৈর্যও আমাদের নেই।
দরঈয়ায় হিজরত এবং দরঈয়ার আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদের সাথে সাক্ষাত:
পরিশেষে উছমান বিন মুআম্মারের অনুরোধে বাধ্য হয়ে শাইখ উয়ায়না থেকে বেরিয়ে পড়লেন। উয়ায়না ছেড়ে তিনি দরঈয়ায় হিজরত করলেন। বলা হয়ে থাকে যে, বের হওয়ার সময় শাইখ পায়ে হেঁটে বের হন। কারণ উছমান শাইখের জন্য কোন বাহনের ব্যবস্থা করেন নি। তাই সকাল বেলা বের হয়ে সারাদিন পায়ে হেঁটে বিকাল বেলা দরঈয়ায় গিয়ে পৌঁছেন। দরঈয়ায় পৌঁছে তিনি একজন ভাল মানুষের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার নাম মুহাম্মাদ বিন সুয়াইলিম আল উরায়নী। এই লোকটি শাইখকে একদিকে যেমন আশ্রয় দিলেন, অন্যদিকে আমীর মুহাম্মাদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্তও হয়ে পড়লেন। কিন্তু শাইখ তাকে এই বলে শান্ত করলেন যে, আমি যেদিকে মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছি, তা হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। অচিরেই আল্লাহ তাআলা এই দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। যাই হোক আমীর মুহাম্মাদের কাছে শাইখের খবর পৌঁছে গেল।
বলা হয় যে, একদল ভাল লোক প্রথমে আমীরের স্ত্রীর কাছে গিয়ে শাইখের দাওয়াতের বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন। আমীরের স্ত্রী ছিলেন একজন ভাল ও দ্বীনদার মহিলা। তারা আমীরের স্ত্রীকে বললেনঃ আপনার স্বামী মুহাম্মাদকে বলুন, তিনি যেন শাইখের দাওয়াত কবুল করেন এবং তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন।
অতঃপর যখন আমীর মুহাম্মাদ বাড়িতে আসলেন, তখন তিনি বললেনঃ আপনার অঞ্চলে বিরাট এক গণীমত আগমণ করেছে। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ তাআলা নিজেই আপনার নিকট এই গণীমত পাঠিয়েছেন। আপনার এলাকায় এমন একজন লোক আগমণ করেছেন, যিনি আল্লাহর দ্বীনের দিকে মানুষকে আহবান করেন, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে দাওয়াত দেন। কত সুন্দর এই গণীমত! সুতরাং আপনি দ্রুত তাকে কবুল করে নিন এবং তাকে সাহায্য করুন। খবরদার! আপনি কখনই এ থেকে পিছপা হবেন না।
আমীর মুহাম্মাদ তাঁর স্ত্রীর এই মূল্যবান পরামর্শ গ্রহণ করলেন। অতঃপর তিনি ইতস্ততঃবোধ করছিলেন। তিনি নিজেই শাইখের কাছে যাবেন? না শাইখকে নিজের কাছে ডেকে আনবেন? এবারও তাঁর স্ত্রী তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, শাইখকে আপনার কাছে ডেকে আনা ঠিক হবেনা। বরং শাইখ যেখানে অবস্থান করছেন, আপনাকেই সেখানে যাওয়া উচিত। কেননা ইলম এবং দ্বীনের দাঈর সম্মানকে সমুন্নত রাখার স্বার্থেই তা করা উচিত। আমীর মুহাম্মাদ এবারও তার স্ত্রীর পরামর্শ কবুল করে নিলেন।
আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য মুহাম্মাদ বিন সুওয়াইলিমের বাড়িতে গেলেন। সেখানে গিয়ে শাইখকে সালাম দিলেন এবং তাঁর সাথে আলোচনা করলেন। পরিশেষে তিনি বললেনঃ হে শাইখ! আপনি সাহায্যের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, নিরাপত্তার সুসংবাদ গ্রহণ করুন এবং সর্ব প্রকার সাহায্য-সহযোগিতারও সুসংবাদ গ্রহণ করুন।
জবাবে শাইখও আমীরকে আল্লাহর সাহায্য, বিজয়, প্রতিষ্ঠা এবং শুভ পরিণামের সুসংবাদ প্রদান করলেন। শাইখ আরো বললেনঃ এটি হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করবে, আল্লাহও তাকে সাহায্য করবেন, শক্তিশালী করবেন। অচিরেই আপনি এর ফল দেখতে পাবেন।
অতঃপর আমীর মুহাম্মাদ বললেনঃ হে শাইখ আমি আপনার হাতে বায়আত করবো। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের দ্বীনের উপর এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে আমরা যখন আমাকে সমর্থন করবো, আপনাকে সাহায্য করবো এবং আল্লাহ তাআলা যখন শত্র“দের উপর আপনাকে বিজয় দান করবেন, তখন আপনি আমাদের দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান কি না।
শাইখ জবাবে বললেনঃ এমনটি কখনই হবেনা। আমার রক্ত আপনাদের রক্ত আমারই রক্ত, আপনাদের ধ্বংস আমারই ধ্বংস। আপনার শহর ছেড়ে আমি কখনই অন্যত্র চলে যাবোনা।
অতঃপর আমীর মুহাম্মাদ শাইখকে সাহায্য করার বায়আত করলেন এবং শাইখও অঙ্গিকার করলেন যে, তিনি আমীরের দেশেই থাকবেন এবং আমীরের সহযোগী হিসাবেই কাজ করবেন ও আল্লাহর দ্বীনের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবেন। এভাবেই ঐতিহাসিক বায়আত সম্পন্ন হলো।
শাইখের দাওয়াতের নতুন যুগ:
এভাবে শাইখের দাওয়াত এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। দরঈয়ার আমীরের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করার অঙ্গিকার পেয়ে শাইখ নতুন গতিতে নির্ভয়ে দাওয়াতী কাজ শুরু করলেন। প্রত্যেক অঞ্চল থেকে দলে দলে লোকেরা দরঈয়ায় আসতে লাগল। শাইখ সম্মান ও ইজ্জতের সাথে এখানে বসবাস করতে লাগলেন এবং তাফসীর, হাদীছ, আকীদাহ, ফিক্হসহ দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে র্দাস দানে মশগুল হয়ে পড়লেন। নিয়মিত দারস্ দানের পাশাপশি সমর্থক ও সাথীদেরকে নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে শির্কের আস্তানা গুড়িয়ে দিতে থাকেন এবং যেসব মাজারে হাদীয়া-তোহফা পেশ করা হতো তা একের এক উচ্ছেদ করতে থাকেন।
শাইখ যখন দরঈয়ায় আসলেন তখন জানতে পারলেন যে, সেখানে এমন একটি খেজুর গাছ রয়েছে, যাকে الفحل ফাহল বা ফাহ্হাল বলা হতো। এই খেজুর গাছের ব্যাপারে তাদের ধারণা ছিল, কোন মহিলার বিয়ে হতে দেরী হলে কিংবা তাকে বিয়ের জন্য কেউ প্রস্তাব না দিলে এই খেজুর গাছটির গাছটিকে জড়িয়ে ধরত এবং বলতোঃ أريد زوجا قبل الحول يا فحل الفحول হে সকল পুরুষের সেরা পুরুষ! বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তোমার কাছে একজন পুরুষ চাই। তাদের ধারণায় এভাবে এই গাছকে জড়িয়ে ধরলে অবিবাহিত মহিলাদের দ্রুত বিয়ে হতো এবং বিয়ে হয়ে গেলে তারা এই গাছকেই বিয়ে হওয়ার কারণ মনে করতো। তাদের মুর্খতা এতদূর গিয়ে পৌঁছেছিল যে, কোন মহিলা গাছটিকে জড়িয়ে ধরার পর যখন তার বিয়ের প্রস্তাব আসতো, তখন তারা বলতোঃ তোমাকে এই গাছটি সাহায্য করেছে। অতঃপর শাইখের আদেশে গাছটিকে কেটে ফেলা হয়। আল্লাহ তাআলা শির্কের এই মাধ্যমটিকে চিরতরে মিটিয়ে দিলেন।
এভাবেই আল্লাহ তাআলা শাইখের দাওয়াতকে দরঈয়াতে সফলতা দান করলেন। পরবর্তীতে সমগ্র আরব উপদ্বীপ এবং পার্শ্ববর্তী আরব দেশসমূহ এবং সারা বিশ্বেই এই দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ল।
আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরকে তাওহীদের জ্ঞান অর্জন ও তা বাস্তবায়নের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। সেই সাথে যেসব বিষয় তাওহীদের বিপরীত এবং যা মানুষের তাওহীদকে নষ্ট করে দেয় সেসব বিষয় সম্পর্কেও শাইখ গভীর পারদর্শিতা অর্জন করেন।
শাইখ তাওহীদের দাওয়াতকে পুনরুজ্জিবীত করার জন্য সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং নবী-রাসূলদের দাওয়াতের মূল বিষয় তথা তাওহীদে উলুহীয়াতের দাওয়াত দেয়ার শুরু করেন এবং শির্ক ও বিদআতের প্রতিবাদ করেন। তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি তাঁর একাধিক ইলমী মজলিস ছিল। প্রতিদিন তিনি তাওহীদ, তাফসীর, ফিকাহ এবং অন্যান্য বিষয়ে একাধির দারস্ প্রদান করতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দাওয়াতের মধ্যে বরকত দান করলেন। ফলে আরব উপদ্বীপের লোকেরা তাঁর দাওয়াত কবুল করে শির্ক, বিদআত ও কুসংস্কারের অন্ধকার পরিহার করে তাওহীদের আলোর দিকে ফিরে আসলো। তাঁর বরকতময় দাওয়াত অল্প সময়ের মধ্যেই আরব উপদ্বীপের সীমা পার হয়ে ইরাক, মিশর, সিরিয়া, মরোক্ক, ভালতবর্ষসহ পৃথিবীর সকল অঞ্চলেই পৌঁছে যায়। ফলে তিনি ১২শ শতকের মুজাদ্দেদ তথা তাওহীদের দাওয়াতের সংস্কারক উপাধিতে ভূষিত হন।
সে সময়ের দরঈয়ার শাসক সম্প্রদায়ও শাইখের দাওয়াতকে কবুল করে নেন এবং সাহায্য করেন। এতে শাইখের দাওয়াত নতুন গতি পেয়ে দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে। বর্তমানে সৌদি আরবসহ সারা বিশ্বে যেই তাওহীদের দাওয়াত চলছে, শাইখের দাওয়াতের দ্বারাই প্রভাবিত। আল্লাহ যেন এই দাওয়াকে কিয়ামত পর্যন্ত চালু রাখেন। আমীন।
শাইখের দাওয়াতের মূলনীতি:
পরিশুদ্ধ ইসলামী মানহাজ এবং দ্বীনের সঠিক মূলনীতির উপর শাইখের দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দাওয়াতের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল, এবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য খালেস করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে যে সমস্ত মূলনীতির ভিত্তিতে শাইখের দাওয়াতী কর্মতৎপরতা পরিচালিত হতো, নিম্নে তা থেকে কয়েকটি মূলনীতি নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
১) মানুষের অন্তরে তাওহীদের শিক্ষা বদ্ধমূল করা এবং শির্ক ও বিদআতের মূলোৎপাটন করা। মুসলিমদের অন্তরে এই মূলনীতিকে সুদৃঢ় করার জন্যই তিনি প্রয়োজন পূরণের আশায় কবর যিয়ারত করা, কবরবাসীর কাছে দুআ করা, কিছু চাওয়া, রোগমুক্তি ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধার লাভের আশায় তাবীজ ঝুলানো, গাছ ও পাথর থেকে বরকত গ্রহণ করা, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের জন্য পশু যবেহ করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য মানত করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে আশ্রয় চাওয়া, কবর পূজা করা, আল্লাহ ও বান্দার মাঝে উসীলা নিধারণ করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যান্য অলী-আওলীয়ার কাছে শাফাআত চাওয়াসহ যাবতীয় শির্ক কর্জন করার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।
২) নামায কায়েম করা, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাসহ দ্বীনের অন্যান্য ফরয ও নিদর্শনগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা।
৩) সমাজে ন্যায় বিচার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহর হদ্দ তথা নির্ধারিত দন্ডবিধি কায়েম করা।
৪) তাওহীদ, সুন্নাহ, ঐক্য, সংহতি, সম্ভ্রম, নিরাপত্তা এবং ন্যায় বিচারকে মূলভিত্তি করে একটি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
যে সমস্ত অঞ্চলে শাইখের দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আরব উপদ্বীপের যেই এলাকাগুলো এই দাওয়াতের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে, সেখানে উপরোক্ত মূলনীতিগুলোর সবই বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সংস্কার আন্দোলনের পতাকাবাহী সৌদি আরবের প্রতিটি স্তরেই এর প্রভাব সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হয়েছে। এই দাওয়াত যেখানেই প্রবেশ করেছে, সেখানেই তাওহীদ, ঈমান, সুন্নাত, নিরাপত্তা ও শান্তি প্রবেশ করেছে। এতে আল্লাহর ওয়াদা ও অঙ্গিকার বাস্তবায়িত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
“তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করবেন। যেমন তিনি প্রতিষ্ঠা দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের সেই দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার এবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য”। (সূরা হজ্জঃ ৫৫)
وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (৪০) الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
“যারা আল্লাহ্র সাহায্য করে, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী শক্তিধর। তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহ্র হাতে”। (সূরা নূরঃ ৪০-৪১)
শাইখের বিরোধীতা ও তার উপর মিথ্যাচার:
সত্যের অনুসারী এবং সত্যের পথে যারা আহবান করেন, তারা কোন যুগেই বাতিলপন্থীদের হিংসা, বিদ্বেষ, শত্র“তা ও তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পান নি। যেমন রেহাই পান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা নবী-রাসূলগণ। আমাদের সম্মানিত শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রঃ) যখন সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন এবং সাহসিকতা ও বলিষ্ঠতার সাথে শির্ক, বিদআত ও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক কুসংস্কারের প্রতিবাদ শুরু করেন, তখন বিদআতী আলেমরা তাঁর ঘোর বিরোধীতা শুরু করে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ উত্থাপন করে। এমনকি এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী লোক সমসাময়িক শাসকদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। তাঁকে একাধিকার হত্যা করারও প্রচেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়। আল্লাহর ইচ্ছা অতঃপর শাইখের সৎসাহস ও নিরলস কর্ম তৎপরতার মুকাবেলায় বিরোধীদের সকল প্রচেষ্টাই বর্থ হয় এবং আল্লাহর দ্বীন ও তাওহীদের দাওয়াতই বিজয় লাভ করে।
বর্তমানেও আমাদের ভারত বর্ষে যে সমস্ত আলেম ও দাঈ সহীহ আকীদাহ ও আমলের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন, অতীতের ন্যায় তারাও বিরোধীদের নানা রকম অপবাদ ও অভিযোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। এই বরকতময় দাওয়াত থেকে মানুষকে দূরে রাখার জন্য এক শ্রেণীর লোক সহীহ আকীদার অনুসারীদেরকে ওয়াহাবী এবং নির্ভেজাল তাওহীদের দাওয়াতকে ওয়াহাবী আন্দোলন বলে গালি দেয়াসহ নানা অপবাদ দিয়েছে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবাণীতে এবং দ্বীনের মুখলিস আলেম ও দাঈদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশসহ ভারত বর্ষের প্রত্যেক অঞ্চলেই এই দাওয়াতের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে লক্ষণীয়। আগামী দিনগুলোতে ব্যাপক হারে এই দাওয়াতের সাথে আমাদের দেশের লোকেরা সম্পৃক্ত হবে, আমাদের সামনে এই লক্ষণ অতি সুস্পষ্ট।
শাইখের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও তার জবাব:
বিদআতীদের পক্ষ হতে শাইখের বিরুদ্ধে সে সময় অনেকগুলো অভিযোগ পেশ করা হয়ে থাকে। সম্ভবতঃ বর্তমানকালেও তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো ছাড়া অন্য কোন অভিযোগ খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অভিযোগগুলো নিম্নরূপঃ
১) শাইখ অলী-আওলীয়াদের কবরে মানত পেশ করা ও কবরকে সম্মান করা এবং কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা বন্ধ করে দিয়েছেন।
২) আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে পশু যবেহ করা হারাম করেছেন।
৩) আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া, শাফাআত চাওয়া এবং অলী-আওলীয়াদের উসীলা দেয়াকে হারাম ঘোষণা করেছেন।
৪) শাইখ নিজ মতের বিরোধীদের সাথে যুদ্ধে করেছেন এবং অন্যায়ভাবে তাদেরকে হত্যা করেছেন। এমননি আরো অনেক অভিযোগ শাইখের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়ে থাকে।
আসলে এইগুলো কোন অভিযোগের আওতায় পড়েনা। এগুলো এমন বিষয়, যা কুরআন ও হাদীছের সুস্পষ্ট দলীল দ্বারাই হারাম করা হয়েছে। তাঁর পূর্বে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তাঁর ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) এ ধরণের শির্ক-বিদআতের জেরালো প্রতিবাদ করেছেন। ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে যার সামান্য জ্ঞান রয়েছে সেও বুঝতে সক্ষম হবে যে, উপরোক্ত বিষয়গুলোর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। দ্বীনের সঠিক শিক্ষা না থাকার কারণে, তাওহীদের আলো নিভে যাওয়ার সুযোগে এবং সর্বত্র মুর্খতা, পাপাচারিতা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মুসলিম সমাজে উক্ত কুসংস্কার গুলোও ঢুকে পড়েছিল। উক্ত কাজগুলো ইসলামী শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে এবং তাওহীদের সরাসরি বিরোধী হওয়ার কারণে শাইখ মুসলিমদেরকে সঠিক দ্বীনের দিকে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছেন। এটি শুধু তার একার দায়িত্ব ছিলনা; বরং সকল আলেমের এই দায়িত্ব ছিল। তাই শাইখের দাওয়াত ছিল সম্পূর্ণ তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক। এটি ছিল একটি সংস্কার আন্দোলন।
তাঁর বিরুদ্ধে ওয়াহাবী মাযহাব নামে পঞ্চম মাযহাব তৈরীরও অভিযোগ পেশ করা হয়ে থাকে। এটিও একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ। শাইখ কোন মাহাব তৈরী করেন নি; বরং মুসলিমদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহবান জানিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর কিতাবাদি পড়লে বুঝা যায় দ্বীনের শাখা ও ফিকহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে হান্বালী মাযহাবের প্রতি তাঁর ঝুক ছিল। তবে তিনি মাজহাবী গোঁড়ামির সম্পূর্ণ উর্ধ্বে ছিলেন।
শাইখের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি বিরোধেিদরকে হত্যা করেছেন। এই অভিযোগও সঠিক নয়। কারণ যারা তার বিরুদ্ধে এবং তাওহীদের দাওয়াতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, তিনি কেবল তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। তাঁর জিহাদ ছিল শরঈ জিহাদ। সুতরাং সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে যারা নিহত হয়েছে, তাদেরকে তিনি অন্যায়ভাবে হত্যা করেছেন- এই অভিযোগ ঠিক নয়।
অনেকে তাকে হাদিছে বর্ণিত ‘নাজদ’এর ফিতনা বলে আখ্যায়িত করে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে আল্লাহ! তুমি আমাদের শাম এবং ইয়ামানে বরকত দান করো। সকলে বললঃ আর আমাদের নাজদে ? তিনি বললেন, ওখান থেকে শয়তানের শিং উদিত হবে। (বুখারি ও মুসলিম)
ইবনে হাযার আস্কালানীসহ অন্যান্য আলেমগণ বলেনঃ হাদিছে উল্লেখিত নাজদ হল ইরাকের নাজদ শহর। আর ইরাকেই সকল বড় বড় ফিতনা দেখা দিয়েছে। আলী (রাঃ) এবং হুসাইন (রাঃ)এর যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইরাক শান্ত হয়নি। সেখানের ফিতনার কারণেই আলী (রাঃ) কুফায় এবং হোসাইন (রাঃ) কারবালায় শাহাদাত বরণ করেন। হেজাযের নাজদে কোন ফিতনাই দেখা যায়নি। যেমনটি ইরাকে দেখা দিয়েছে। সুতরাং হেজাযের নাজদ থেকে শাইখের যেই তাওহীদি দাওয়াত প্রকাশিত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরেছে, তা ছিল নাবী-রাসূলদেরই দাওয়াত। সুস্পষ্ট বিদআতী আর অন্ধ ছাড়া কেউ এই দাওয়াতকে নাজদের ফিতনা বলতে পারেনা।
শাইখের দাওয়াতের ফলাফল:
শাইখের বরকতময় দাওয়াতের ফলে আরব উপদ্বীপসহ পৃথিবীর বহু অঞ্চল থেকে শির্ক-বিদআত ও দ্বীনের নামে নানা কুসংস্কার উচ্ছেদ হয়। যেখানেই এই দাওয়াত প্রবেশ করেছে, সেখানেই তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হকপন্থীগন সম্মানিত হয়েছেন। হাজীগণ সারা বিশ্ব হতে মক্কা ও মদীনায় আগমণ করে শাইখের দাওয়াত পেয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করতে থাকেন। বাদশাহ আব্দুল আযীযের যুগে সুবিশাল সৌদি আরব তাওহীদের এই দাওয়াতের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ এই দাওয়াতের ফল ভোগ করছেন সৌদি রাজ পরিবার ও তার জনগণ। বিশ্বের যেখানেই কুরআন, সুন্নাহ এবং সহীহ আকীদার দাওয়াত ও শির্ক-বিদআতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে, তা শাইখের এই বরকতময় দাওয়াতেরই ফসল। হে আল্লাহ! তুমি কিয়ামত পর্যন্ত তাওহীদের এই দাওয়াতকে সমুন্নত রাখো। আমীন।
শাইখের ছাত্রগণ:
তাঁর নিকট থেকে অগণিত লোক তাওহীদ ও দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন।
তাদের মধ্যে-
১) শাইখের চার ছেলে হাসান, আব্দুল্লাহ্, আলী এবং ইবরাহীম। তাদের প্রত্যেকেই ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেিেছলেন।
২) তাঁর নাতী শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান।
৩) শাইখ আহমাদ বিন নাসের বিন উছমান এবং আরো অনেকেই।
শাইখের ইলমী খেদমতঃ
শাইখের রয়েছে ছোট বড় অনেকগুলো সুপ্রসিদ্ধ কিতাব। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও আলোচিত হচ্ছে আমাদের সামনের এই কিতাবুত্ তাওহীদ। শাইখের আরো যেসমস্ত গ্রন্থ রয়েছে, তার মধ্যেঃ
(১) কাশফুস শুবুহাত।
(২) আল উসূলুস ছালাছাহ ওয়া আদিল্লাতুহা।
(৩) উসূলুল ঈমান।
(৪) তাফসীরুল ফাতিহা।
(৫) মাসায়িলুল জাহেলিয়াহ।
(৬) মুখতাসার যাদুল মাআদ
(৭) মুখতাসার সিরাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আরো অন্যান্য কিতাব।
শাইখের মৃত্যু:
হিজরী ১২০৬ সালের যুল-কাদ মাসের শেষ তারিখে ৯২ বছর বয়সে শাইখ দরঈয়ায় মৃত্যু বরণ করেন। হে আল্লাহ! তুমি শাইখকে তোমার প্রশস্ত রহমত দ্বারা আচ্ছাদিত করে নাও।

Sunday, September 16, 2018

ইমাম মালিক (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী



ইমাম মালিক (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম, উপনাম ও বংশ :
নাম মালিক, উপনাম আবূ আব্দুল্লাহ। বংশনামা : মালিক বিন আনাস বিন আবূ আমির বিন আমর বিন হারিস আল-আসবাহী। তিনি আরবের প্রসিদ্ধ গোত্র কাহ্ত্বান এর উপগোত্র আসবাহ্ অন্তর্ভূক্ত, এজন্য ‘আল-আসবাহী’ বলে পরিচিত।[1]
জন্ম ও প্রতিপালন :
ইমাম মালিক (রহ.) পবিত্র মদীনা নগরীতে এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষানুরাগী মুসলিম পরিবারে জন্মলাভ করেন। জন্মের সন নিয়ে কিছু মতামত থাকায় ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন : বিশুদ্ধ মতে ইমাম মালিক (রহ.)-এর জন্ম সন হল ৯৩ হিজরী, যে সনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খাদেম আনাস বিন মালিক (রা) মৃত্যুবরণ করেনই।[2]
তিনি পিতা আনাস বিন মালিকের কাছে মদীনায় প্রতিপালিত হন। তাঁর পিতা তাবে-তাবেঈ ও হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন, যার কাছ থেকে ইমাম যুহুরীসহ অনেকেই হাদীস বর্ণনা করেন। খুদ ইমাম মালিকও পিতার নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেন।[3] তাঁর দাদা আবূ আনাস মালিক (রহ.) প্রসিদ্ধ তাবেঈ ছিলেন, যিনি ওমার, আয়িশা ও আবু হুরায়রা (রা.) হতে হাদীস বর্ণনা করেন।[4] তাঁর পিতামহ আমির বিন আমর (রা) প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন।[5] এ সম্ভ্রান্ত দ্বীনী পরিবেশে জ্ঞানপিপাসা নিয়েই তিনি প্রতিপালিত হন।
শিক্ষা জীবন :
রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের পর হতে আজও পর্যন্ত দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র হলো মদীনা। সে মদীনাতে জন্মলাভ করার অর্থ হল দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্রেই জন্ম লাভ করা। বিশেষ করে বংশীয়ভাবে তাঁদের পরিবার ছিল দ্বীনী জ্ঞানচর্চায় অগ্রগামী। এজন্য তিনি শৈশবকাল হতেই শিক্ষা শুরু করেন। বিশেষ করে তাঁর মাতা তাকে শিক্ষার প্রেরণা যোগান। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন : আমি একদিন মাকে বললাম, ‘‘আমি পড়ালিখা করতে যাব! মা বললেন : আস শিক্ষার লেবাস পড়, অতঃপর আমাকে ভাল পোষাক পড়ালেন, মাথায় টুঁপি দিলেন এবং তার উপর পাগড়ী পড়িয়ে দিলেন, এরপর বললেন : এখন পড়া লিখার জন্য যাও।
তিনি বলেন : মা আমাকে ভালভাবে কাপড় পড়িয়ে দিয়ে বলতেন : যাও মদীনার প্রসিদ্ধ আলিম রাবিয়াহর কাছে এবং তাঁর জ্ঞান শিক্ষার আগে তাঁর আদব আখ্লাক শিক্ষা কর।[6] এভাবে তিনি মদীনার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ফকীহদের নিকট হতে শিক্ষালাভ করেন।
ইমাম মালিকের (রহ.) শিক্ষক বৃন্দ : ইমাম মালিক (রহ.) অসংখ্য বিদ্যানের নিকট শিক্ষালাভ করেন। ইমাম যুরকানী (রহ.) বলেন : ‘‘ইমাম মালিক (রহ.) নয়শতর অধিক শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ইমাম মালিক স্বীয় গ্রন্থ মুয়াত্ত্বায় যে সব শিক্ষক হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদেরই সংখ্যা হল ১৩৫ জন, যাদের নাম ইমাম যাহাবী ‘‘সিয়ার’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।[7] তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নিম্নরূপ :
১. ইমাম রাবীয়া বিন আবূ আবদুর রহমান (রহ.)।
২. ইমাম মুহাম্মদ বিন মুসলিম আয্যুহুরী (রহ.)।
৩. ইমাম নাফি মাওলা ইবনু ওমার (রহ.)।
৪. ইব্রাহীম বিন উক্বাহ (রহ.)।
৫. ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ বিন সা’দ (রহ.)।
৬. হুমাইদ বিন কায়স আল ‘আরজ (রহ.)।
৭. আইয়ূব বিন আবী তামীমাহ আসসাখতিয়ানী (রহ.) ইত্যাদি।[8]
ইমাম মালিক (রহ.)-এর ছাত্র বৃন্দ : ইমাম মালিক (রহ.) হলেন ইমামু দারিল হিজরাহ, অর্থাৎ মদীনার ইমাম। অতএব মদীনার ইমামের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য কে না চায়। তাই তাঁর ছাত্র অগণিত। ইমাম যাহাবী উল্লেখযোগ্য ১৬৬ জনের নাম বর্ণনা করেছেন। ইমাম খাতীব বাগদাদী ৯৯৩ জন উল্লেখ করেন।[9] ইমামের প্রসিদ্ধ কয়েকজন ছাত্রের নাম নিম্নে প্রদত্ত্ব হল :
১. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস আশ্শাফেঈ (রহ.)।
২. ইমাম সুফাইয়ান বিন উয়ায়নাহ (রহ.)।
৩. ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রহ.)।
৪. ইমাম আবু দাউদ আত্তায়ালিসী (রহ.)।
৫. হাম্মাদ বিন যায়দ (রহ.)।
৬. ইসমাঈল বিন জাফর (রহ.)।
৭. ইবনু আবী আযযিনাদ (রহ.) ইত্যাদি।[10]
জ্ঞান গবেষণায় ইমাম মালিক (রহ.) :
ইমাম মালিক (রহ.) জন্মগতভাবেই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মেধা শক্তি ছিল খুবই প্রখর। আবূ কুদামাহ বলেন : ‘‘ইমাম মালিক স্বীয় যুগে সর্বাধিক মেধা শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।[11]
হুসাইন বিন উরওয়াহ হতে বর্ণিত : তিনি বলেন : ‘‘ইমাম মালিক বলেন : একদা ইমাম যুহুরী (রহ.) আমাদের মাঝে আসলেন, আমাদের সাথে ছিলেন রাবীয়াহ। তখন ইমাম যুহুরী (রহ.) আমাদেরকে চল্লিশের কিছু অধিক হাদীস শুনালেন। অতঃপর পরেরদিন আমরা ইমাম যুহুরীর কাছে আসলাম, তিনি বললেন : কিতাবে দেখ আমরা কি পরিমান হাদীস পড়েছি, আরো বললেন, গতকাল আমরা যে হাদীস বর্ণনা করেছি, তোমরা কি কিছু পড়েছ? তখন রাবীয়া বললেন : হ্যাঁ, আমাদের মাঝে এমনও ব্যক্তি আছেন যিনি গতকাল আপনার বর্ণনাকৃত সব হাদীস মুখস্ত শুনাতে পারবেন। ইমাম যুহুরী বললেন : কে তিনি? রাবিয়া বললেন : তিনি ইবনু আবী আমীর অর্থাৎ ইমাম মালিক। ইমাম যুহুরী বললেন : হাদীস শুনাও, ইমাম মালিক বলেন : আমি তখন গতকালের চল্লিশটি হাদীস মুখস্ত শুনালাম। ইমাম যুহুরী বলেন : আমার ধারণা ছিল না যে, আমি ছাড়া এ হাদীসগুলো এভাবে আর দ্বিতীয় কেউ মুখস্ত করেছে।
অতএব ইমাম মালিক (রহ.)-এর অসাধারণ পান্ডিত্বের সাথে গভীরভাবে জ্ঞান গবেষণা ও সংরক্ষণ সম্পর্কে আর বেশী কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না।
হাদীস শাস্ত্রে ইমাম মালিক (রহ.) : হাদীস শাস্ত্রে ইমাম মালিক (রহ.) এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, হাদীস সংকলনে অগ্রনায়ক। যদিও তাঁর পূর্বে কেউ কেউ হাদীস সংকলন করেন, যেমন ইমাম যুহুরী, কিন্তু ইমাম মালিক (রহ.)-এর হাদীসের সাধনা, সংগ্রহ ও সংকলন ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এজন্যই তাঁর সংকলিত গ্রন্থকে বলা হয়, ‘‘আল্লাহর কিতাব কুরআনের পর সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ ইমাম মালিকের মুয়াত্ত্বা গ্রন্থ।’’[12]
তিনি হাদীস শিক্ষায় পারিবারিকভাবে উৎসাহী হলেও তাঁর অসাধ্য সাধন এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অনেক অগ্রসর হয়েছেন। শয়নে স্বপনে সব সময় একই চিন্তা, কিভাবে তিনি হাদীস শিক্ষালাভ করবেন। মানুষ যখন অবসরে তখন তিনি হাদীসের সন্ধানে। ইমাম মালিক একদা ঈদের সালাতে ইমাম যুহুরীকে পেয়ে মনে করলেন, আজ মানুষ ঈদের আনন্দে ব্যস্ত, হয়ত ইমাম যুহুরীর কাছে একাকী হাদীস শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যাবে। ঈদের ময়দান হতে চললেন ইমাম যুহুরীর বাসায়, দরজার সামনে বসলেন, ইমাম ভিতর থেকে লোক পাঠালেন গেটে দেখার জন্য, ইমামকে জানানো হল যে, গেটে আপনার ছাত্র মালিক, ইমাম বললেন : ভিতরে আসতে বল। ইমাম মালিক বলেন, আমি ©র্ভতরে গেলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মনে হয় তুমি সালাতের পর বাড়ীতে যাওনি? আমি বললাম : হ্যাঁ যাইনি, জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু খেয়েছ কি? আমি বললাম : না, তিনি বললেন : খাও, আমি বললাম : খাওয়ার চাহিদা নেই। তিনি বললেন, তাহলে তুমি কি চাও? আমি বললাম : আমাকে হাদীস শিখান, অতঃপর তিনি আমাকে সতেরটি হাদীস শিখালেন।[13]
ইমাম মালিক (রহ.) বেশীভাগ সময় একাকী থাকা পছন্দ করতেন, তাঁর বোন পিতার কাছে অভিযোগ করলেন, আমাদের ভাই মানুষের সাথে চলাফিরা করে না। পিতা জবাব দিলেন : মা তোমার ভাই রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীস মুখস্ত করায় ব্যস্ত, তাই একাকী থাকা পছন্দ করে।[14]
হাদীস সংগ্রহে কঠোর সতর্কতা:
ইমাম মালিক (রহ.) হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে সদা ব্যস্ত হলেও যেখানেই বা যার কাছেই হাদীস পেলে তিনি তা গ্রহণ করতেন না, যতক্ষণ না হাদীস বর্ণনাকারীর ঈমান-আক্বীদাহ ও সততা সম্পর্কে অবগত হতে পারতেন। বিশ্বস্ত প্রমাণিত হলে হাদীস গ্রহন করতেন। ইমাম সুফাইয়ান ইবনু উইয়ায়না (রহ.) বলেন : ‘‘আল্লাহ তা’আলা ইমাম মালিককে রহম করুন, তিনি হাদীসের বর্ণনাকারীর ব্যাপারে খুব কঠিনভাবে যাচাই বাছাই করতেন (সহজেই কারো হাদীস গ্রহণ করতেন না)।’’ আলী বিন মাদীনী (রহ.) বলেন : ‘‘হাদীস গ্রহণে কঠোর নীতি ও সতর্কতায় ইমাম মালিকের ন্যায় আর কেউ আছে বলে আমি জানিনা।’’[15] ইমাম মালিক বিদ’আতীদের থেকে হাদীস গ্রহণ করতেন না।[16] এ সতর্কতা শুধু তিনি নিজেই অবলম্বন করেন নি, বরং তিনি অন্যদেরকেও গুরুত্বারোপের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন :
‘‘হাদীস হল দ্বীনের অন্যতম বিষয়, অতএব ভালভাবে লক্ষ কর তোমরা কার নিকট হতে দ্বীন গ্রহণ করছ। আমি সত্তর জন এমন ব্যক্তি পেয়েছি যারা রাসূল (ছাঃ)-এর নামে হাদীস বর্ণনা করে, কিন্তু আমি তাদের কিছুই গ্রহণ করিনি। যদিও তারা অর্থ সম্পদে আমানতদার হয়, কিন্তু এ বিষয়ে তাদেরকে আমি যোগ্য মনে করিনি। অথচ আমাদের মাঝে ইমাম যুহুরীর আগমন হলে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে আমরা তাঁর দরবারে ভীর জমাতাম’’।[17]
সুতরাং ইমামু দারিল হিজরা বা মাদীনার ইমাম মালিক (রহ.) রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে যেমন জীবন উৎসর্গ করেছেন, তেমনি হাদীস সংরক্ষণে খুব কঠোর ভূমিকা রেখেছেন।
হাদীস পালনে ইমাম মালিক (রহ.):
হাদীস শুধু কিতাবের পাতায় নয়, বরং তা বাস্তবে পালনের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলেন ইমাম মালিক (রহ.)। আব্দুল্লাহ বিন বুকাইর বলেনঃ আমি ইমাম মালিককে বলতে শুনেছি তিনি বলেন : ‘‘আমি কোন আলিমের কাছে যখন বসেছি। অতঃপর তার কাছ হতে বাড়ীতে আসলে তার কাছে শুনা সব হাদীস মুখস্ত করে ফেলি এবং ওই হাদীসগুলির মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত বা আমল না করা পর্যন্ত ওই আলিমের বৈঠকে ফিরে যাইনি।’’[18]
হাদীস শিক্ষাদান ও ফতোয়া প্রদান:
ইমাম মালিক (রহ.) শুধু হাদীস শিক্ষা ও আমল করেই ক্ষান্ত হননি, বরং শিক্ষার পাশাপাশি মানুষকে শিক্ষা দান ও ফতোয়া প্রদানে বিড়াট অবদান রেখেছেন। ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন : ইমাম মালিক (রহ.) ২১ বছর বয়সে হাদীসের পাঠদান ও ফতোয়া প্রদানে পূর্ণ যোগ্যতা লাভ করেন।[19] ইমাম মালিক (রহ.) বলেন : ইচ্ছা করলেই শুধু হাদীস শিক্ষা ও ফতোয়া প্রদানের জন্য মসজিদে বসা যায় না, রবং এ ক্ষেত্রে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিতে হবে, তারা যদি উপযুক্ত মনে করেন তাহলে এ কাজের জন্য নিয়োজিত হতে পারে। সত্তর জন বিজ্ঞ পন্ডিত- শাইখের আমার ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদানের পর আমি এ কাজে নিয়োজিত হই।[20] মুস্‘আব বিন আব্দুল্লাহ বলেন : ‘‘ইমাম মালিককে কোন হাদীস জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অযূ করে ভাল পোষাক পড়ে সুন্দরভাবে প্রস্ত্ততি নিতেন, তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাবে বলেন : এ হল রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীসের জন্য সম্মান প্রদর্শন।’’[21] সারা মুসলিম বিশ্ব হতে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র মদীনায় জ্ঞান পিপাসুরা শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান এবং ইমাম মালিকের মত মুহাদ্দিসের নিকট হতে হাদীস শিক্ষালাভ করে ধন্য হতেন।
ইমাম মালিক (রহ.) ফতোয়া প্রদানেও যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করতেন। জটিল বিষয়গুলো দীর্ঘ গবেষণার পর ফতোয়া প্রদান করতেন। ইবনু আব্দুল হাকীম বলেন : ‘‘ইমাম মালিককে (রহ.) কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি প্রশ্নকারীকে বলতেন যাও আমি ওই বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করি।’’ আব্দুর রহমান বিন মাহদী বলেন : ইমাম মালিক বলেন, ‘‘কখনও এমন মাস‘আলা এসেছে যে, চিন্তা-গবেষণা করতে আমার গোটারাত কেটেগেছে।’’[22] ইমাম মালিক (রহ.) কোন বিষয় উত্তর না দেয়া ভাল মনে করলে ‘‘জানি না’’ বলতেও কোন দ্বিধাবোধ করতেন না।[23] কারণ তিনি মনে করতেন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া মানে জান্নাত ও জাহান্নামের সম্মুখীন হওয়া। প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যেন আখিরাতে জবাব দিহিতার সম্মুখীন হতে না হয়।[24]
সঠিক আক্বীদাহ বিশ্বাসে ইমাম মালিক (রহ.) : আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বীদাহ-বিশ্বাসের অন্যতম ইমাম হলেন ইমাম মালিক (রহ.)। বিশেষ করে আল্লাহ তা’আলার সিফাত গুণাবলীর প্রতি ঈমানের যে ক্বায়দা বা নীতি ইমাম মালিক (রহ.) মুতাযিলাদের প্রতিবাদে বর্ণনা করেন, সেটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি। যেমন ইমাম ইবনু আবিল ইয্ আল হানাফী শারহুল আক্বীদাহ আত তাহাবিয়ায় উল্লেখ করেন।[25] কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসের আলোকে ইমাম মালিক (রহ.) ঈমান আক্বীদাহর সকল বিষয়ে হকপন্থীদের সাথে একমত ছিলেন।[26]
ইমাম মালিক (রহ.) সম্পর্কে আলিম সমাজের প্রশংসা :
১. ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেন : ‘‘আলিম সমাজের আলোচনা হলে ইমাম মালিক তাদের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র, কেউ ইমাম মালিকের স্মৃতিশক্তি, দৃঢ়তা, সংরক্ষণশীলতা ও জ্ঞানের গভীরতার সমপর্যায় নয়। আর যে ব্যক্তি সহীহ হাদীস চায় সে যেন ইমাম মালিকের কাছে যায়।’’[27]
২. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) বলেন : ‘‘বিদ্যানদের অন্যতম একজন ইমাম মালিক, তিনি হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে একজন অন্যতম ইমাম, জ্ঞান-বুদ্ধি ও আদাব আখলাকসহ হাদীসের প্রকৃত অনুসারী ইমাম মালিকের মত আর কে আছে?’’[28]
৩. ইমাম নাসাঈ (রহ.) বলেন : ‘‘তাবেঈদের পর আমার কাছে ইমাম মালিকের চেয়ে অধিক বিচক্ষণ আর কেউ নেই এবং হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে অধিক আমানতদার আমার কাছে আর কেউ নেই।’’[29]
ইমাম মালিকের (রহ.) গ্রন্থাবলী:
ইমাম মালিক (রহ.)-এর বেশ কিছু রচনাবলী রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল :
১. আল মুয়াত্ত্বা।[30] হাদীসের জগতে কিছু ছোট ছোট সংকলন শুরু হলেও ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্ত্বা’ সর্ব প্রথম হাদীসের উল্লেখযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য সংকলন। এ গ্রন্থে ইমাম মালিক (রহ.) রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীস, সাহাবী ও তাবেঈদের হাদীস এবং মদীনাবাসীর ইজমা সহ অনেক ফিকহী মাসআলা বিশুদ্ধ সনদের আলোকে সংকলন করেন। তিনি দীর্ঘদিন সাধনার পর, কেউ বলেন চল্লিশ বৎসর সাধনার পর এ মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন। সে সময় বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে হাদীসের গ্রন্থ ‘মুয়াত্ত্বা’ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন : ‘‘কিতাবুল্লাহ অর্থাৎ কুরআন এর পরই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ হল ইমাম মালিকের ‘‘মুয়াত্ত্বা’’।[31] হ্যাঁ, সহীহ বুখারীর সংকলনের পূর্বে মুয়াত্ত্বাই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ ছিল। অবশ্য এখন সহীহ বুখারী সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ।
২. ‘‘কিতাবুল মানাসিক’’,[32]
৩. ‘‘রিসালাতুন ফিল কাদ্র ওয়ার্রাদ আলাল কাদারিয়া’’।[33]
৪. ‘‘কিতাব ফিন্নুজুমি ওয়া হিসাবি মাদারিয্যামানি ওয়া মানাযিলিল কামারি’’।[34]
৫. ‘‘কিতাবুস্সিররি’’।[35]
৬. ‘‘কিতাবুল মাজালাসাত’’।[36] ইত্যাদি সহীহ সনদে প্রমাণিত যে, এ সব ইমাম মালিক (রহ.)-এর সংকলিত ও রচিত গ্রন্থ। ইহা ছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থ রয়েছে।[37]
ইমাম মালিক (রহ.)-এর মৃত্যুবরণ : ইমাম মালিক (রহ.) ১৭৯ হিঃ রবিউল আউয়াল মাসে ৮৬ বছর বয়সে মদীনা মুনাওয়ারায় মৃত্যুবরণ করেন। এবং তাকে মদীনার কবরস্থান ‘‘বাকী’’তে দাফন করা হয়।[38] আল্লাহ তাঁকে রহম করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দান করুন। আমীন!
– আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী

[1] তারতীবুল মাদারিক, ১/১০২ পৃঃ, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৪৮ পৃঃ, আল-আনসাব লিস্সাম আনী, ১/২৮৭ পৃঃ, আত্-তামহীদ, ১/৮৯ পৃঃ, মানাকিব মালিক লিয্যাওয়াবী, ১৬০-১৬২ পৃঃ, আল-ইনতিকা, ৯-১১ পৃঃ ইত্যাদি।
[2] তারতীবুল মাদারিক, ১/১১০ পৃঃ, মানাকিব মালিক লিয্যাওয়াবী, ১৫৯ পৃঃ।
[3] মান্হাজু ইমাম মালিক, ২২ পৃঃ।
[4] তারতীবুল মাদারিক, ১/১০৭ পৃঃ।
[5] আল ইসাবাহ ৭/২৯৮ পৃঃ।
[6] তারতীবুল মাদারিক, ১/১১৯ পৃঃ।
[7] সিয়ারা আলামুন্নুবালা, ৮/৪৯ পৃঃ।
[8] সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৪৯-৫১ পৃঃ।
[9] তারতীবুল মাদারিক, ১/২৫৪ পৃঃ। সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৫২ পৃঃ।
[10] সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৫২-৫৪ পৃঃ।
[11] আত্-তামহীদ, ১/৮১ পৃঃ।
[12] আত্তামহীদ, ১/৭৬-৭৯ পৃঃ, আল-হুলিয়াহ, ৬/৩২৯ পৃঃ, অবশ্য এ মন্তব্য সহীহ বুখারীর পূর্বে, সহীহ বুখারী সংকলনের পর বুখারী সর্ববিশুদ্ধ গ্রন্থ।
[13] তারতীবুল মাদারিক, ১/১২১ পৃঃ।
[14] তারতীবুল মাদারিক, ১/১১৯ পৃঃ।
[15] আল ইরশাদ লিল খালিলী, ১/১১০-১১২ পৃঃ।
[16] আল মুহাদ্দিস আল ফাসিল, (৪১৪-৪১৬) পৃঃ, আল ইনতিকা ১৬ পৃঃ, আত্-তামহীদ, ১/৬৭ পৃঃ।
[17] আল মুহাদ্দিস আল ফাসিল, (৪১৪-৪১৬) পৃঃ, আল ইনতিকা ১৬ পৃঃ, আত্-তামহীদ, ১/৬৭ পৃঃ।
[18] ইত্হাফুস সালিক দ্রঃ মানহাজু ইমাম মালিক, ৩৪ পৃঃ।
[19] সিয়ারু আলামিন্নুবালা, ৮/৫৫ পৃঃ।
[20] আল-হুলিইয়্যাহ, ৬/৩১৬ পৃঃ।
[21] তার তীবুল মাদারিক, ১/১৫৪ পৃঃ।
[22] আল ইনতিকা, ৩৭-৩৮ পৃঃ।
[23] তায্ইনুল মামালিক, ১৬-১৭ পৃঃ।
[24] আল ইনতিকা, ৩৭ পৃঃ।
[25] শারহুল আক্বীদাহ আত তাহাবীয়াহ, ১/১৮৮ পৃঃ।
[26] বিস্তারিত দ্রঃ মানহাজুল ইমাম ফি ইছবাতিল আক্বীদাহ- ডঃ সউদ বিন আব্দুল আযীয আদ দা‘জান।
[27] আল ইনতিকা, ২৩, ২৪ পৃঃ।
[28] তারতীবুল মাদারিক, ১/১৩৩ পৃঃ।
[29] আল্ ইনতিকা, ৩১ পৃঃ।
[30] তানাবীরুল হাওয়ালিক, ১/৭ পৃঃ।
[31] তারতীবুল মাদারিক, ১/১৯১-১৯৬ পৃঃ, আত্তামহীদ, ১/৭৬-৭৯ পৃঃ।
[32] তায্ইনুল মামালিক, ৪০ পৃঃ, মালিক লি আমীন আল খাওলী, ৭৪৫ পৃঃ।
[33] তারতীবুল মাদারিক, ১/২০৪ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৮৮ পৃঃ।
[34] তারতীবুল মাদারিক, ১/২০ ৫ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৮৮ পৃঃ।
[35] তারতীবুল মাদারিক, ১/২০৫ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৮৯ পৃঃ।
[36] তাযইনুল মামালিক, ৪০ পৃঃ, মালিক লি আমীন আল খাওলী, ৭৪৬ পৃঃ।
[37] মানহাজু ইমাম মালিক ফি ইছবাতিল আকীদাহ, ৫১-৫৫ পৃঃ।
[38] আত্তামহীদ, ১/৯২ পৃঃ, তারতীবুল মাদারিক, ২/২৩৭-২৪১ পৃঃ, সিয়ারু আলামিন্নুবালা, ৮/১৩০-১৩৫ পৃঃ।

দাওয়াতি কাজ সকল মুসলিমের জন্য ফরজ এবং সাধারণ মানুষদের দাওয়াতি কাজের কতিপয় পদ্ধতি

  ▬▬▬✪✪✪▬▬▬ প্রশ্ন: সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ কি সবার উপরে ফরজ? যাদের দ্বীনের জ্ঞান নেই যেমন জেনারেল লাইনে পড়া মানুষ কিন্তু দ্বীন জানার...