Monday, September 24, 2018

নূর মুহাম্মাদীই (সা.) প্রথম সৃষ্টি


নূর মুহাম্মাদীই (সা.) প্রথম সৃষ্টি
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট
‘নূর মুহাম্মাদী প্রথম সৃষ্টি’ অর্থে নিম্নের হাদীসটি সমাজে বহুল প্রচলিত:
أّوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرِيْ
“আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন”।
সুদীর্ঘ হাদীসটির সার সংক্ষেপ হলো, জাবির (রা) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেন? উত্তরে তিনি বলেন:
أوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرَ نَبِيِّك مِنْ نُوْرِهِ….
“সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তাঁর নূর থেকে সৃষ্টি করেন।” এরপর এ লম্বা হাদীসে উলে­খ করা হয়েছে যে, এ নূরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে তা থেকে আরশ, কুরসী, লাওহ, কলম, ফিরিশতা, জিন, ইনসান এবং সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টি করা হয়।….
এ হাদীসটির অর্থ ইতোপূর্বে উদ্ধৃত সহীহ মুসলিমের হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, তাতে বলা হয়েছে: ফিরিশতাগণ নূর থেকে, জিনগণ আগুন থেকে এবং মানুষ মাটি থেকে সৃষ্ট। আর এ হাদীসে বলা হচ্ছে যে, ফিরিশতা, জিন, ইনসান ও মহাবিশ্বের সব কিছুই নূর থেকে সৃষ্ট। তারপরও এ হাদীসটির বক্তব্য আমাদের কাছে আকর্ষণীয়। যদি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামে মিথ্যা বলার বা যা শুনব তাই বলার অনুমতি থাকতো তবে আমরা তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতাম ও বলতাম। কিন্তু যেহেতু তা নিষিদ্ধ তাই কুরআন ও সুন্নাহ-এর নির্দেশ অনুসারে আমরা সনদ অনুসন্ধান করতে বাধ্য হই এবং নিম্নের বিষয়গুলি জানতে পারি:
(ক) বিশ্বে বিদ্যমান কোনো হাদীস গ্রন্থে হাদীসটি সনদ-সহ পাওয়া যায় না। আমরা বলেছি, একটি হাদীস সাধারণত অনেকগুলি হাদীসের গ্রন্থে সনদ-সহ সংকলিত থাকে। কিন্তু এ হাদীসটি কোনো হাদীস গ্রন্থেই সংকলিত হয় নি।
(খ) আমরা দেখেছি যে, ইতিহাস, সীরাত, আকীদা, তাসাউফ, ওয়ায ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থগুলিতেও বহুসংখ্যক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস সনদবিহীন বা সনদ-সহ সংকলিত। ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরের মধ্যে এ সকল বিষয়ক কোনো একটি গ্রন্থেও এ হাদীসটির কোনো উলে­খ নেই।
(গ) যতটুকু জানা যায়, ৭ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম মুহিউদ্দীন ইবনু আরাবী আবূ বাক্র মুহাম্মাদ ইবনু আলী তাঈ হাতিমী (৫৬০-৬৩৮হি /১১৬৫-১২৪০খৃ) সর্বপ্রথম এ কথাগুলোকে ‘হাদীস’ হিসেবে উলে­খ করেন। প্রসঙ্গত উলে­খ্য যে, ইবনু আরাবী তাঁর পুস্তকাদিতে অগণিত জাল হাদীস ও বাহ্যত ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক কথা উলে­খ করেছেন। পরবর্তী যুগে বুযুর্গগণ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বশত এ সকল কথার বিভিন্ন ওযর ও ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আবার অনেকে কঠিনভাবে আপত্তি করেছেন।
বিশেষত মুজাদ্দিদে আলফে সানী শাইখ আহমাদ ইবনু আব্দুল আহাদ সারহিন্দী (১০৩৪ হি) ইবনু আরাবীর এ সকল ভিত্তিহীন বর্ণনার প্রতিবাদ করেছেন বারংবার। কখনো কখনো নরম ভাষায়, কখনো কঠিন ভাষায়। এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন : “আমাদের নস্স বা কুরআন ও হাদীসের পরিষ্কার অকাট্য বাণীর সহিত কারবার, ইবন আরাবীর কাশফ ভিত্তিক ফস্স বা ফুসূসুল হিকামের সহিত নহে। ফুত‚হাতে মাদানীয়া বা মাদানী নবী সা. -এর হাদীস আমাদেরকে ইবন আরাবীর ফত‚হাতে মাক্কীয়া জাতীয় গ্রন্থাদি থেকে বেপরওয়া করিয়া দিয়াছেন।” অন্যত্র প্রকৃত সূফীদের প্রশংসা করে লিখেছেন : “তাহারা নসস, কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বাণী, পরিত্যাগ করত শেখ মহিউদ্দীন ইবন আরাবীর ফসস বা ফুসূসুল হিকাম পুস্তকে লিপ্ত হন না এবং ফুত‚হাতে মাদানীয়া, অর্থাৎ হাদীস শরীফ বর্জন করত ইবন আরাবীর ফুত‚হাতে মাক্কীয়ার প্রতি লক্ষ্য করেন না।” “… নস্স বা আল­াহর বাণী পরিত্যাগ করত ফসস বা মহিউদ্দীন আরবীর পুস্তক আকাক্সক্ষা করেন না এবং ফত‚হাতে মাদানীয়া বা পবিত্র হাদীস বর্জন করত ফুত‚হাতে মাক্কিয়া পুস্তকের দিকে লক্ষ্য করেন না।”
সর্বাবস্থায়, ইবনু আরাবী এ বাক্যটির কোনো সূত্র উলে­খ করেন নি। কিন্তু তিনি এর উপরে তাঁর প্রসিদ্ধ সৃষ্টিতত্তে¡র ভিত্তি স্থাপন করেন। খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের লগোস তত্তে¡র (ঞযবড়ৎু ড়ভ খড়মড়ং) আদলে তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী তত্ত¡’ প্রচার করেন। খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, আল্লাহ সর্বপ্রথম তার নিজের ‘জাত’ বা সত্তা থেকে ‘কালেমা’ বা পুত্রকে জন্মদান করেন, পুত্র ‘নূর থেকে জাত নূর’ (ষরমযঃ ড়ভ ষরমযঃ) এবং পুত্র থেকেই আল্লাহ সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন। ইবনু আরাবী বলেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম নূর মুহাম্মাদী সৃষ্টি করেন এবং তার থেকে সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন। ক্রমান্বয়ে কথাটি ছড়াতে থাকে। বিশেষত ৯/১০ম হিজরী শতক থেকে লেখকগণের মধ্যে যাচাই ছাড়াই অন্যের কথার উদ্ধৃতির প্রবণতা বাড়তে থাকে। শ্রদ্ধাবশত, ব্যস্ততা হেতু অথবা অন্যান্য বিভিন্ন কারণে নির্বিচারে একজন লেখক আরেকজন লেখকের কাছ থেকে গ্রহণ করতে থাকেন। যে যা শুনেন বা পড়েন তাই লিখতে থাকেন, বিচার করার প্রবণতা কমতে থাকে। এভাবে বিগত কয়েক শতক যাবৎ সীরাত, মীলাদ, তাসাউফ, ওয়ায ইত্যাদি বিষয়ক অগণিত গ্রন্থে এ হাদীসটি উদ্ধৃত করা হয়।
(ঘ) যতদূর জানা যায় সর্বপ্রথম দশম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম হাদীসটি মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এ বিদ্যমান বলে মন্তব্য করেন। অর্থাৎ ইবনু আরাবীর পূর্বে ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসর এ হাদীসটি কেউ উলে­খই করেন নি। হাদীসটির অর্থ অত্যন্ত আকর্ষণীয় হওয়াতে পরবর্তী ৩০০ বৎসরে হাদীসটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। কিন্তু এর কোনো সনদ বলা তো দূরের কথা হাদীসটি কোন্ গ্রন্থে সংকলিত তাও কেউ বলতে পারেন নি। এরপর থেকে কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, হাদীসটি বাইহাকী বা আব্দুর রায্যাক সান‘আনী সংকলন করেছেন। এ দাবিটি ভিত্তিহীন। আব্দুর রায্যাক সান‘আনী বা বাইহাকী রচিত কোনো গ্রন্থে এ হাদীসটি নেই। দশম শতকের প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-কাসতালানী (৯২৩ হি) তাঁর রচিত প্রসিদ্ধ সীরাত-গ্রন্থ ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থে এ হাদীসটি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে’ সংকলিত রয়েছে বলে উলে­খ করেছেন। তার বক্তব্যের উপর নির্ভর করে এরপর অনেকেই লিখেছেন যে, হাদীসটি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে’ সংকলিত। কিন্তু বিশ্বের সর্বত্র বিদ্যমান মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক গ্রন্থের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি এবং ছাপানো গ্রন্থে কোথাও এ হাদীসটি নেই। লক্ষণীয় যে, যারা হাদীসটি মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে সংকলিত বলে উলে­খ করেছেন তাঁরা কেউই হাদীসটির কোনো সনদ উলে­খ করেন নি, সনদ বিচার তো দূরের কথা।
(ঙ) দশম শতক থেকেই অনেক আলিম নিশ্চিত করেছেন যে, এ হাদীসটি ভিত্তিহীন, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক বা অন্য কোনো গ্রন্থে তা নেই। ইমাম সুয়ূতী, শাইখ আব্দুল্লাহ গুমারী, শাইখ আহমাদ গুমারী, শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী, শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ ও অন্যান্য প্রাচীন, সমকালীন, সালাফী ও সূফী সকল মতের মুহাদ্দিস একমত যে, এ কথাটি হাদীস নয়; কোনো হাদীসের গ্রন্থে এর অস্তিত্ব নেই। ইমাম কাসতালানীর সমসাময়িক প্রসিদ্ধ আলিম ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি)। তিনি এ হাদীসটির কোনো সনদ খুঁজে না পেয়ে লিখেন:
ليس له إسناد يعتمد عليه
“এ হাদীসটির কোনো সনদ নেই যার উপর নির্ভর করা যায়।”
(চ) বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সূফী ও মুহাদ্দিস আল্লামা শাইখ আবুল ফাইয আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুস সিদ্দীক গুমারী (১৩৮০/১৯৬০) এবং আল্লামা শাইখ আবুল ফাদল আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুস সিদ্দীক গুমারী (১৪১৩/১৯৯৩)। তাঁদের দাদা সাইয়িদ মুহাম্মাদ সিদ্দীক ইবন আহমাদ হাসানী মরোক্কোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সূফী, পীর ও ওলী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁদের পিতা মুহাম্মাদ ইবনুস সিদ্দীক পিতার স্থলাভিষিক্ত প্রসিদ্ধ পীর, মুহাদ্দিস এবং ‘যাবিয়া সিদ্দীকিয়া’ বা ‘সিদ্দীকিয়া খানকা’-র পরিচালক ছিলেন। তাঁরা উভয়েই মুহাদ্দিস, ফকীহ ও তাসাউফের ইমাম বলে সুপরিচিত। তাঁরা সকলেই তাসাউফ, আকীদা, হাদীস ও ফিকহে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সালাফীগণ ও শাইখ আলবানীর বিরুদ্ধে তাঁরা অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তবে এ হাদীসের জালিয়াতির বিষয়ে তাঁরা ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
শাইখ আহমাদ গুমারী ইমাম সুয়ূতীর ‘জামি-সাগীর’ গ্রন্থে বিদ্যমান জাল হাদীস বিষয়ে ‘আল-মুগীর আলাল আহাদীসিল মাউদূআতি ফিল জামিয়িস সাগীর’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি এ হাদীসটি প্রসঙ্গে বলেন:
وهو حديث موضوع، لو ذكره بتمامه لما شك الواقف عليه في وضعه، وبقيته تقع في نحو ورقتين من القطع الكبير مشتملة على ألفاظ ركيكة ومعان منكرة
“‘হাদীসটি জাল। যদি পুরো হাদীসটি উলে­খ করা হয় তবে পাঠক হাদীসটির জালিয়াতি সম্পর্কে কোনো সন্দেহ করবেন না। হাদীসের অবশিষ্ট বক্তব্য বৃহদাকৃতির প্রায় দু পৃষ্ঠা, যার মধ্যে অনেক অসংলগ্ন ফালতু কথা এবং আপত্তিকর অর্থ বিদ্যমান।”
শাইখ আব্দুল­াহ গুমারী মীলাদ মাহফিলের পক্ষে অনেক প্রমাণ পেশ করেছেন। পাশাপাশি মীলাদ মাহফিলে জাল হাদীস আলোচনার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। মীলাদ মাহফিলের জাল হাদীস প্রসঙ্গে রচিত ‘ইরশাদুত তালিবিন নাজীব ইলা মা ফিল মাওলিদিন নাবাবী মিনাল আকাযীব’ বইয়ে তিনি বলেন:
منها وهو أشهرها حديث: أول ما خلق الله نور نبيك من نوره يا جابر، عزاه السيوطي في الخصائص الكبرى لمصنف عبد الرزاق، وقال في الحاوي … ليس له إسناد يُعتمد عليه. وهذا تساهل كبير من السيوطي، كنتُ أنزهه عنه. أما أولاً: فالحديث غير موجود في مصنف عبد الرزاق ولا في شيء من كتب الحديث. أما ثانياً: فإن الحديث لا إسناد له أصلا. وأما ثالثاً: فإنه ترك بقية الحديث، وهي مذكورة في تاريخ الخميس للديار بكري، ومن قرأها يجزم بأن الحديث مكذوب على رسول الله . وجاء شخص فيلالي من ذرية الشيخ محمد بن ناصر الدرعي، فألف كتاباً … أتى فيه بطامة كبرى! حيث قال في أوله: .. حديث الإمام عبد الرزاق في مصنفه الشهير، عن سفيان بن عيينة، عن زيد بن أسلم أحد أعلام المدينة، عن محمد بن المنكدر شيخ الزهري، عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما … وقد تعجبت من وقاحة هذا الشخص وجرأته، حيث صنع هذا الإسناد الصحيح لحديث لا يوجد في مصنف عبد الرزاق ولا غيره من كتب الحديث المسندة!
“মীলাদ মাহফিলের জাল হাদীসগুলির অন্যতম: ‘হে জাবির আল­াহ সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূর তাঁর নূর থেকে সৃষ্টি করেন। সুয়ূতী খাসাইসুল কুবরা গ্রন্থে বলেন: হাদীসটি মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে সংকলিত এবং ‘হাবী গ্রন্থে সুয়ূতী বলেন: হাদীসটির নির্ভরযোগ্য কোনো সনদ নেই। এ বক্তব্যটি সুয়ূতীর পক্ষ থেকে বড় রকমের অবহেলা ও ঢিলেমি। সুয়ূতী এতবড় অবহেলা করবেন আমি তা মনে করতাম না। কারণ, প্রথমত: মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক বা হাদীসের অন্য কোনো গ্রন্থে এ হাদীসটি নেই। দ্বিতীয়ত: হাদীসটির একেবারেই কোনো সনদ নেই। তৃতীয়ত: সুয়ূতী হাদীসটির অবশিষ্ট বক্তব্য উলে­খ করেন নি। (হুসাইন ইবন মুহাম্মাদ) দিয়ারবাকরী (৯৬৬ হি) রচিত ‘তারীখ খামীস’ নামক গ্রন্থে হাদীসটির অবশিষ্ট বক্তব্য বিদ্যমান। যদি কেউ হাদীসে অবশিষ্ট অংশ পাঠ করেন তবে নিশ্চিত হবেন যে, হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর নামে জাল করা। শাইখ মুহাম্মাদ নাসির দারয়ীর বংশধর এক ব্যক্তি একটি গ্রন্থ রচনা করে… এতে সে এক ভয়ঙ্কর মহাপাপ করে..। সে বলে হাদীসটি ইমাম আব্দুর রায্যাক সুফইয়ান ইবন উআইনা থেকে, তিনি যাইদ ইবন আসলাম থেকে তিনি মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির থেকে, তিনি জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। … আমি এ ব্যক্তির অসভ্যতা ও দুঃসাহস দেখে অবাক হই! মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক বা অন্য কোনো হাদীস গ্রন্থে যে হাদীসের অস্তিত্ব নেই সে হাদীসের জন্য সে কিভাবে একটি সহীহ সনদ জাল করল!”
এ হাদীসটির জালিয়াতি সম্পর্কে রচিত পুস্তক ‘মুরশিদুল হায়ির লিবায়ানি ওয়াদয়ি হাদীসি জাবির’ নামক পুস্তকে তাঁর দীর্ঘ বক্তব্য আমাদের গ্রন্থের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। আমি তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:
وبعد: فهذا جزء… أردت به تنزيه النبيّ  عمّا نُسب إليه مما لم يصح عنه ويعدُّ من قبيل الغلو المذموم، ومع ذلك صار عند العامة وكثير من الخاصة معدودًا من الفضائل النبويّة التي يكون إنكارها طعنًا في الجناب النبويّ عندهم، ولا يدركون ما في رأيهم وقولهم من الإثم العظيم الثابت في قول النبيّ : “من كذب عليَّ فليتبوأ مقعده من النار” … ولا يكون مدحه  شافعًا له في الكذب عليه. وإن كانت الفضائل يتسامح فيها فإن فضائل النبي  إنما تكون بالثابت المعروف حذرًا من الكذب المتوعَّد عليه بالنار… … روى عبد الرزاق -فيما قيل- عن جابر رضي الله عنه … الحديث، … وقد ذكره بتمامه ابن العربي الحاتمي في كتاب “تلقيح الأذهان ومفتاح معرفة الإنسان”، والديار بكري في كتاب “الخميس في تاريخ أنفس نفيس”. وعزْوه إلى رواية عبد الرزاق خطأ لأنه لا يوجد في مصنفه ولا جامعه ولا تفسيره. … وهو حديث موضوع جزمًا، وفيه اصطلاحات المتصوفة، وبعض الشناقطة المعاصرين ركّب له إسنادًا فذكر أن عبد الرزاق رواه من طريق ابن المنكدر عن جابر وهذا كذب يأثم عليه. وبالجملة فالحديث منكر موضوع لا أصل له في شىء من كتب السُّنّة. … وكونه  نورًا أمر معنوي، مثل تسمية القرءان نورًا ونحو ذلك، لأنه نوّر العقول والقلوب. ومن الكذب المكشوف قولهم: لولاك لولاك ما خلقت الأفلاك، وروي في بعض كتب المولد النبوي عن أبي هريرة قال: سأل النبيّ صلى الله عليه وسلم جبريل عليه السلام فقال: يا جبريل كم عمّرتَ من السنين؟ … أنا ذلك الكوكب. وهذا كذب قبيح، قبّح الله من وضعه وافتراه. وذكر بعض غلاة المتصوّفة أن جبريل عليه السلام كان يتلقّى الوحي من وراء حجاب وكُشف له الحجاب مرة فوجد النبيّ  يوحي إليه فقال جبريل: منك وإليك. قلت: لعن الله من افترى هذا الهراء … ما يوجد في كتب المولد النبويّ من أحاديث لا خطام لها ولا زمام هي من الغلو الذي نهى الله ورسوله عنه، فتحرم قراءة تلك الكتب، ولا يقبل الاعتذار عنها بأنّها في الفضائل لأن الفضائل يتساهل فيها برواية الضعيف، أمّا الحديث المكذوب فلا يقبل في الفضائل إجماعًا، بل تحرم روايته )إلا مع بيان أنه موضوع(…. وفضل النبي  ثابت في القرءان الكريم، والأحاديث الصحيحة، وهو في غنى عما يقال فيه من الكذب والغلو، وقال :”لاتطروني كما أطرت النصارى عيسى فإنما أنا عبد فقولوا عبد الله ورسوله”.
“এ পুস্তিকাটি আমি রচনা করেছি… উদ্দেশ্য হলো অশুদ্ধ হাদীসগুলি থেকে রাসূলুল­াহ -কে পবিত্র করা। এ সকল হাদীস নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় বাড়াবাড়ির অন্তর্ভুক্ত। তা সত্তে¡ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে এবং অনেক আলিম-বুজুর্গের মধ্যে কথাগুলি নবীজী (সা.)-এর ফযীলত বলে গণ্য। এগুলি খণ্ডন করা বা প্রতিবাদ করাকে তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে বেয়াদবী ও নিন্দা বলে গণ্য করেন। তাঁরা বুঝেন না যে, তাঁদের কথা ও মতের মধ্যে কী ভয়ঙ্কর পাপ বিদ্যমান। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আমার নামে যে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে অবস্থান করতে হবে।” … তাঁর প্রশংসা বা মর্যাদা বাড়ানো তাঁর নামে মিথ্যার কোনো অযুহাত হতে পারে না। যদিও ফযীলত বা সাওয়াব বা মর্যাদা বিষয়ক হাদীসের বিষয়ে কিছু ঢিল দেওয়া হয়, তবে তা অবশ্যই পরিচিত ও প্রমাণিত হাদীস দ্বারা হতে হবে। তাঁর নামে মিথ্যা বলে জাহান্নামী হওয়ার ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে। … বলা হয় যে, আব্দুর রায্যাক জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন….। ইবনু আরাবী হাতিমী ‘তালকীহুল আযহান ওয়া মিফতাহু মা’রিফাতিল ইনসান’ গ্রন্থে এবং দিয়ারবাকরী ‘খামীস ফি তারীখ আনফাস নাফীস’ গ্রন্থে এ হাদীসটির পুরো বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। আব্দুর রায্যাক হাদীসটি বর্ণনা করেছেন বলে যারা উলে­খ করেছেন তাদের কথা সঠিক নয়। কারণ তাঁর মুসান্নাফ গ্রন্থে, জামি গ্রন্থে বা তাফসীর গ্রন্থে এ হাদীসটির কোনো অস্তিত্ব নেই। … হাদীসটি যে জাল সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ হাদীসের মধ্যে (কয়েক শতক পরে উদ্ভাবিত) সূফীগণের পরিভাষা বিদ্যমান। বর্তমান যুগের একজন শানকীতী আলিম এ হাদীসের জন্য একটি জাল সনদ তৈরি করেছেন। তিনি লিখেছেন হাদীসটি আব্দুর রায্যাক ইবনুল মুনকাদিরের সূত্রে জাবির থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ মিথ্যাচারের জন্য তিনি পাপী হবেন। মোট কথা হাদীসটি আপত্তিকর জাল হাদীস। হাদীসের গ্রন্থগুলিতে এর কোনোরূপ অস্তিত্ব বা উৎস পাওয়া যায় না।….. আর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নূর হওয়ার অর্থ তিনি বিমূর্ত ও রূপক অর্থে নূর। যে অর্থে কুরআন এবং অন্যান্য বিষয়কে নূর বলা হয়। কারণ তিনি জ্ঞান, বিবেক ও হৃদয়ের নূর।
এ জাতীয় আরেকটি প্রকাশ্য মিথ্যা কথা: “আপনি না হলে আমি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম না।’ মীলাদের গ্রন্থে কোনো কোনো লেখক লিখেছেন, আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল­াহ  জিবরাঈল (আ)-কে বলেন, হে জীবরাঈল, আপনার বয়স কত? ….. আমিই সেই তারকা’। এটি একটি জঘন্য মিথ্যা, যে এটি বানিয়েছে আল­াহ তাঁকে লাঞ্ছিত করুন! বাড়াবাড়িতে নিমজ্জিত কোনো কোনো সূফী উলে­খ করেছেন, জিবরাঈল (আ)-কে পর্দার অন্তরাল থেকে ওহী দেওয়া হতো। একবার পর্দা উঠানো হলে তিনি দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে ওহী দিচ্ছেন। তখন জিবরাঈল (আ) বলেন: আপনিই ওহী দিচ্ছেন আর আপনার কাছেই নিয়ে যাচ্ছি!.. যে ব্যক্তি এ নোংরা প্রলাপ বানিয়েছে তাকে আল্লাহ লানত করুন! … মীলাদুন্নবী গ্রন্থগুলিতে একেবারে ভিত্তিহীন অস্তিত্বহীন হাদীস বিদ্যমান, যেগুলি অতিভক্তি ও বাড়াবাড়ির অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল(সা.) এরূপ অতিভক্তি ও বাড়াবাড়ি নিষেধ করেছেন। এজন্য এ সকল বই পাঠ করা হারাম। ফাযাইল বিষয়ক হাদীস এ অজুহাতে এগুলি বলা জায়েয নয়। কারণ ফাযাইল বিষয়ে যয়ীফ হাদীস গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে উম্মাতের ইজমা রয়েছে যে, ফাযাইলের ক্ষেত্রেও জাল হাদীস গ্রহণ করা যায় না; বরং জাল হাদীস উলে­খ করাই হারাম; (শুধু জাল হিসেবে চিহ্নিত করে তা উলে­খ করা যায়)। … রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। অতিভক্তি ও বাড়াবাড়ি করে তাঁর নামে যা বলা হয় তার কোনো প্রয়োজনই তাঁর নেই। তিনি বলেছেন : খৃস্টানগণ যেভাবে ঈসার (আ) বিষয়ে অতিভক্তি-অতিপ্রশংসা করেছে তোমরা আমার বিষয়ে সেরূপ অতিভক্তি-অতিপ্রশংসা করবে না; আমি তো বান্দা বা দাস বৈ কিছুই নই; কাজেই আমার বিষয়ে বলবে: আল্লাহর দাস ও তাঁর রাসূল।”
আল্লামা আব্দুল্লাহ গুমারী ‘ইসলাহু আবইয়াতিল বুরদাহ’ পুস্তকে বলেন:
قال السيوطي في الحاوي: إنه غير ثابت. وهو تساهل قبيح، بل ظاهر الحديث الوضع، واضح النكارة، وفيه نَفَس صوفي، حيثُ يذكر مقام الهيبة ومقام الخشية، إلى آخر مصطلحات الصوفية….. فجابرٌ رضي الله عنه بريء من رواية هذا الحديث، وعبد الرزاق لم يسمع به، وأول من شهَّر هذا الحديث ابنُ العربي الحاتمي، فلا أدري عمّن تلقّاه! وهو ثقة، فلا بدَّ أن أحد المتصوفة المتزهدين وَضَعه.
“সুয়ূতী হাবী পুস্তকে বলেছেন: হাদীসটি প্রমাণিত নয়। এটি সুয়ূতীর একটি নিন্দনীয় ঢিলেমি; বরং হাদীসটি সুস্পষ্টত জাল এবং আপত্তিকর। সূফীদের পরিভাষা এর মধ্যে সুস্পষ্ট; যেমন এতে ‘হাইবাতের মাকাম, খাশিয়াতের মাকাম ইত্যাদি সূফী পরিভাষা ব্যবহৃত (এগুলি প্রমাণ করে যে এ হাদীসটি জাল; কারণ এ সকল পরিভাষা কয়েকশত বৎসর পরে প্রচলিত হয়েছে) ….। জাবির (রা) এ হাদীস বর্ণনার দায়ভার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং আব্দুর রায্যাক কখনো এ হাদীসটি শুনেন নি। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি হাদীসটি প্রচার করেন তিনি ইবন আরাবী হাতিমী। আমি জানি না তিনি কার থেকে হাদীসটি পেয়েছেন। তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন। তাহলে অবশ্যই কোনো দরবেশ সূফী এ হাদীসটি জাল করে বানিয়েছেন।”
আরো অনেক সূফী ও তরীকাপন্থী মুহাদ্দিস এ হাদীসটির জালিয়াতি প্রসঙ্গে বই-পুস্তক রচনা করেছেন। সূফী-সালাফী মতভেদের কারণে, সূফী মত প্রমাণের জন্য বা বুজুর্গগণের দোহাই দিয়ে তাঁরা জাল হাদীস প্রশ্রয় দেন নি।
তৃতীয় প্রসঙ্গ: জাল হাদীস প্রমাণে জাল পুস্তক
(ক) একটি হারানো পুস্তকের আবির্ভাব
২০০৫ খৃস্টাব্দে (الجزء المفقود من الجزء الأول من المصنف): ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের প্রথম খণ্ডের হারানো অংশ” নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ‘ঈসা ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন মানি হিমইয়ারী’ নামক সংযুক্ত আরব আমিরাতের একজন আলিম গ্রন্থটি সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ড. মাহমূদ সায়ীদ মামদূহ পুস্তকটির প্রশংসাপত্র লিখেন।
ভূমিকায় শাইখ হিমইয়ারীর বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, নূর মুহাম্মাদীই যে প্রথম সৃষ্টি তা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। কিন্তু এ বিষয়ক হাদীসটির মুসান্নফ আব্দুর রায্যাক গ্রন্থে বিদ্যমান না থাকায় এটি প্রমাণের জন্য তিনি অত্যন্ত অস্থিরচিত্ত ছিলেন। তিনি তুরস্ক, ইয়ামান ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের গ্রন্থাগারগুলিতে এ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিগুলো অনুসন্ধান করে কোথাও কোনো পাণ্ডুলিপিতে এ হাদীসটি পান নি। হঠাৎ করেই ড. সাইয়িদ মুহাম্মাদ আমীন কাদিরী বারাকাতী নামক একজন ভারতীয় রেজবী সূফী শাইখ তাকে মুসান্নাফ গ্রন্থে প্রথম দুটি খণ্ডের একটি পাণ্ডুলিপি প্রদান করেন যার মধ্যে এ হাদীসটি বিদ্যমান। বিশ্বের কোথাও এ পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় কোনো কপি পাওয়া যায় না। এতে লেখা আছে ৯৩৮ হিজরীতে বাগদাদ নগরীতে ইসহাক ইবনু আব্দুর রাহমান সুলাইমানী এ পাণ্ডুলিপিটি লিখেন। তিনি কোন্ পাণ্ডুলিপি দেখে এটি লিখেছেন, এর সনদ কী ইত্যাদি বিষয় তাতে লেখা নেই। হিমইয়ারী দাবি করেন যে, এ পাণ্ডুলিপিটি দশম হিজরী শতকেই লেখা এবং এর বয়স প্রায় ৫০০ বৎসর।
এ পাণ্ডুলিপিটিতে মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের শুরুতে দশটি পরিচ্ছেদ বিদ্যমান যে অধ্যায়গুলি বিশ্বের অন্য কোনো পাণ্ডুলিপিতে নেই। প্রথম পরিচ্ছেদটির নাম (باب في تخليق نور محمد) ‘নূর মুহাম্মাদী সৃষ্টির অধ্যায়’। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলো ওযূ অধ্যায়ের। মুদ্রিত গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘কিতাবুল ঈমান’: ঈমান অধ্যায়। এ অধ্যায়ে উপরের একটিই মাত্র পরিচ্ছেদ রয়েছে। এ পরিচ্ছেদে উপরের হাদীসটির সনদ নিম্নরূপ:
عبد الرزاق عن معمر عن ابن المنكدر عن جابر قال:
আব্দুর রায্যাক মা’মার থেকে, তিনি ইবনুল মুনকাদির থেকে, তিনি জাবির থেকে, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম….।
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ পাণ্ডুলিপি এবং এতে বিদ্যমান হাদীসগুলোর সনদ ও মতন বিচার করে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে, পাণ্ডুলিপিটি পুরোটাই জাল। আমাদের এ গ্রন্থের পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। আমরা সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলোর দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
(১) তুর্কি সুলতানগণ বিগত কয়েকশত বৎসর যাবৎ বিশ্বের সকল দু®প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছেন, যেগুলি তুরস্কের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বিদ্যমান। খোদাবখশ লাইব্রেরী-সহ ভারতেও অনেক প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে মুসলিম বিশ্বের প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপিগুলি সংরক্ষিত। উপনিবেশ সময়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের পণ্ডিতগণ মুসলিম দেশগুলো থেকে সকল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে নিজেদের দেশের যাদুঘর ও পাঠাগারে সংরক্ষণ করেছেন। বিশ্বের কোনো যাদুঘরে বা লাইব্রেরিতে নেই এমন একটি পাণ্ডুলিপি আল্লামা রেজা খান ব্রেলবীর ভক্ত কোনো পীর সাহেবের বাড়িতে পাওয়া যাবে! বিশেষত আল্লামা আহমাদ রেযা খান ব্রেলবী (১২৭২-১৩৪০ হি/ ১৮৫৬-১৯২১খৃ) গবেষণা অধ্যয়নকে ওহাবীদের পরিচয় বলে গণ্য করতেন। তিনি বলেন:
أهل سنة بحر قوالي وعرس : ديوبندي بحر تصنيفات ودرس
خرج سني بر قبور وخانقاه : خرج نجدي بر علوم ودرس كاه
“আহল সুন্নাত কাওয়ালী ও উরশের সাগর; দেওবন্দী (ওহাবী) গ্রন্থরচনা ও পাঠদানের সমূদ্র । সুন্নীর খরচ কবর ও খানকার জন্য। নজদীর (ওহাবীর) খরচ ইলম ও মাদরাসার জন্য।”
এমন একজন পীর সাহেব ৫০০ বৎসর যাবৎ একটি পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করলেন, বিশ্বের বিশেষজ্ঞ আলিমদেরকে দিয়ে এর বিশুদ্ধতা প্রমাণ না করে তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী’ প্রমাণের জন্য ‘পাগলপারা’ শাইখ হিমইয়ারীকেই তা প্রদান করলেন! তিনিও তা কাউকে দেখতে দিচ্ছেন না!
(২) পাণ্ডুলিপিটি ৯৩৩ হিজরী সালে লেখা বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু লিপিকার কার কাছ থেকে শুনে বা কোন্ পাণ্ডুলিপি দেখে লিখেছেন তা বলেন নি। আবার ৯৩৩ সাল থেকে ১৪২৫ সাল পর্যন্ত ৫০০ বৎসর পাণ্ডুলিপিটি কোথায় ছিল তারও কোনো বিবরণ এতে নেই। ইসলামী পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে অভিজ্ঞ সকলেই জানেন যে, এটি পাণ্ডুলিপির জালিয়াতি প্রমাণ করে।
(৩) পাণ্ডুলিপির যে পৃষ্ঠাগুলি বইটিতে ছাপা হয়েছে সেগুলি প্রমাণ করে যে, এটি আধুনিকযুগের ভারতীয় লিখন পদ্ধতিতে লেখা।
(৪) এ বইটিতে দাবি করা হয়েছে যে, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘কিতাবুল ঈমান’ বা ‘ঈমান অধ্যায়’। অথচ প্রাচীনকাল থেকে মুহাদ্দিসগণ মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের অধ্যায়গুলির বর্ণনায় ‘কিতাবুল ঈমান’-এর কথা উলে­খ করেন নি; বরং কিতাবুত তাহারাহ বা পবিত্রতার অধ্যায় দিয়ে এ পুস্তকের শুরু বলে উলে­খ করেছেন।
(৫) বিশ্বে কোনো মুসান্নাফ গ্রন্থ কিতাবুল ঈমান দিয়ে শুরু করা হয় নি। ইমাম আব্দুর রায্যাক (২১১ হি)-এর পরে আব্দুল­াহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ইবন উসমান আবু বাকর ইবন আবী শাইবা (২৩৫ হি) তাঁর প্রসিদ্ধ ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থ রচনা করেন। এটিও ‘কিতাবুত তাহারাত’ দিয়ে শুরু। উলে­খ্য যে, অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও হাদীসের বিন্যাসে উভয় মুসান্নাফ প্রায় একইরূপ।
(৬) এ জাল পুস্তকটির দাবি অনুসারে ইমাম আব্দুর রায্যাক তাঁর মুসান্নাফ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘কিতাবুল ঈমানে’ একটিই মাত্র পরিচ্ছেদ সংকলন করেন! হাদীসের গ্রন্থগুলো সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান থাকলেও কি একথা কল্পনা করা যায়? বিশ্বের শতশত হাদীসগ্রন্থের মধ্যে একটি গ্রন্থও কি পাওয়া যায় যার ‘কিতাবুল ঈমান’-এর মধ্যে একটিই মাত্র পরিচ্ছেদ বিদ্যমান?!
(৭) পাণ্ডুলিপিটি যিনি রচনা করেছেন তিনি হাদীস সম্পর্কে অভিজ্ঞ, তবে ভাল অভিজ্ঞ নন। বইটির দ্বিতীয় হাদীসের সনদ নিম্নরূপ:
عبد الرزاق عن ابن جريج قال: أخبرني البراء قال:
“আব্দুর রায্যাক: ইবন জুরাইজ থেকে, ইবনু জুরাইজ বলেন: আমাকে বারা (রা) বলেন…”। জুরাইজ (১৫০ হি) একজন তাবি-তাবিয়ী। বারা ইবন আযিব (৭১ হি) বা কোনো সাহাবীকে তিনি দেখেনও নি। কোনো তাবি-তাবিয়ী যদি বলেন: “অমুক সাহাবী থেকে” তবে তা ‘মুনকাতি’ বলে গণ্য। আর যদি কোনো তাবি তাবিয়ী বলেন যে, অমুক সাহাবী তাকে বলেছেন, তবে তিনি মিথ্যাবাদী বলে গণ্য হন। ইবন জুরাইজ কখনোই মিথ্যাবাদী ছিলেন না; তবে এ পাণ্ডুলিপিটির লেখক জ্ঞানের স্বল্পতা বা জালিয়াতির ব্যবস্তায় এরূপ ভয়ঙ্কর মিথ্যা লিখেছেন। এরূপ আরেকটি মহামিথ্যা বইটির ২৪ নং হাদীসের সনদ:
عبد الرزاق عن ابن جريج عن الزهري أنه سمع عقبة بن عامر…
“আব্দুর রায্যাক, ইবন জুরাইজ থেকে, তিনি যুহরী থেকে, তিনি উকবা ইবন আমির (রা) কে বলতে শুনেছেন…।”
উকবা ইবন আমির (রা) ৪৪ হিজরীতে মিসরের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং ৬০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ইমাম যুহরী ৫০ বা ৫৮ হিজরী সালে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। যুহরী কখনো উকবা থেকে হাদীস শুনেন নি। পাণ্ডুলিপিটির লেখক অজ্ঞতা বশত এরূপ লিখেছেন।
(খ) শাইখ কামাদানী ও ড. মাহমূদ সায়ীদ-এর বক্তব্য
আলোচ্য ‘হারানো’ পুস্তকটির ৩-৪ পৃষ্ঠায় মিসরের নাগরিক ও আরব আমিরাতে অবস্থানকারী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ড. মাহমূদ সায়ীদ মামদূহ-এর একটি প্রশংসাপত্র বিদ্যমান। বস্তুত পুস্তকটির সম্পাদক শাইখ হিমইয়ারী তাঁর পাণ্ডুলিপি মাত্র দুজন আলিমকে দেখতে দেন: শাইখ আদীব কামাদানী ও ড. মাহমূদ সায়ীদ। শাইখ কামাদানী সিরিয়ার একজন মুহাদ্দিস ও পাণ্ডুলিপি বিশেষজ্ঞ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই প্রদেশের ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ে গবেষক হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন। এ সময়ে শাইখ হিমইয়ারীও একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন ও উভয়ে বন্ধু ছিলেন। তিনি বলেন, শাইখ হিমইয়ারী মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের কোনো পাণ্ডুলিপি থেকে নূর মুহাম্মাদী বিষয়টি প্রমাণ করতে অত্যন্ত অস্থির ছিলেন এবং সবাইকে বিষয়টি বলতেন। তাঁর এ অস্থিরতা দেখে ভারতের একজন ব্রেলবী পীর এ পাণ্ডুলিপিটি তাকে এনে দেন। পাণ্ডুলিটি পেয়ে হিমইয়ারী আনন্দ প্রকাশ করতে বিশাল মেজবানির আয়োজন করেন।
হিমইয়ারী কামাদানী ও মাহমূদ সায়ীদকে পাণ্ডুলিপিটি দেখতে দেন। কামাদানী পাণ্ডুলিপির কাগজ, কালি ও লিখনপদ্ধতি দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই এটিকে জাল বলেন। তিনি বলেন: পাণ্ডলিপিটির বয়স দুবছরের বেশি কখনোই হতে পারে না। কিন্তু হিমইয়ারী এটিকে জাল বলে মানতে কিছুতেই রাজি হন না। কামাদানী তাকে বলেন: আপনি দুবাইয়ের পাণ্ডুলিপি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জুমুআতুল মাজিদ কেন্দ্রে প্রেরণ করে এর বয়স, কাগজ, কালি ও লিখনির বিষয় যাচাই করুন এবং পাণ্ডুলিপির সংগ্রাহক কোথা থেকে তা অনুলিপি করেছে তা জানুন। হিমইয়ারী বলেন: পাণ্ডুলিপিটির সংগ্রাহক বলেছেন সোভিয়েট ইউনিয়নের একটি লাইব্রেরি থেকে তারা পাণ্ডুলিপিটির অনুলিপি করে এনেছেন, তবে মূল পাণ্ডুলিপিটি যুদ্ধে নষ্ট হয়ে গিয়েছে! মুসান্নাফ-এর অবশিষ্ট অংশের পাণ্ডুলিপি দেখাতে বললে তারা অপারগতা প্রকাশ করেন!
দ্বিতীয় ব্যক্তি ড. মাহমূদ সায়ীদ মুহাম্মাদ মামদূহ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাদীস গবেষক। তিনি পাণ্ডুলিপিটির সম্পাদক শাইখ হিমইয়ারীর মত সূফী আকীদার অনুসারী এবং সালাফীগণের বিরোধী। শাইখ আলবানী ও সালাফীগণের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সুপরিচিত। আমরা দেখেছি তিনি এ ‘হারানো’ পুস্তকের প্রশংসাপত্র লিখেন। কিন্তু দু বছর পরে ২০০৭ সালে তিনি তাঁর প্রশংসাপত্র প্রত্যাহার করে এবং বইটির অনির্ভরযোগ্যতা বর্ণনা করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটির নাম (بيان من الشيخ محمود سعيد حول ما طبع باسم الجزء المفقود من مصنف عبد الرزاق) ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের হারানো অংশ নামে যা ছাপা হয়েছে তার বিষয়ে শাইখ মাহমূদ সায়ীদের বক্তব্য’।
এ প্রবন্ধে তিনি উলে­খ করেছেন যে, আকীদা ও আমলে তিনি শাইখ হিমইয়ারীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন ও ভালবাসেন। হিমইয়ারী তাঁকে যখন এ পাণ্ডুলিপিটি দেখান তখন তিনি দুটি কারণে এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন: (১) পাণ্ডুলিপিটির কাগজ এবং কালি নতুন এবং (২) পাণ্ডুলিপির উপর এর সনদ, শ্রবণ, মালিকানা ইত্যাদির তথ্য লেখা নেই। দুবাইয়ের জুমুআতুল মাজিদ কেন্দ্রে পাণ্ডুলিপিটি পাঠালে তারা বলে যে, পাণ্ডুলিপিটির বয়স সর্বোচ্চ ৫০ বা ৬০ বৎসর। হিমইয়ারী এ পুস্তকটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁকে একটি প্রশংসাপত্র লিখে দিতে অনুরোধ করেন। তিনি পাণ্ডুলিপিটি পুরো না পড়ে, শুধু তার ভূমিকার উপর নির্ভর করে একটি প্রশংসাপত্র লিখেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, পাণ্ডুলিপিটি অনির্ভরযোগ্য। মুমিনের জন্য ভুলের পক্ষে হুজ্জতি না করে ভুল স্বীকার করে সত্যগ্রহণ উত্তম। এজন্য তিনি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর প্রথম খণ্ডের হারানো অংশ’ নামের পুস্তকটিতে তাঁর লেখা প্রশংসাপত্র প্রত্যাহার করলেন। এর সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি আরো বলেন যে, আলোচিত পুস্তকের বাতিলকৃত প্রশংসাপত্রে তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়ক হাদীসটির প্রসঙ্গ মোটেও উলে­খ করেন নি। কারণ তাঁর উস্তাদ আহমাদ গুমারী, আব্দুল­াহ গুমারী ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস এ হাদীসটি জাল বলে নিশ্চিত করেছেন। একটি বইয়ের প্রশংসাপত্র লেখার জন্য বইটির মধ্যে বিদ্যমান সকল হাদীস বা জাল হাদীসের বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজনীয় বলে তিনি মনে করেন নি। এজন্যই তিনি উক্ত প্রশংসাপত্রে হাদীসটির জালিয়াতির প্রসঙ্গ আলোচনা করেন নি।
বিস্তারিত আলোচনার পর তিনি লিখেন: “মোট কথা ‘মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাকের প্রথম খণ্ডের হারানো অংশ’ নামে প্রকাশিত বইটি একেবারেই অনির্ভরযোগ্য। এ বইটির রেফারেন্স দেওয়া বা অনুবাদ করা যাবে না।”
(গ) বুখারী ও মুসলিম-সহ সকলেই কি নবী-বিরোধী ছিলেন?
সম্মানিত পাঠক, যদি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর প্রথম খণ্ডের হারানো অংশ’ নামক পুস্তকটি সঠিক প্রমাণ হয় তবে ইমাম আহমাদ ও সিহাহ-সিত্তার সংকলকগণ-সহ ও তৃতীয় শতক থেকে উম্মাতের সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বুজুর্গ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদার বিরোধী ও দীনের দুশমন বলে প্রমাণ হবে। কারণ তাঁরা ইমাম আব্দুর রায্যাকের মুসান্নাফের মধ্যে বিদ্যমান এতগুলি সহীহ হাদীসকে জেনে শুনে গোপন করেছেন। হাদীস সংকলন বিষয়ে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তারা বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন।
পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি যে, দ্বিতীয় হিজরীর প্রথমার্ধ থেকে মুসলিম বিশ্বের আলিমগণ হাদীসের সন্ধানে প্রতিটি গ্রাম ও শহর পরিভ্রমণ করতে থাকেন। এ সময় থেকে কোনো হাদীসই আর শুধু একটি সনদে বর্ণিত হয় নি। দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুহাদ্দিসগণ একটি হাদীস অনেক সনদে বর্ণনা করতেন এবং তাঁদের গ্রন্থগুলোতে সংকলন করতেন। এখন নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(১) জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) ৭৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে অনেক তাবিয়ী তাঁর থেকে হাদীস শিক্ষার সুযোগ পান। তাঁর ছাত্রের সংখ্যা ১৬৫ জনেরও বেশি। অবাক বিষয় যে, এতবড় গুরুত্বপূর্ণ হাদীস তাঁর একজন মাত্র ছাত্র বর্ণনা করবেন, অন্য কেউই করবেন না।
(২) মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির (মৃত্যু ১৩০ হি) দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমার্ধের সুপ্রসিদ্ধ তাবিয়ী। সিহাহ সিত্তা ও অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যেই তাঁর দেড় শতাধিক ছাত্রের বর্ণনা বিদ্যমান। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম জাফর সাদিক, ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম আওযায়ী, সুফিয়ান সাওরী, শুবা ইবনুল হাজ্জাজ, ইবনুল মাজিশূন, ইবন জুরাইজ, আমর ইবন দীনার ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ ইমাম ও মুহাদ্দিস। হাদীসের গ্রন্থগুলিতে একটি সহীহ হাদীস খুঁজে পাওয়া যায় না যা ইবনুল মুনকাদির থেকে শুধু একজন ছাত্র বর্ণনা করেছেন, অন্য কোনো ছাত্রই বর্ণনা করেন নি। তাহলে এ হাদীসটি মা’মার ইবনু রাশিদ ছাড়া অন্য কেউ বর্ণনা করলেন না কেন? ইবনুল মুনকাদির গোপন করে রেখেছিলেন? না ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালিক, সুফইয়ান সাওরী ও অন্যান্য ছাত্র হাদীসটি তাঁর মুখ থেকে শোনার পরেও গোপন করেছিলেন?
(৩) মা’মার ইবনু রাশিদ (৯৬-১৫৪ হি) প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী। প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোতেই তাঁর প্রায় ৭৫ জন ছাত্রের বর্ণিত হাদীস পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি সহীহ হাদীসও খুঁজে পাওয়া যায় না যা মামার ইবনু রাশিদ থেকে শুধু একজন ছাত্র বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রতিটি হাদীসই একাধিক ছাত্র বর্ণনা করেছেন। তাহলে এ হাদীসটি আব্দুর রায্যাক ছাড়া অন্য কেউ বর্ণনা করলেন না কেন? রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা গোপন করতে?
(৪) ইমাম আব্দুর রায্যাক ইবন হাম্মাম সানআনী (১২৬-২১১ হি) দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোতে তাঁর শতাধিক ছাত্রের বর্ণনা বিদ্যমান। একটিও সহীহ মারফ‚ (নববী) হাদীস পাওয়া যায় না যা আব্দুর রায্যাক থেকে তার একজন মাত্র ছাত্র বর্ণনা করেছেন। তাহলে এ হাদীসটি অন্য কোনো ছাত্র বর্ণনা করলেন না কেন? রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা গোপন করার উদ্দেশ্যে?
(৫) মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর মধ্যে বিদ্যমান সকল মারফ‚ (নববী) হাদীস তাঁর সনদে ও অন্যান্য সনদে সিহাহ সিত্তা ও তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম হিজরী শতকে সংকলিত হাদীস গ্রন্থগুলিতে সংকলিত। পাঠক, আপনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি সহীহ বা যয়ীফ হাদীসও দেখাতে পারবেন না যা মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাকে সংকলিত কিন্তু বিশ্বের অন্য কোনো হাদীসগ্রন্থে এক বা একাধিক সনদে সংকলিত নয়। এখন প্রশ্ন হলো: ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, সিহাহ সিত্তার প্রণেতাগণ ও পরবর্তী যুগগুলোর মুহাদ্দিসগণ ইমাম আব্দুর রায্যাক-এর মুসান্নাফ গ্রন্থের সকল মারফ‚ বা নববী হাদীস গ্রহণ ও সংকলন করলেন, কিন্তু এ গ্রন্থে বিদ্যমান নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক ‘সহীহ সনদে’ (!) সংকলিত এতগুলো হাদীসের একটিও তাঁরা সংকলন করলেন না কেন? হাজার বছর ধরে একটি হাদীস-গ্রন্থেও এসকল হাদীসের একটিও নেই কেন? তাঁরা সকলেই কি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা গোপন করতে চেয়েছেন?
(৬) সহীহুল বুখারীর একটি অধ্যায়ের নাম ‘কিতাব বাদয়িল খালক’ ‘সৃষ্টির শুরুর অধ্যায়’। এ অধ্যায়ে সাপ, বিচ্ছু, মাছি, জিন, ফিরিশতা ইত্যাদি বিষয়ক কত হাদীস ইমাম বুখারী সংকলন করেছেন। কিন্তু তাঁর উস্তাদগণের উস্তাদ আব্দুর রায্যাকের মুসান্নাফে সংকলিত নূর মুহাম্মাদী বিষয় কয়েক ডজন সহীহ (!) হাদীসের একটিও তিনি উলে­খ করলেন না! আব্দুর রায্যাক বর্ণিত প্রায় ১৫০টি হাদীস তিনি তাঁর সহীহ গ্রন্থে সংকলন করলেন অথচ নূর মুহাম্মাদ বিষয়ক এতগুলো সহীহ (!) হাদীস তিনি গ্রহণ করলেন না!
(৭) উবাদা ইবনুস সামিত (রা), আব্দুল­াহ ইবন আব্বাস (রা) ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত:
إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى الْقَلَمُ../ أَوَّلَ شَيْءٍ خلقه الله القلم
‘আল­াহ সর্বপ্রথম ‘কলম’ সৃষ্টি করেন’। এ সকল হাদীস ইমাম আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস বিভিন্ন সনদে সংকলন করেছেন। ইমাম ইবন আবী শাইবা তাঁর মুসান্নাফ গ্রন্থে (كتاب الأوائل: أول ما فُعِل…) “সর্বপ্রথম বিষয়ক অধ্যায়: প্রথম কী হলো…” নামে একটি অধ্যায় সংকলন করেছেন। এ অধ্যায়েও তিনি ‘সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টির’ এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তিনি বা অন্য কোনো মুহাদ্দিস সর্বপ্রথম সৃষ্টি, সৃষ্টির শুরু বা অন্য কোনো অধ্যায়ে নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক হাদীসগুলো উলে­খ করেন নি। কেন? রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা কমিয়ে কলম-এর মর্যাদা বাড়ানোর জন্য?
(৮) সম্মানিত পাঠক, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের মধ্যে বিদ্যমান অধ্যায় ও পরিচ্ছেদগুলো মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা ও অন্যান্য সকল হাদীস গ্রন্থে বিদ্যমান। কিন্তু ‘তাখলীক নূর মুহাম্মাদ সা.’ (নূর মুহাম্মাদীর সৃষ্টি) নামে একটি অধ্যায় মুসলিম বিশ্বের কোনো একটি হাদীসের গ্রনে’ও নেই। ৫০০ বৎসর পর্যন্ত সংকলিত ফিকহ ও আকীদার কোনো গ্রন্থেও ‘নূর মুহাম্মাদ’ বিষয়ক অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ বা সামান্যতম কোনো আলোচনা নেই। তাঁরা মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক থেকে অগণিত হাদীস গ্রহণ করলেন, সংকলন করলেন এবং এগুলিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করলেন অথচ নূর মুহাম্মাদ বিষয়ক এতগুলো হাদীস এভাবে এড়িয়ে গেলেন কেন?
(৯) এ ‘হারানো’ বইটি যদি সত্যই আব্দুর রায্যাক রচিত হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, ইমাম আহমাদ-সহ ইমাম আব্দুর রায্যাকের ছাত্রগণ, পরবর্তী সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ, আকীদাবিদ ও বুজুর্গগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা গোপন করতেই এরূপ করেছেন (নাউযূ বিল্লাহ)! আর তাঁদেরকে যদি আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অতন্দ্র প্রহরী বলে গণ্য করি তবে এ পুস্তকটিকে জাল বলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হবে। তৃতীয় কোনো ব্যাখ্যা কি পাঠক দেখাতে পারবেন?
সম্মানিত পাঠক, কোন্টি আপনার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য? একটি জাল হাদীসকে প্রমাণ করতে এভাবে হাজার বছরের সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ, আকীদাবিদ ও বুজুর্গকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা গোপনকারী বলা? অথবা চার ইমাম-সহ উম্মাতের প্রথম শতকগুলোর ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ, আকীদাবিদ ও বুজুর্গগণ যে সকল হাদীস কোনোভাবে উলে­খ করেন নি এবং যে বিষয়ে মোটেও কথা বলেন নি সে হাদীস ও সে বিষয় বর্জন করা?
আল্লাহ আমাদেরকে সবসময় সঠিক বিষয়টি গ্রহন করার তাওফীক করুন। আমীন।

Saturday, September 22, 2018

জান্নাতে যাওয়ার জন্য বিয়ে করা কি শর্ত?


উত্তর দিয়েছেন শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ ৷ ইসলামিক স্কলার, সৌদী আরব ৷
প্রশ্ন:আমি শুনেছি কোন মুসলমান যদি বিয়ে না করে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না- এটা কি সহিহ। যদি এ কথা সহিহ হয় তাহলে এর ভিত্তি কি? আমি মনে করি এর কারণ হতে পারে- উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি ও হারাম যৌন সম্পর্ক প্রতিরোধ করা। এ কারণটি তো অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি শেষ পয়েন্টটি জানতে চাই সেটা হচ্ছে- কোন মানুষ কি বিয়ে না করে মুত্তাকী হতে পারে না?
উত্তর:
আলহামদুলিল্লাহ।
ইসলাম জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য বিয়ে করাকে শর্ত করে না। কিন্তু ব্যক্তি যদি নিজের উপর হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার আশংকা করে তাহলে তার উচিত বিয়ে করা। যে ব্যক্তির অবস্থা এমন তার বিয়ে না করা ভুল। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- মানুষ বিয়ে না করেও মুত্তাকী হতে পারে; তবে এটি খুবই বিরল। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা বিয়ে করে না তারা দুই শ্রেণীর পুরুষ হতে পারে: অক্ষম কিংবা ব্যভিচারী। উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) জনৈক অবিবাহিত পুরুষকে লক্ষ্য করে এমনটিই বলেছেন। তিনি বলেন: তোমাকে বিয়ে করতে বাধা দিচ্ছে- হয়তো অক্ষমতা; নয়তো পাপাচারিতা।
সারকথা হচ্ছে, ইসলাম বিয়ে করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং বিয়ে করাকে রাসূলদের আদর্শ হিসেবে গণ্য করে। বিয়ে পরিত্যাগ করতে নিষেধ করে; এমনকি এ পরিত্যাগের কারণ ইবাদত হলেও। “ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই”।
আল্লাহই ভাল জানেন।
সূত্রঃ islamqa

Tuesday, September 18, 2018

বইঃ প্রেম রোগ : প্রতিপাদন ও প্রতিবিধান

শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ)-এর জীবনী


লেখক: আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী
পরিচয়, জন্ম ও প্রতিপালন:
তিনি হলেন শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সুলায়মান বিন আলী বিন মুহাম্মাদ আত্ তামীমী (রঃ)। হিজরী ১১১৫ সালে তিনি নজদ অঞ্চলের উয়াইনা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। শিশুকালে তিনি স্বীয় পিতার নিকট প্রতিপালিত হন। তাঁর পিতা, চাচা এবং দাদাসহ পরিবারের অনেকেই বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। সে হিসাবে তিনি একটি দ্বীনি পরিবেশে প্রতিপালিত হন। সে সময় শাইখের পরিবারের আলেমগণ শিক্ষকতা, ফতোয়া দান, বিচারকার্য পরিচালনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি দায়িত্ব পালন করতেন। এ সমস্ত বিষয় দ্বারা সম্মানিত শাইখ শিশুকালেই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
শাইখের প্রখর মেধা ও প্রথামিক শিক্ষা:
তিনি উয়ায়নাতেই এবং পিতাসহ স্বীয় পরিবারের আলেমদের থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিশুকালেই তার মধ্যে বিরল ও অনুপম মেধার আলামত পরিলক্ষিত হয়। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর, বুঝশক্তি ছিল খুবই তীক্ষè এবং চিন্তাশক্তি ছিল খুবই গভীর। এ কারণেই তিনি অল্প বয়সেই ইলম অর্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। শৈশব কালেই তিনি সুদৃঢ় ঈমান ও দ্বীন পালনের প্রতি বিশেষ যত্মবান ছিলেন। ছোট বেলাতেই তিনি তাফসীর, হাদীছ এবং বিজ্ঞ আলেমদের কিতাবগুলো প্রচুর অধ্যয়ন করতেন। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সালফে সালেহীনদের আছারই ছিল শাইখের জ্ঞান অর্জনের মূল উৎস। দর্শন, সুফীবাদ, মানতেক ইত্যাদির সংস্পর্শ থেকে শাইখ ছিলেন সম্পূর্ণ দূরে। কারণ তিনি যেই পরিবার ও পরিবেশে প্রতিপালিত হন, তা ছিল বিকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা, পাপাচার এবং কুসংস্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
শাইখের যুগে আরব উপদ্বীপের অবস্থা:
শাইখের যুগে নজদ ও তার আশেপাশের অঞ্চলে ব্যাপক আকারে শির্ক-বিদআত ও কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ে। আইয়্যামে জাহেলীয়াতের সকল প্রকার শির্কই পুনরায় আরব উপদ্বীপে নতুন পোষাকে প্রবেশ করে। গাছ, পাথর কবর এবং অলী-আওলীয়ার এবাদত শুরু হয়। এই দৃশ্য দেখে তিনি মর্মাহত হন এবং এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সুদৃঢ় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
শাইখের চারিত্রিক গুণাবলী:
আমানতদারী, সত্যবাদিতা, মানুষের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ, দানশীলতা, ধৈর্যশীলতা, দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা এবং তার মধ্যে আরো এমন চারিত্রিক উন্নত ও বিরল গুণাবলীর সমাহার ঘটেছিল, যা তাকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করেছিল। ইতিহাসে যে সব মহাপুরুষ স্বীয় কর্মের মাধ্যমে প্রসিদ্ধতা অর্জন করেছেন তাদের খুব অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যেই এই চারিত্রিক গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি খুব বিনয়ী ছিলেন, সায়েল ও অভাবীদের প্রয়োজন পূরণে বিশেষ তৎপর ছিলেন।
তাঁর বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে কঠোরতা, অজ্ঞতা এবং দ্বীন পালনে দুর্বলতা ইত্যাদি যেসব অভিযোগ করে থাকে, শাইখ ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
উচ্চশিক্ষা ও ভ্রমণ:
উয়ায়নার আলেমদের কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ সমাপ্ত করার পর তিনি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য হিজায ও শাম (সিরিয়া) ভ্রমণ করেন। যৌবনে পদার্পন করে তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফে গমণ করেন। হজ্জ শেষে মদীনায় গিয়ে তিনি শাইখ আব্দুল্লাহ বিন ইবরাহীম বিন সাইফ নামক প্রখ্যাত আলেমের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধির নিকট ইলমে হাদীছের জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি ইরাকের বসরায় গমণ করেন এবং সেখানকার শাইখ মাজমুয়ীর নিকট তাওহীদ ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। সেখানে থাকা অবস্থাতেই তিনি শির্ক ও বিদআত বিরোধী প্রকাশ্য আলোচনা শুরু করেন। ফলে বসরার বিক্ষুদ্ধ বিদআতীরা তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেয়।
উয়াইনায় ফিরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস এবং দাওয়াতী কাজে মনোনিবেশ:
ইরাক থেকে ফিরে এসে শাইখ নিজ জন্মস্থান উয়ায়নায় বসবাস করতে থাকেন। তখন উয়ায়নার শাসক ছিলেন উছমান বিন মুহাম্মাদ বিন মুআম্মার। তিনি উছমানের নিকট গেলেন। উছমান শাইখকে স্বাগত জানালেন এবং বললেনঃ আপনি আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতে থাকুন। আমরা আপনার সাথে থাকবো এবং আপনাকে সাহায্য করবো। উছমান এমনি আরো ভালো কথা বললেন, শাইখের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করলেন এবং তাঁর দাওয়াতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেন।
উছমানের আশ্বাস পেয়ে শাইখ মানুষকে আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দান, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ করাসহ কল্যাণের দিকে আহবান করতে থাকলেন। শাইখের দাওয়াত উয়ায়নার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী সকল গ্রামের মানুষ শাইখের কাছে আসতে থাকলো এবং নিজেদের ভুল আকীদাহ বর্জন করে শাইখের দাওয়াত কবুল করতে লাগল।
ঐ সময় জুবাইলা নামক স্থানে যায়েদ বিন খাত্তাব নামে একটি মিনার ছিল। যায়েদ বিন খাত্তাব ছিলেন উমার (রাঃ)এর ভাই। তিনি মিথ্যুক নবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। পরবর্তীতে অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকেরা তার কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করে। কালক্রমে তা এক দেবতা মন্দিরে পরিণত হয়। এতে বিভিন্ন ধরণের মানত পেশ করা হতো এবং কাবা ঘরের ন্যায় তাওয়াফও করা হতো। সেখানে আরো অনেক কবর ছিল। আশেপাশের গাছপালারও এবাদত হতো।
একদা শাইখ আমীর উছমানকে বললেনঃ চলুন আমরা যায়েদ বিন খাত্তাবের কবরের উপর নির্মিত গম্বুজটি ভেঙে ফেলি। কেননা এটি অন্যায়ভাবে এবং বিনা দলীলে নির্মাণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এই কাজের প্রতি কখনই সন্তুষ্ট হবেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর কোন কিছু নির্মাণ করতে এবং কবরকে মসজিদে পরিণত করতে নিষেধ করেছেন। এই গম্বুজটি মানুষকে গোমরাহ করছে, মানুষের আকীদাহ পরিবর্তন করছে এবং এর মাধ্যমে নানা রকম শির্ক হচ্ছে। সুতরাং এটি ভেঙে ফেলা আবশ্যক।
আমীর উছমান বললেনঃ এতে কোন অসুবিধা নেই। অতঃপর উছমান বিন মুআম্মার গম্বুজটি ভাঙ্গার জন্য ৬০০ সৈনিকের একটি বাহিনী নিয়ে বের হলেন। শাইখও তাদের সাথে ছিলেন।
উছামানের বাহিনী যখন জুবাইলিয়ার নিকটবর্তী হলো এবং জুবাইলিয়ার অধিবাসীরা জানতে পারলো যে, যায়েদ বিন খাত্তাবের মিনার ভাঙ্গার জন্য একদল লোক আগমণ করেছে তখন তারা গম্বুজটি রক্ষা করার জন্য বের হলো। কিন্তু আমীর উছমান এবং তাঁর সৈনিককে দেখে তারা ফিরে গেল। উছমানের সৈনিকরা গম্বুজটি গুড়িয়ে দিল। শাইখের প্রচেষ্টায় এই মিনারটি ভেঙে ফেলা হয় এবং তিনি শাইখ নিজেও ভাঙ্গার কাজে অংশ নেন।
আলহামদুলিল্লাহ। চিরতরে শির্কের একটি আস্তানা বিলুপ্ত হলো। এমনি শির্কের আরো অনেক আস্তানা আল্লাহ তাআলা সম্মানিত শাইখের মাধ্যমে বিলুপ্ত করলেন।
ব্যভিচারের হদ্দ (শাস্তি) কায়েম:
উয়ায়নাতে অবস্থানকালে এক মহিলা একদিন তাঁর কাছে এসে স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে ব্যভিচারের অপরাধ স্বীকার করে বিচার প্রার্থনা করে। মহিলাটির অবস্থা স্বাভাবিক কি না, তা জানার জন্য তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। যখন তিনি জানতে পারলেন, মহলিাটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং তার মাথায় কোন পাগলামী নেই, তখন মহিলাটিকে বললেনঃ সম্ভবতঃ জবরদস্তি করে তোমার সাথে এই অপকর্ম করা হয়েছে। সুতরাং তোমার বিচার প্রার্থনা করার দরকার নেই। অবশেষে মহিলাটি জোর দাবী জানালে এবং বার বার স্বীকার করতে থাকলে তিনি লোকদেরকে নির্দেশ দিলে তারা পাথর মেরে মহিলাটিকে হত্যা করে ফেলে।
উয়ায়নাতে উছমান বিন মুআম্মারের সহযোগিতায় ও সমর্থনে শাইখের সংস্কার আন্দোলন যখন পুরোদমে চলতে থাকে, তখন আহসার শাসক সুলায়মান বিন আব্দুল আযীযের কাছে এই খবর পৌঁছে গেল। শাইখের বিরোধীরা সুলায়মানকে জানিয়ে দিল যে, শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ব্যক্তি কবরের উপর নির্মিত গম্বুজগুলো ভেঙে ফেলছে এবং ব্যভিচারের শাস্তিও কায়েম করছে। আহসার আমীর এতে রাগান্বিত হলো এবং সে উয়ায়নার আমীর উছমানকে এই মর্মে পত্র লিখলো যে, আপনি অবশ্যই এই লোকটিকে (শাইখকে) হত্যা করবেন। অন্যথায় আমরা আপনাকে খিরাজ (টেক্স) দেয়া বন্ধ করে দিবো।
উল্লেখ্য যে, আহসার এই গ্রাম্য অশিক্ষিত শাসক উছমানকে বিরাট অংকের টেক্স প্রদান করতো। তাই উছমান পত্রের বিষয়টিকে খুব বড় মনে করলেন এবং এই আশঙ্কা করলেন যে, শাইখের দাওয়াতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখলে আহসার খিরাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের পক্ষ হতে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ ঘেষণারও ভয় রযেছে।
তাই তিনি শাইখকে পত্রের বিষয় অবগত করলেন এবং আহসার শাসকের পত্র মুতাবেক আমরা আপনাকে হত্যা করা সমীচিন মনে করছিনা। আপনাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করাও এখন থেকে আর সম্ভব হবেনা। কারণ আমরা আহসার শাসক সুলায়মানকে খুব ভয় করছি। আমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও সক্ষম নই। সুতরাং আপনি যদি আমাদের কল্যাণ ও আপনার নিজের কল্যাণ চান, তাহলে আমাদের নিকট থেকে চলে যান।
শাইখ তখন বললেনঃ আমি যেই বিষয়ের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি, তা তো আল্লাহর দ্বীন। এটিই তো কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহএর দাবী। যে ব্যক্তি এই দ্বীনকে মজবুতভাবে ধারণ করবে, ইহার সাহায্য করবে এবং দৃঢ়তার সাথে এই দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সাহায্য করবেন এবং তাঁর শত্র“দের উপর তাকে বিজয় দান করবেন। সুতরাং আপনি যদি ধৈর্য ধারণ করেন এবং দ্বীনের উপর অটল থাকেন এবং এই দাওয়াতের প্রতি সাহায্য ও সমর্থন অব্যাহত রাখেন, তাহলে আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাকে অচিরেই বিজয় দান করবেন এবং এই গ্রাম্য যালেম শাসক ও তার বাহিনী থেকে আপনাকে রক্ষা করবেন। সেই সাথে আল্লাহ আপনাকে তার অঞ্চল ও তার গোত্রের শাসনভার আপনার হাতেই সোপর্দ করবেন।
এতে উছমান বললেনঃ হে সম্মানিত শাইখ! তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই এবং তার বিরোধীতা করার মত ধৈর্যও আমাদের নেই।
দরঈয়ায় হিজরত এবং দরঈয়ার আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদের সাথে সাক্ষাত:
পরিশেষে উছমান বিন মুআম্মারের অনুরোধে বাধ্য হয়ে শাইখ উয়ায়না থেকে বেরিয়ে পড়লেন। উয়ায়না ছেড়ে তিনি দরঈয়ায় হিজরত করলেন। বলা হয়ে থাকে যে, বের হওয়ার সময় শাইখ পায়ে হেঁটে বের হন। কারণ উছমান শাইখের জন্য কোন বাহনের ব্যবস্থা করেন নি। তাই সকাল বেলা বের হয়ে সারাদিন পায়ে হেঁটে বিকাল বেলা দরঈয়ায় গিয়ে পৌঁছেন। দরঈয়ায় পৌঁছে তিনি একজন ভাল মানুষের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার নাম মুহাম্মাদ বিন সুয়াইলিম আল উরায়নী। এই লোকটি শাইখকে একদিকে যেমন আশ্রয় দিলেন, অন্যদিকে আমীর মুহাম্মাদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্তও হয়ে পড়লেন। কিন্তু শাইখ তাকে এই বলে শান্ত করলেন যে, আমি যেদিকে মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছি, তা হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। অচিরেই আল্লাহ তাআলা এই দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। যাই হোক আমীর মুহাম্মাদের কাছে শাইখের খবর পৌঁছে গেল।
বলা হয় যে, একদল ভাল লোক প্রথমে আমীরের স্ত্রীর কাছে গিয়ে শাইখের দাওয়াতের বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন। আমীরের স্ত্রী ছিলেন একজন ভাল ও দ্বীনদার মহিলা। তারা আমীরের স্ত্রীকে বললেনঃ আপনার স্বামী মুহাম্মাদকে বলুন, তিনি যেন শাইখের দাওয়াত কবুল করেন এবং তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন।
অতঃপর যখন আমীর মুহাম্মাদ বাড়িতে আসলেন, তখন তিনি বললেনঃ আপনার অঞ্চলে বিরাট এক গণীমত আগমণ করেছে। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ তাআলা নিজেই আপনার নিকট এই গণীমত পাঠিয়েছেন। আপনার এলাকায় এমন একজন লোক আগমণ করেছেন, যিনি আল্লাহর দ্বীনের দিকে মানুষকে আহবান করেন, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে দাওয়াত দেন। কত সুন্দর এই গণীমত! সুতরাং আপনি দ্রুত তাকে কবুল করে নিন এবং তাকে সাহায্য করুন। খবরদার! আপনি কখনই এ থেকে পিছপা হবেন না।
আমীর মুহাম্মাদ তাঁর স্ত্রীর এই মূল্যবান পরামর্শ গ্রহণ করলেন। অতঃপর তিনি ইতস্ততঃবোধ করছিলেন। তিনি নিজেই শাইখের কাছে যাবেন? না শাইখকে নিজের কাছে ডেকে আনবেন? এবারও তাঁর স্ত্রী তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, শাইখকে আপনার কাছে ডেকে আনা ঠিক হবেনা। বরং শাইখ যেখানে অবস্থান করছেন, আপনাকেই সেখানে যাওয়া উচিত। কেননা ইলম এবং দ্বীনের দাঈর সম্মানকে সমুন্নত রাখার স্বার্থেই তা করা উচিত। আমীর মুহাম্মাদ এবারও তার স্ত্রীর পরামর্শ কবুল করে নিলেন।
আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য মুহাম্মাদ বিন সুওয়াইলিমের বাড়িতে গেলেন। সেখানে গিয়ে শাইখকে সালাম দিলেন এবং তাঁর সাথে আলোচনা করলেন। পরিশেষে তিনি বললেনঃ হে শাইখ! আপনি সাহায্যের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, নিরাপত্তার সুসংবাদ গ্রহণ করুন এবং সর্ব প্রকার সাহায্য-সহযোগিতারও সুসংবাদ গ্রহণ করুন।
জবাবে শাইখও আমীরকে আল্লাহর সাহায্য, বিজয়, প্রতিষ্ঠা এবং শুভ পরিণামের সুসংবাদ প্রদান করলেন। শাইখ আরো বললেনঃ এটি হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করবে, আল্লাহও তাকে সাহায্য করবেন, শক্তিশালী করবেন। অচিরেই আপনি এর ফল দেখতে পাবেন।
অতঃপর আমীর মুহাম্মাদ বললেনঃ হে শাইখ আমি আপনার হাতে বায়আত করবো। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের দ্বীনের উপর এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে আমরা যখন আমাকে সমর্থন করবো, আপনাকে সাহায্য করবো এবং আল্লাহ তাআলা যখন শত্র“দের উপর আপনাকে বিজয় দান করবেন, তখন আপনি আমাদের দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান কি না।
শাইখ জবাবে বললেনঃ এমনটি কখনই হবেনা। আমার রক্ত আপনাদের রক্ত আমারই রক্ত, আপনাদের ধ্বংস আমারই ধ্বংস। আপনার শহর ছেড়ে আমি কখনই অন্যত্র চলে যাবোনা।
অতঃপর আমীর মুহাম্মাদ শাইখকে সাহায্য করার বায়আত করলেন এবং শাইখও অঙ্গিকার করলেন যে, তিনি আমীরের দেশেই থাকবেন এবং আমীরের সহযোগী হিসাবেই কাজ করবেন ও আল্লাহর দ্বীনের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবেন। এভাবেই ঐতিহাসিক বায়আত সম্পন্ন হলো।
শাইখের দাওয়াতের নতুন যুগ:
এভাবে শাইখের দাওয়াত এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। দরঈয়ার আমীরের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করার অঙ্গিকার পেয়ে শাইখ নতুন গতিতে নির্ভয়ে দাওয়াতী কাজ শুরু করলেন। প্রত্যেক অঞ্চল থেকে দলে দলে লোকেরা দরঈয়ায় আসতে লাগল। শাইখ সম্মান ও ইজ্জতের সাথে এখানে বসবাস করতে লাগলেন এবং তাফসীর, হাদীছ, আকীদাহ, ফিক্হসহ দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে র্দাস দানে মশগুল হয়ে পড়লেন। নিয়মিত দারস্ দানের পাশাপশি সমর্থক ও সাথীদেরকে নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে শির্কের আস্তানা গুড়িয়ে দিতে থাকেন এবং যেসব মাজারে হাদীয়া-তোহফা পেশ করা হতো তা একের এক উচ্ছেদ করতে থাকেন।
শাইখ যখন দরঈয়ায় আসলেন তখন জানতে পারলেন যে, সেখানে এমন একটি খেজুর গাছ রয়েছে, যাকে الفحل ফাহল বা ফাহ্হাল বলা হতো। এই খেজুর গাছের ব্যাপারে তাদের ধারণা ছিল, কোন মহিলার বিয়ে হতে দেরী হলে কিংবা তাকে বিয়ের জন্য কেউ প্রস্তাব না দিলে এই খেজুর গাছটির গাছটিকে জড়িয়ে ধরত এবং বলতোঃ أريد زوجا قبل الحول يا فحل الفحول হে সকল পুরুষের সেরা পুরুষ! বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তোমার কাছে একজন পুরুষ চাই। তাদের ধারণায় এভাবে এই গাছকে জড়িয়ে ধরলে অবিবাহিত মহিলাদের দ্রুত বিয়ে হতো এবং বিয়ে হয়ে গেলে তারা এই গাছকেই বিয়ে হওয়ার কারণ মনে করতো। তাদের মুর্খতা এতদূর গিয়ে পৌঁছেছিল যে, কোন মহিলা গাছটিকে জড়িয়ে ধরার পর যখন তার বিয়ের প্রস্তাব আসতো, তখন তারা বলতোঃ তোমাকে এই গাছটি সাহায্য করেছে। অতঃপর শাইখের আদেশে গাছটিকে কেটে ফেলা হয়। আল্লাহ তাআলা শির্কের এই মাধ্যমটিকে চিরতরে মিটিয়ে দিলেন।
এভাবেই আল্লাহ তাআলা শাইখের দাওয়াতকে দরঈয়াতে সফলতা দান করলেন। পরবর্তীতে সমগ্র আরব উপদ্বীপ এবং পার্শ্ববর্তী আরব দেশসমূহ এবং সারা বিশ্বেই এই দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ল।
আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরকে তাওহীদের জ্ঞান অর্জন ও তা বাস্তবায়নের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। সেই সাথে যেসব বিষয় তাওহীদের বিপরীত এবং যা মানুষের তাওহীদকে নষ্ট করে দেয় সেসব বিষয় সম্পর্কেও শাইখ গভীর পারদর্শিতা অর্জন করেন।
শাইখ তাওহীদের দাওয়াতকে পুনরুজ্জিবীত করার জন্য সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং নবী-রাসূলদের দাওয়াতের মূল বিষয় তথা তাওহীদে উলুহীয়াতের দাওয়াত দেয়ার শুরু করেন এবং শির্ক ও বিদআতের প্রতিবাদ করেন। তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি তাঁর একাধিক ইলমী মজলিস ছিল। প্রতিদিন তিনি তাওহীদ, তাফসীর, ফিকাহ এবং অন্যান্য বিষয়ে একাধির দারস্ প্রদান করতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দাওয়াতের মধ্যে বরকত দান করলেন। ফলে আরব উপদ্বীপের লোকেরা তাঁর দাওয়াত কবুল করে শির্ক, বিদআত ও কুসংস্কারের অন্ধকার পরিহার করে তাওহীদের আলোর দিকে ফিরে আসলো। তাঁর বরকতময় দাওয়াত অল্প সময়ের মধ্যেই আরব উপদ্বীপের সীমা পার হয়ে ইরাক, মিশর, সিরিয়া, মরোক্ক, ভালতবর্ষসহ পৃথিবীর সকল অঞ্চলেই পৌঁছে যায়। ফলে তিনি ১২শ শতকের মুজাদ্দেদ তথা তাওহীদের দাওয়াতের সংস্কারক উপাধিতে ভূষিত হন।
সে সময়ের দরঈয়ার শাসক সম্প্রদায়ও শাইখের দাওয়াতকে কবুল করে নেন এবং সাহায্য করেন। এতে শাইখের দাওয়াত নতুন গতি পেয়ে দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে। বর্তমানে সৌদি আরবসহ সারা বিশ্বে যেই তাওহীদের দাওয়াত চলছে, শাইখের দাওয়াতের দ্বারাই প্রভাবিত। আল্লাহ যেন এই দাওয়াকে কিয়ামত পর্যন্ত চালু রাখেন। আমীন।
শাইখের দাওয়াতের মূলনীতি:
পরিশুদ্ধ ইসলামী মানহাজ এবং দ্বীনের সঠিক মূলনীতির উপর শাইখের দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দাওয়াতের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল, এবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য খালেস করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে যে সমস্ত মূলনীতির ভিত্তিতে শাইখের দাওয়াতী কর্মতৎপরতা পরিচালিত হতো, নিম্নে তা থেকে কয়েকটি মূলনীতি নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
১) মানুষের অন্তরে তাওহীদের শিক্ষা বদ্ধমূল করা এবং শির্ক ও বিদআতের মূলোৎপাটন করা। মুসলিমদের অন্তরে এই মূলনীতিকে সুদৃঢ় করার জন্যই তিনি প্রয়োজন পূরণের আশায় কবর যিয়ারত করা, কবরবাসীর কাছে দুআ করা, কিছু চাওয়া, রোগমুক্তি ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধার লাভের আশায় তাবীজ ঝুলানো, গাছ ও পাথর থেকে বরকত গ্রহণ করা, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের জন্য পশু যবেহ করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য মানত করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে আশ্রয় চাওয়া, কবর পূজা করা, আল্লাহ ও বান্দার মাঝে উসীলা নিধারণ করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যান্য অলী-আওলীয়ার কাছে শাফাআত চাওয়াসহ যাবতীয় শির্ক কর্জন করার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।
২) নামায কায়েম করা, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাসহ দ্বীনের অন্যান্য ফরয ও নিদর্শনগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা।
৩) সমাজে ন্যায় বিচার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহর হদ্দ তথা নির্ধারিত দন্ডবিধি কায়েম করা।
৪) তাওহীদ, সুন্নাহ, ঐক্য, সংহতি, সম্ভ্রম, নিরাপত্তা এবং ন্যায় বিচারকে মূলভিত্তি করে একটি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
যে সমস্ত অঞ্চলে শাইখের দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আরব উপদ্বীপের যেই এলাকাগুলো এই দাওয়াতের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে, সেখানে উপরোক্ত মূলনীতিগুলোর সবই বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সংস্কার আন্দোলনের পতাকাবাহী সৌদি আরবের প্রতিটি স্তরেই এর প্রভাব সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হয়েছে। এই দাওয়াত যেখানেই প্রবেশ করেছে, সেখানেই তাওহীদ, ঈমান, সুন্নাত, নিরাপত্তা ও শান্তি প্রবেশ করেছে। এতে আল্লাহর ওয়াদা ও অঙ্গিকার বাস্তবায়িত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
“তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করবেন। যেমন তিনি প্রতিষ্ঠা দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের সেই দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার এবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য”। (সূরা হজ্জঃ ৫৫)
وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (৪০) الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
“যারা আল্লাহ্র সাহায্য করে, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী শক্তিধর। তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহ্র হাতে”। (সূরা নূরঃ ৪০-৪১)
শাইখের বিরোধীতা ও তার উপর মিথ্যাচার:
সত্যের অনুসারী এবং সত্যের পথে যারা আহবান করেন, তারা কোন যুগেই বাতিলপন্থীদের হিংসা, বিদ্বেষ, শত্র“তা ও তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পান নি। যেমন রেহাই পান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা নবী-রাসূলগণ। আমাদের সম্মানিত শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রঃ) যখন সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন এবং সাহসিকতা ও বলিষ্ঠতার সাথে শির্ক, বিদআত ও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক কুসংস্কারের প্রতিবাদ শুরু করেন, তখন বিদআতী আলেমরা তাঁর ঘোর বিরোধীতা শুরু করে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ উত্থাপন করে। এমনকি এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী লোক সমসাময়িক শাসকদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। তাঁকে একাধিকার হত্যা করারও প্রচেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়। আল্লাহর ইচ্ছা অতঃপর শাইখের সৎসাহস ও নিরলস কর্ম তৎপরতার মুকাবেলায় বিরোধীদের সকল প্রচেষ্টাই বর্থ হয় এবং আল্লাহর দ্বীন ও তাওহীদের দাওয়াতই বিজয় লাভ করে।
বর্তমানেও আমাদের ভারত বর্ষে যে সমস্ত আলেম ও দাঈ সহীহ আকীদাহ ও আমলের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন, অতীতের ন্যায় তারাও বিরোধীদের নানা রকম অপবাদ ও অভিযোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। এই বরকতময় দাওয়াত থেকে মানুষকে দূরে রাখার জন্য এক শ্রেণীর লোক সহীহ আকীদার অনুসারীদেরকে ওয়াহাবী এবং নির্ভেজাল তাওহীদের দাওয়াতকে ওয়াহাবী আন্দোলন বলে গালি দেয়াসহ নানা অপবাদ দিয়েছে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবাণীতে এবং দ্বীনের মুখলিস আলেম ও দাঈদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশসহ ভারত বর্ষের প্রত্যেক অঞ্চলেই এই দাওয়াতের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে লক্ষণীয়। আগামী দিনগুলোতে ব্যাপক হারে এই দাওয়াতের সাথে আমাদের দেশের লোকেরা সম্পৃক্ত হবে, আমাদের সামনে এই লক্ষণ অতি সুস্পষ্ট।
শাইখের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও তার জবাব:
বিদআতীদের পক্ষ হতে শাইখের বিরুদ্ধে সে সময় অনেকগুলো অভিযোগ পেশ করা হয়ে থাকে। সম্ভবতঃ বর্তমানকালেও তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো ছাড়া অন্য কোন অভিযোগ খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অভিযোগগুলো নিম্নরূপঃ
১) শাইখ অলী-আওলীয়াদের কবরে মানত পেশ করা ও কবরকে সম্মান করা এবং কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা বন্ধ করে দিয়েছেন।
২) আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে পশু যবেহ করা হারাম করেছেন।
৩) আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া, শাফাআত চাওয়া এবং অলী-আওলীয়াদের উসীলা দেয়াকে হারাম ঘোষণা করেছেন।
৪) শাইখ নিজ মতের বিরোধীদের সাথে যুদ্ধে করেছেন এবং অন্যায়ভাবে তাদেরকে হত্যা করেছেন। এমননি আরো অনেক অভিযোগ শাইখের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়ে থাকে।
আসলে এইগুলো কোন অভিযোগের আওতায় পড়েনা। এগুলো এমন বিষয়, যা কুরআন ও হাদীছের সুস্পষ্ট দলীল দ্বারাই হারাম করা হয়েছে। তাঁর পূর্বে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তাঁর ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) এ ধরণের শির্ক-বিদআতের জেরালো প্রতিবাদ করেছেন। ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে যার সামান্য জ্ঞান রয়েছে সেও বুঝতে সক্ষম হবে যে, উপরোক্ত বিষয়গুলোর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। দ্বীনের সঠিক শিক্ষা না থাকার কারণে, তাওহীদের আলো নিভে যাওয়ার সুযোগে এবং সর্বত্র মুর্খতা, পাপাচারিতা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মুসলিম সমাজে উক্ত কুসংস্কার গুলোও ঢুকে পড়েছিল। উক্ত কাজগুলো ইসলামী শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে এবং তাওহীদের সরাসরি বিরোধী হওয়ার কারণে শাইখ মুসলিমদেরকে সঠিক দ্বীনের দিকে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছেন। এটি শুধু তার একার দায়িত্ব ছিলনা; বরং সকল আলেমের এই দায়িত্ব ছিল। তাই শাইখের দাওয়াত ছিল সম্পূর্ণ তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক। এটি ছিল একটি সংস্কার আন্দোলন।
তাঁর বিরুদ্ধে ওয়াহাবী মাযহাব নামে পঞ্চম মাযহাব তৈরীরও অভিযোগ পেশ করা হয়ে থাকে। এটিও একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ। শাইখ কোন মাহাব তৈরী করেন নি; বরং মুসলিমদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহবান জানিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর কিতাবাদি পড়লে বুঝা যায় দ্বীনের শাখা ও ফিকহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে হান্বালী মাযহাবের প্রতি তাঁর ঝুক ছিল। তবে তিনি মাজহাবী গোঁড়ামির সম্পূর্ণ উর্ধ্বে ছিলেন।
শাইখের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি বিরোধেিদরকে হত্যা করেছেন। এই অভিযোগও সঠিক নয়। কারণ যারা তার বিরুদ্ধে এবং তাওহীদের দাওয়াতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, তিনি কেবল তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। তাঁর জিহাদ ছিল শরঈ জিহাদ। সুতরাং সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে যারা নিহত হয়েছে, তাদেরকে তিনি অন্যায়ভাবে হত্যা করেছেন- এই অভিযোগ ঠিক নয়।
অনেকে তাকে হাদিছে বর্ণিত ‘নাজদ’এর ফিতনা বলে আখ্যায়িত করে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে আল্লাহ! তুমি আমাদের শাম এবং ইয়ামানে বরকত দান করো। সকলে বললঃ আর আমাদের নাজদে ? তিনি বললেন, ওখান থেকে শয়তানের শিং উদিত হবে। (বুখারি ও মুসলিম)
ইবনে হাযার আস্কালানীসহ অন্যান্য আলেমগণ বলেনঃ হাদিছে উল্লেখিত নাজদ হল ইরাকের নাজদ শহর। আর ইরাকেই সকল বড় বড় ফিতনা দেখা দিয়েছে। আলী (রাঃ) এবং হুসাইন (রাঃ)এর যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইরাক শান্ত হয়নি। সেখানের ফিতনার কারণেই আলী (রাঃ) কুফায় এবং হোসাইন (রাঃ) কারবালায় শাহাদাত বরণ করেন। হেজাযের নাজদে কোন ফিতনাই দেখা যায়নি। যেমনটি ইরাকে দেখা দিয়েছে। সুতরাং হেজাযের নাজদ থেকে শাইখের যেই তাওহীদি দাওয়াত প্রকাশিত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরেছে, তা ছিল নাবী-রাসূলদেরই দাওয়াত। সুস্পষ্ট বিদআতী আর অন্ধ ছাড়া কেউ এই দাওয়াতকে নাজদের ফিতনা বলতে পারেনা।
শাইখের দাওয়াতের ফলাফল:
শাইখের বরকতময় দাওয়াতের ফলে আরব উপদ্বীপসহ পৃথিবীর বহু অঞ্চল থেকে শির্ক-বিদআত ও দ্বীনের নামে নানা কুসংস্কার উচ্ছেদ হয়। যেখানেই এই দাওয়াত প্রবেশ করেছে, সেখানেই তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হকপন্থীগন সম্মানিত হয়েছেন। হাজীগণ সারা বিশ্ব হতে মক্কা ও মদীনায় আগমণ করে শাইখের দাওয়াত পেয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করতে থাকেন। বাদশাহ আব্দুল আযীযের যুগে সুবিশাল সৌদি আরব তাওহীদের এই দাওয়াতের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ এই দাওয়াতের ফল ভোগ করছেন সৌদি রাজ পরিবার ও তার জনগণ। বিশ্বের যেখানেই কুরআন, সুন্নাহ এবং সহীহ আকীদার দাওয়াত ও শির্ক-বিদআতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে, তা শাইখের এই বরকতময় দাওয়াতেরই ফসল। হে আল্লাহ! তুমি কিয়ামত পর্যন্ত তাওহীদের এই দাওয়াতকে সমুন্নত রাখো। আমীন।
শাইখের ছাত্রগণ:
তাঁর নিকট থেকে অগণিত লোক তাওহীদ ও দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন।
তাদের মধ্যে-
১) শাইখের চার ছেলে হাসান, আব্দুল্লাহ্, আলী এবং ইবরাহীম। তাদের প্রত্যেকেই ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেিেছলেন।
২) তাঁর নাতী শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান।
৩) শাইখ আহমাদ বিন নাসের বিন উছমান এবং আরো অনেকেই।
শাইখের ইলমী খেদমতঃ
শাইখের রয়েছে ছোট বড় অনেকগুলো সুপ্রসিদ্ধ কিতাব। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও আলোচিত হচ্ছে আমাদের সামনের এই কিতাবুত্ তাওহীদ। শাইখের আরো যেসমস্ত গ্রন্থ রয়েছে, তার মধ্যেঃ
(১) কাশফুস শুবুহাত।
(২) আল উসূলুস ছালাছাহ ওয়া আদিল্লাতুহা।
(৩) উসূলুল ঈমান।
(৪) তাফসীরুল ফাতিহা।
(৫) মাসায়িলুল জাহেলিয়াহ।
(৬) মুখতাসার যাদুল মাআদ
(৭) মুখতাসার সিরাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আরো অন্যান্য কিতাব।
শাইখের মৃত্যু:
হিজরী ১২০৬ সালের যুল-কাদ মাসের শেষ তারিখে ৯২ বছর বয়সে শাইখ দরঈয়ায় মৃত্যু বরণ করেন। হে আল্লাহ! তুমি শাইখকে তোমার প্রশস্ত রহমত দ্বারা আচ্ছাদিত করে নাও।

Sunday, September 16, 2018

ইমাম মালিক (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী



ইমাম মালিক (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম, উপনাম ও বংশ :
নাম মালিক, উপনাম আবূ আব্দুল্লাহ। বংশনামা : মালিক বিন আনাস বিন আবূ আমির বিন আমর বিন হারিস আল-আসবাহী। তিনি আরবের প্রসিদ্ধ গোত্র কাহ্ত্বান এর উপগোত্র আসবাহ্ অন্তর্ভূক্ত, এজন্য ‘আল-আসবাহী’ বলে পরিচিত।[1]
জন্ম ও প্রতিপালন :
ইমাম মালিক (রহ.) পবিত্র মদীনা নগরীতে এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষানুরাগী মুসলিম পরিবারে জন্মলাভ করেন। জন্মের সন নিয়ে কিছু মতামত থাকায় ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন : বিশুদ্ধ মতে ইমাম মালিক (রহ.)-এর জন্ম সন হল ৯৩ হিজরী, যে সনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খাদেম আনাস বিন মালিক (রা) মৃত্যুবরণ করেনই।[2]
তিনি পিতা আনাস বিন মালিকের কাছে মদীনায় প্রতিপালিত হন। তাঁর পিতা তাবে-তাবেঈ ও হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন, যার কাছ থেকে ইমাম যুহুরীসহ অনেকেই হাদীস বর্ণনা করেন। খুদ ইমাম মালিকও পিতার নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেন।[3] তাঁর দাদা আবূ আনাস মালিক (রহ.) প্রসিদ্ধ তাবেঈ ছিলেন, যিনি ওমার, আয়িশা ও আবু হুরায়রা (রা.) হতে হাদীস বর্ণনা করেন।[4] তাঁর পিতামহ আমির বিন আমর (রা) প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন।[5] এ সম্ভ্রান্ত দ্বীনী পরিবেশে জ্ঞানপিপাসা নিয়েই তিনি প্রতিপালিত হন।
শিক্ষা জীবন :
রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের পর হতে আজও পর্যন্ত দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র হলো মদীনা। সে মদীনাতে জন্মলাভ করার অর্থ হল দ্বীনী জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্রেই জন্ম লাভ করা। বিশেষ করে বংশীয়ভাবে তাঁদের পরিবার ছিল দ্বীনী জ্ঞানচর্চায় অগ্রগামী। এজন্য তিনি শৈশবকাল হতেই শিক্ষা শুরু করেন। বিশেষ করে তাঁর মাতা তাকে শিক্ষার প্রেরণা যোগান। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন : আমি একদিন মাকে বললাম, ‘‘আমি পড়ালিখা করতে যাব! মা বললেন : আস শিক্ষার লেবাস পড়, অতঃপর আমাকে ভাল পোষাক পড়ালেন, মাথায় টুঁপি দিলেন এবং তার উপর পাগড়ী পড়িয়ে দিলেন, এরপর বললেন : এখন পড়া লিখার জন্য যাও।
তিনি বলেন : মা আমাকে ভালভাবে কাপড় পড়িয়ে দিয়ে বলতেন : যাও মদীনার প্রসিদ্ধ আলিম রাবিয়াহর কাছে এবং তাঁর জ্ঞান শিক্ষার আগে তাঁর আদব আখ্লাক শিক্ষা কর।[6] এভাবে তিনি মদীনার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ফকীহদের নিকট হতে শিক্ষালাভ করেন।
ইমাম মালিকের (রহ.) শিক্ষক বৃন্দ : ইমাম মালিক (রহ.) অসংখ্য বিদ্যানের নিকট শিক্ষালাভ করেন। ইমাম যুরকানী (রহ.) বলেন : ‘‘ইমাম মালিক (রহ.) নয়শতর অধিক শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ইমাম মালিক স্বীয় গ্রন্থ মুয়াত্ত্বায় যে সব শিক্ষক হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদেরই সংখ্যা হল ১৩৫ জন, যাদের নাম ইমাম যাহাবী ‘‘সিয়ার’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।[7] তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নিম্নরূপ :
১. ইমাম রাবীয়া বিন আবূ আবদুর রহমান (রহ.)।
২. ইমাম মুহাম্মদ বিন মুসলিম আয্যুহুরী (রহ.)।
৩. ইমাম নাফি মাওলা ইবনু ওমার (রহ.)।
৪. ইব্রাহীম বিন উক্বাহ (রহ.)।
৫. ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ বিন সা’দ (রহ.)।
৬. হুমাইদ বিন কায়স আল ‘আরজ (রহ.)।
৭. আইয়ূব বিন আবী তামীমাহ আসসাখতিয়ানী (রহ.) ইত্যাদি।[8]
ইমাম মালিক (রহ.)-এর ছাত্র বৃন্দ : ইমাম মালিক (রহ.) হলেন ইমামু দারিল হিজরাহ, অর্থাৎ মদীনার ইমাম। অতএব মদীনার ইমামের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য কে না চায়। তাই তাঁর ছাত্র অগণিত। ইমাম যাহাবী উল্লেখযোগ্য ১৬৬ জনের নাম বর্ণনা করেছেন। ইমাম খাতীব বাগদাদী ৯৯৩ জন উল্লেখ করেন।[9] ইমামের প্রসিদ্ধ কয়েকজন ছাত্রের নাম নিম্নে প্রদত্ত্ব হল :
১. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস আশ্শাফেঈ (রহ.)।
২. ইমাম সুফাইয়ান বিন উয়ায়নাহ (রহ.)।
৩. ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রহ.)।
৪. ইমাম আবু দাউদ আত্তায়ালিসী (রহ.)।
৫. হাম্মাদ বিন যায়দ (রহ.)।
৬. ইসমাঈল বিন জাফর (রহ.)।
৭. ইবনু আবী আযযিনাদ (রহ.) ইত্যাদি।[10]
জ্ঞান গবেষণায় ইমাম মালিক (রহ.) :
ইমাম মালিক (রহ.) জন্মগতভাবেই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মেধা শক্তি ছিল খুবই প্রখর। আবূ কুদামাহ বলেন : ‘‘ইমাম মালিক স্বীয় যুগে সর্বাধিক মেধা শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।[11]
হুসাইন বিন উরওয়াহ হতে বর্ণিত : তিনি বলেন : ‘‘ইমাম মালিক বলেন : একদা ইমাম যুহুরী (রহ.) আমাদের মাঝে আসলেন, আমাদের সাথে ছিলেন রাবীয়াহ। তখন ইমাম যুহুরী (রহ.) আমাদেরকে চল্লিশের কিছু অধিক হাদীস শুনালেন। অতঃপর পরেরদিন আমরা ইমাম যুহুরীর কাছে আসলাম, তিনি বললেন : কিতাবে দেখ আমরা কি পরিমান হাদীস পড়েছি, আরো বললেন, গতকাল আমরা যে হাদীস বর্ণনা করেছি, তোমরা কি কিছু পড়েছ? তখন রাবীয়া বললেন : হ্যাঁ, আমাদের মাঝে এমনও ব্যক্তি আছেন যিনি গতকাল আপনার বর্ণনাকৃত সব হাদীস মুখস্ত শুনাতে পারবেন। ইমাম যুহুরী বললেন : কে তিনি? রাবিয়া বললেন : তিনি ইবনু আবী আমীর অর্থাৎ ইমাম মালিক। ইমাম যুহুরী বললেন : হাদীস শুনাও, ইমাম মালিক বলেন : আমি তখন গতকালের চল্লিশটি হাদীস মুখস্ত শুনালাম। ইমাম যুহুরী বলেন : আমার ধারণা ছিল না যে, আমি ছাড়া এ হাদীসগুলো এভাবে আর দ্বিতীয় কেউ মুখস্ত করেছে।
অতএব ইমাম মালিক (রহ.)-এর অসাধারণ পান্ডিত্বের সাথে গভীরভাবে জ্ঞান গবেষণা ও সংরক্ষণ সম্পর্কে আর বেশী কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না।
হাদীস শাস্ত্রে ইমাম মালিক (রহ.) : হাদীস শাস্ত্রে ইমাম মালিক (রহ.) এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, হাদীস সংকলনে অগ্রনায়ক। যদিও তাঁর পূর্বে কেউ কেউ হাদীস সংকলন করেন, যেমন ইমাম যুহুরী, কিন্তু ইমাম মালিক (রহ.)-এর হাদীসের সাধনা, সংগ্রহ ও সংকলন ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এজন্যই তাঁর সংকলিত গ্রন্থকে বলা হয়, ‘‘আল্লাহর কিতাব কুরআনের পর সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ ইমাম মালিকের মুয়াত্ত্বা গ্রন্থ।’’[12]
তিনি হাদীস শিক্ষায় পারিবারিকভাবে উৎসাহী হলেও তাঁর অসাধ্য সাধন এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অনেক অগ্রসর হয়েছেন। শয়নে স্বপনে সব সময় একই চিন্তা, কিভাবে তিনি হাদীস শিক্ষালাভ করবেন। মানুষ যখন অবসরে তখন তিনি হাদীসের সন্ধানে। ইমাম মালিক একদা ঈদের সালাতে ইমাম যুহুরীকে পেয়ে মনে করলেন, আজ মানুষ ঈদের আনন্দে ব্যস্ত, হয়ত ইমাম যুহুরীর কাছে একাকী হাদীস শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যাবে। ঈদের ময়দান হতে চললেন ইমাম যুহুরীর বাসায়, দরজার সামনে বসলেন, ইমাম ভিতর থেকে লোক পাঠালেন গেটে দেখার জন্য, ইমামকে জানানো হল যে, গেটে আপনার ছাত্র মালিক, ইমাম বললেন : ভিতরে আসতে বল। ইমাম মালিক বলেন, আমি ©র্ভতরে গেলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মনে হয় তুমি সালাতের পর বাড়ীতে যাওনি? আমি বললাম : হ্যাঁ যাইনি, জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু খেয়েছ কি? আমি বললাম : না, তিনি বললেন : খাও, আমি বললাম : খাওয়ার চাহিদা নেই। তিনি বললেন, তাহলে তুমি কি চাও? আমি বললাম : আমাকে হাদীস শিখান, অতঃপর তিনি আমাকে সতেরটি হাদীস শিখালেন।[13]
ইমাম মালিক (রহ.) বেশীভাগ সময় একাকী থাকা পছন্দ করতেন, তাঁর বোন পিতার কাছে অভিযোগ করলেন, আমাদের ভাই মানুষের সাথে চলাফিরা করে না। পিতা জবাব দিলেন : মা তোমার ভাই রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীস মুখস্ত করায় ব্যস্ত, তাই একাকী থাকা পছন্দ করে।[14]
হাদীস সংগ্রহে কঠোর সতর্কতা:
ইমাম মালিক (রহ.) হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে সদা ব্যস্ত হলেও যেখানেই বা যার কাছেই হাদীস পেলে তিনি তা গ্রহণ করতেন না, যতক্ষণ না হাদীস বর্ণনাকারীর ঈমান-আক্বীদাহ ও সততা সম্পর্কে অবগত হতে পারতেন। বিশ্বস্ত প্রমাণিত হলে হাদীস গ্রহন করতেন। ইমাম সুফাইয়ান ইবনু উইয়ায়না (রহ.) বলেন : ‘‘আল্লাহ তা’আলা ইমাম মালিককে রহম করুন, তিনি হাদীসের বর্ণনাকারীর ব্যাপারে খুব কঠিনভাবে যাচাই বাছাই করতেন (সহজেই কারো হাদীস গ্রহণ করতেন না)।’’ আলী বিন মাদীনী (রহ.) বলেন : ‘‘হাদীস গ্রহণে কঠোর নীতি ও সতর্কতায় ইমাম মালিকের ন্যায় আর কেউ আছে বলে আমি জানিনা।’’[15] ইমাম মালিক বিদ’আতীদের থেকে হাদীস গ্রহণ করতেন না।[16] এ সতর্কতা শুধু তিনি নিজেই অবলম্বন করেন নি, বরং তিনি অন্যদেরকেও গুরুত্বারোপের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন :
‘‘হাদীস হল দ্বীনের অন্যতম বিষয়, অতএব ভালভাবে লক্ষ কর তোমরা কার নিকট হতে দ্বীন গ্রহণ করছ। আমি সত্তর জন এমন ব্যক্তি পেয়েছি যারা রাসূল (ছাঃ)-এর নামে হাদীস বর্ণনা করে, কিন্তু আমি তাদের কিছুই গ্রহণ করিনি। যদিও তারা অর্থ সম্পদে আমানতদার হয়, কিন্তু এ বিষয়ে তাদেরকে আমি যোগ্য মনে করিনি। অথচ আমাদের মাঝে ইমাম যুহুরীর আগমন হলে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে আমরা তাঁর দরবারে ভীর জমাতাম’’।[17]
সুতরাং ইমামু দারিল হিজরা বা মাদীনার ইমাম মালিক (রহ.) রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহে যেমন জীবন উৎসর্গ করেছেন, তেমনি হাদীস সংরক্ষণে খুব কঠোর ভূমিকা রেখেছেন।
হাদীস পালনে ইমাম মালিক (রহ.):
হাদীস শুধু কিতাবের পাতায় নয়, বরং তা বাস্তবে পালনের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলেন ইমাম মালিক (রহ.)। আব্দুল্লাহ বিন বুকাইর বলেনঃ আমি ইমাম মালিককে বলতে শুনেছি তিনি বলেন : ‘‘আমি কোন আলিমের কাছে যখন বসেছি। অতঃপর তার কাছ হতে বাড়ীতে আসলে তার কাছে শুনা সব হাদীস মুখস্ত করে ফেলি এবং ওই হাদীসগুলির মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত বা আমল না করা পর্যন্ত ওই আলিমের বৈঠকে ফিরে যাইনি।’’[18]
হাদীস শিক্ষাদান ও ফতোয়া প্রদান:
ইমাম মালিক (রহ.) শুধু হাদীস শিক্ষা ও আমল করেই ক্ষান্ত হননি, বরং শিক্ষার পাশাপাশি মানুষকে শিক্ষা দান ও ফতোয়া প্রদানে বিড়াট অবদান রেখেছেন। ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন : ইমাম মালিক (রহ.) ২১ বছর বয়সে হাদীসের পাঠদান ও ফতোয়া প্রদানে পূর্ণ যোগ্যতা লাভ করেন।[19] ইমাম মালিক (রহ.) বলেন : ইচ্ছা করলেই শুধু হাদীস শিক্ষা ও ফতোয়া প্রদানের জন্য মসজিদে বসা যায় না, রবং এ ক্ষেত্রে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিতে হবে, তারা যদি উপযুক্ত মনে করেন তাহলে এ কাজের জন্য নিয়োজিত হতে পারে। সত্তর জন বিজ্ঞ পন্ডিত- শাইখের আমার ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদানের পর আমি এ কাজে নিয়োজিত হই।[20] মুস্‘আব বিন আব্দুল্লাহ বলেন : ‘‘ইমাম মালিককে কোন হাদীস জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অযূ করে ভাল পোষাক পড়ে সুন্দরভাবে প্রস্ত্ততি নিতেন, তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাবে বলেন : এ হল রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীসের জন্য সম্মান প্রদর্শন।’’[21] সারা মুসলিম বিশ্ব হতে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র মদীনায় জ্ঞান পিপাসুরা শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান এবং ইমাম মালিকের মত মুহাদ্দিসের নিকট হতে হাদীস শিক্ষালাভ করে ধন্য হতেন।
ইমাম মালিক (রহ.) ফতোয়া প্রদানেও যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করতেন। জটিল বিষয়গুলো দীর্ঘ গবেষণার পর ফতোয়া প্রদান করতেন। ইবনু আব্দুল হাকীম বলেন : ‘‘ইমাম মালিককে (রহ.) কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি প্রশ্নকারীকে বলতেন যাও আমি ওই বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করি।’’ আব্দুর রহমান বিন মাহদী বলেন : ইমাম মালিক বলেন, ‘‘কখনও এমন মাস‘আলা এসেছে যে, চিন্তা-গবেষণা করতে আমার গোটারাত কেটেগেছে।’’[22] ইমাম মালিক (রহ.) কোন বিষয় উত্তর না দেয়া ভাল মনে করলে ‘‘জানি না’’ বলতেও কোন দ্বিধাবোধ করতেন না।[23] কারণ তিনি মনে করতেন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া মানে জান্নাত ও জাহান্নামের সম্মুখীন হওয়া। প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যেন আখিরাতে জবাব দিহিতার সম্মুখীন হতে না হয়।[24]
সঠিক আক্বীদাহ বিশ্বাসে ইমাম মালিক (রহ.) : আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বীদাহ-বিশ্বাসের অন্যতম ইমাম হলেন ইমাম মালিক (রহ.)। বিশেষ করে আল্লাহ তা’আলার সিফাত গুণাবলীর প্রতি ঈমানের যে ক্বায়দা বা নীতি ইমাম মালিক (রহ.) মুতাযিলাদের প্রতিবাদে বর্ণনা করেন, সেটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি। যেমন ইমাম ইবনু আবিল ইয্ আল হানাফী শারহুল আক্বীদাহ আত তাহাবিয়ায় উল্লেখ করেন।[25] কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসের আলোকে ইমাম মালিক (রহ.) ঈমান আক্বীদাহর সকল বিষয়ে হকপন্থীদের সাথে একমত ছিলেন।[26]
ইমাম মালিক (রহ.) সম্পর্কে আলিম সমাজের প্রশংসা :
১. ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেন : ‘‘আলিম সমাজের আলোচনা হলে ইমাম মালিক তাদের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র, কেউ ইমাম মালিকের স্মৃতিশক্তি, দৃঢ়তা, সংরক্ষণশীলতা ও জ্ঞানের গভীরতার সমপর্যায় নয়। আর যে ব্যক্তি সহীহ হাদীস চায় সে যেন ইমাম মালিকের কাছে যায়।’’[27]
২. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) বলেন : ‘‘বিদ্যানদের অন্যতম একজন ইমাম মালিক, তিনি হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে একজন অন্যতম ইমাম, জ্ঞান-বুদ্ধি ও আদাব আখলাকসহ হাদীসের প্রকৃত অনুসারী ইমাম মালিকের মত আর কে আছে?’’[28]
৩. ইমাম নাসাঈ (রহ.) বলেন : ‘‘তাবেঈদের পর আমার কাছে ইমাম মালিকের চেয়ে অধিক বিচক্ষণ আর কেউ নেই এবং হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে অধিক আমানতদার আমার কাছে আর কেউ নেই।’’[29]
ইমাম মালিকের (রহ.) গ্রন্থাবলী:
ইমাম মালিক (রহ.)-এর বেশ কিছু রচনাবলী রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল :
১. আল মুয়াত্ত্বা।[30] হাদীসের জগতে কিছু ছোট ছোট সংকলন শুরু হলেও ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্ত্বা’ সর্ব প্রথম হাদীসের উল্লেখযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য সংকলন। এ গ্রন্থে ইমাম মালিক (রহ.) রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীস, সাহাবী ও তাবেঈদের হাদীস এবং মদীনাবাসীর ইজমা সহ অনেক ফিকহী মাসআলা বিশুদ্ধ সনদের আলোকে সংকলন করেন। তিনি দীর্ঘদিন সাধনার পর, কেউ বলেন চল্লিশ বৎসর সাধনার পর এ মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন। সে সময় বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে হাদীসের গ্রন্থ ‘মুয়াত্ত্বা’ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন : ‘‘কিতাবুল্লাহ অর্থাৎ কুরআন এর পরই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ হল ইমাম মালিকের ‘‘মুয়াত্ত্বা’’।[31] হ্যাঁ, সহীহ বুখারীর সংকলনের পূর্বে মুয়াত্ত্বাই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ ছিল। অবশ্য এখন সহীহ বুখারী সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ।
২. ‘‘কিতাবুল মানাসিক’’,[32]
৩. ‘‘রিসালাতুন ফিল কাদ্র ওয়ার্রাদ আলাল কাদারিয়া’’।[33]
৪. ‘‘কিতাব ফিন্নুজুমি ওয়া হিসাবি মাদারিয্যামানি ওয়া মানাযিলিল কামারি’’।[34]
৫. ‘‘কিতাবুস্সিররি’’।[35]
৬. ‘‘কিতাবুল মাজালাসাত’’।[36] ইত্যাদি সহীহ সনদে প্রমাণিত যে, এ সব ইমাম মালিক (রহ.)-এর সংকলিত ও রচিত গ্রন্থ। ইহা ছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থ রয়েছে।[37]
ইমাম মালিক (রহ.)-এর মৃত্যুবরণ : ইমাম মালিক (রহ.) ১৭৯ হিঃ রবিউল আউয়াল মাসে ৮৬ বছর বয়সে মদীনা মুনাওয়ারায় মৃত্যুবরণ করেন। এবং তাকে মদীনার কবরস্থান ‘‘বাকী’’তে দাফন করা হয়।[38] আল্লাহ তাঁকে রহম করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দান করুন। আমীন!
– আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী

[1] তারতীবুল মাদারিক, ১/১০২ পৃঃ, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৪৮ পৃঃ, আল-আনসাব লিস্সাম আনী, ১/২৮৭ পৃঃ, আত্-তামহীদ, ১/৮৯ পৃঃ, মানাকিব মালিক লিয্যাওয়াবী, ১৬০-১৬২ পৃঃ, আল-ইনতিকা, ৯-১১ পৃঃ ইত্যাদি।
[2] তারতীবুল মাদারিক, ১/১১০ পৃঃ, মানাকিব মালিক লিয্যাওয়াবী, ১৫৯ পৃঃ।
[3] মান্হাজু ইমাম মালিক, ২২ পৃঃ।
[4] তারতীবুল মাদারিক, ১/১০৭ পৃঃ।
[5] আল ইসাবাহ ৭/২৯৮ পৃঃ।
[6] তারতীবুল মাদারিক, ১/১১৯ পৃঃ।
[7] সিয়ারা আলামুন্নুবালা, ৮/৪৯ পৃঃ।
[8] সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৪৯-৫১ পৃঃ।
[9] তারতীবুল মাদারিক, ১/২৫৪ পৃঃ। সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৫২ পৃঃ।
[10] সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৫২-৫৪ পৃঃ।
[11] আত্-তামহীদ, ১/৮১ পৃঃ।
[12] আত্তামহীদ, ১/৭৬-৭৯ পৃঃ, আল-হুলিয়াহ, ৬/৩২৯ পৃঃ, অবশ্য এ মন্তব্য সহীহ বুখারীর পূর্বে, সহীহ বুখারী সংকলনের পর বুখারী সর্ববিশুদ্ধ গ্রন্থ।
[13] তারতীবুল মাদারিক, ১/১২১ পৃঃ।
[14] তারতীবুল মাদারিক, ১/১১৯ পৃঃ।
[15] আল ইরশাদ লিল খালিলী, ১/১১০-১১২ পৃঃ।
[16] আল মুহাদ্দিস আল ফাসিল, (৪১৪-৪১৬) পৃঃ, আল ইনতিকা ১৬ পৃঃ, আত্-তামহীদ, ১/৬৭ পৃঃ।
[17] আল মুহাদ্দিস আল ফাসিল, (৪১৪-৪১৬) পৃঃ, আল ইনতিকা ১৬ পৃঃ, আত্-তামহীদ, ১/৬৭ পৃঃ।
[18] ইত্হাফুস সালিক দ্রঃ মানহাজু ইমাম মালিক, ৩৪ পৃঃ।
[19] সিয়ারু আলামিন্নুবালা, ৮/৫৫ পৃঃ।
[20] আল-হুলিইয়্যাহ, ৬/৩১৬ পৃঃ।
[21] তার তীবুল মাদারিক, ১/১৫৪ পৃঃ।
[22] আল ইনতিকা, ৩৭-৩৮ পৃঃ।
[23] তায্ইনুল মামালিক, ১৬-১৭ পৃঃ।
[24] আল ইনতিকা, ৩৭ পৃঃ।
[25] শারহুল আক্বীদাহ আত তাহাবীয়াহ, ১/১৮৮ পৃঃ।
[26] বিস্তারিত দ্রঃ মানহাজুল ইমাম ফি ইছবাতিল আক্বীদাহ- ডঃ সউদ বিন আব্দুল আযীয আদ দা‘জান।
[27] আল ইনতিকা, ২৩, ২৪ পৃঃ।
[28] তারতীবুল মাদারিক, ১/১৩৩ পৃঃ।
[29] আল্ ইনতিকা, ৩১ পৃঃ।
[30] তানাবীরুল হাওয়ালিক, ১/৭ পৃঃ।
[31] তারতীবুল মাদারিক, ১/১৯১-১৯৬ পৃঃ, আত্তামহীদ, ১/৭৬-৭৯ পৃঃ।
[32] তায্ইনুল মামালিক, ৪০ পৃঃ, মালিক লি আমীন আল খাওলী, ৭৪৫ পৃঃ।
[33] তারতীবুল মাদারিক, ১/২০৪ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৮৮ পৃঃ।
[34] তারতীবুল মাদারিক, ১/২০ ৫ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৮৮ পৃঃ।
[35] তারতীবুল মাদারিক, ১/২০৫ পৃঃ, সিয়ারু আলামুন্নুবালা, ৮/৮৯ পৃঃ।
[36] তাযইনুল মামালিক, ৪০ পৃঃ, মালিক লি আমীন আল খাওলী, ৭৪৬ পৃঃ।
[37] মানহাজু ইমাম মালিক ফি ইছবাতিল আকীদাহ, ৫১-৫৫ পৃঃ।
[38] আত্তামহীদ, ১/৯২ পৃঃ, তারতীবুল মাদারিক, ২/২৩৭-২৪১ পৃঃ, সিয়ারু আলামিন্নুবালা, ৮/১৩০-১৩৫ পৃঃ।

দাওয়াতি কাজ সকল মুসলিমের জন্য ফরজ এবং সাধারণ মানুষদের দাওয়াতি কাজের কতিপয় পদ্ধতি

  ▬▬▬✪✪✪▬▬▬ প্রশ্ন: সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ কি সবার উপরে ফরজ? যাদের দ্বীনের জ্ঞান নেই যেমন জেনারেল লাইনে পড়া মানুষ কিন্তু দ্বীন জানার...