Thursday, December 13, 2018

ইসলামের দৃষ্টিতে তাবিজ কবচ

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

লেখক : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
প্রচারেঃজাহিদ হাসান নিলয়  

ইসলামের দৃষ্টিতে তাবিজ-কবচের বিধান

আমাদের দেশে কতক পীর-ফকির, আলেম-জাহেল, কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত অনেকেই তাবিজ-কবচ, তাগা, কড়ি, সামুক, ঝিনুক ও গাছ-গাছালির শিকর-বাকর ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন এবং ইহা বৈধ ও জায়েজ মনে করেন। এ সম্পর্কে বাজারে কিছু বই পুস্তক পাওয়া যায়, সে সব বইয়ে নির্ধারিত বিষয়ে গ্রহণ যোগ্য কোন দলিল নেই, আছে কিছু মনগড়া কিচ্ছা-কাহিনী, অসংখ্য তদবিরের বর্ণনা ও তার বানোয়াট ফাজায়েল। এ সব বই পড়ে কেউ কেউ   বিপদাপদ, দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, রোগ, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের আশায় বিভিন্ন তদবির ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয় ও তা গ্রহণ করে। তারা এ ধরণের চিকিৎসার মূল্যায়ন ও তার বৈধতা-অবৈধতা সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। আমি অত্র নিবন্ধের মাধ্যমে এ বিষয়টির তত্ত্ব ও স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং ইসলামের দৃষ্টিতে তার হুকুম বর্ণনার প্রয়াস পেয়েছি।
এক. সাহাবি ইমরান বিন হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত : একদা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির হাতে তামার চুড়ি দেখে বললেন, এটা কি? সে বলল: এটা অহেনার অংশ। {অহেনার অর্থ এক প্রকার হাড়, যা থেকে কেটে ছোট ছোট তাবিজ আকারে দেয়া হয়।} তিনি বললেন: এটা খুলে ফেল, কারণ এটা তোমার দূর্বলতা বাড়ানো ভিন্ন কিছুই করবে না। যদি এটা বাঁধা অবস্থায় তোমার মৃত্যু হয়, তবে কখনও তুমি সফল হবে না। ( সুনানে ইবনে মাজাহ,হাদীস নং ৩৫৩১; হাদিসটি সহিহ্)
দুই. উকবা বিন আমের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলকে বলতে শুনেছি: যে ব্যক্তি তাবিজ লটকালো, আল্লাহ তাকে পূর্ণতা দেবেন না, আর যে কড়ি ব্যবহার করবে, আল্লাহ তাকে মঙ্গল দান করবেন না।’ [মুসনাদআহমদ, হাদীস নং ১৬৯৫১; আহাইখ আলবানী হাদীসটিকে দাইফ বলেছেন]
তিন. উকবা বিন আমের আল-জোহানি রাদিআল্লাহু আনহু বলেন : ‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে একদল লোক উপস্থিত হল। তিনি দলটির নয়জনকে বায়আত করলেন একজনকে করলেন না। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! নয়জনকে বায়আত করলেন একজনকে করলেন না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তার সাথে তাবিজ রয়েছে। অতঃপর তিনি স্বহস্তে তা ছিড়ে ফেললেন এবং তাকে বায়আত করলেন, আর বললেন, যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করল সে শিরক করল।’ [মুসনাদে আহমেদ; হাদীস নং ১৬৯৬৯, শাইখ আলবানীর মতে এই হাদীসটি সহীহ]
চার. একদা হুজায়ফা রাদিআল্লাহু আনহু এক ব্যক্তির হাতে জ্বরের একটি তাগা দেখতে পেয়ে তা কেটে ফেলেন। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করেন : তাদের অধিকাংশ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে শিরক করা অবস্থায়।‘ {ইউসুফ : ১০৬} [তাফসিরে ইবনে কাসির]। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সাহাবি হুজায়ফার মতে তাগা ব্যবহার করা শিরক।
পাঁচ. তাবেয়ি আব্দুল্লাহ বিন উকাইম সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি কোন কিছু ধারণ করবে, তাকে ঐ জিনিসের কাছেই সোপর্দ করা হবে।’ [সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ৪০৭৯; সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং ২০৭২]
ছয়. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহর স্ত্রী জয়নব রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদিন আব্দুল্লাহ বাড়িতে এসে আমার গলায় তাগা দেখতে পান। তিনি বললেন, এটা কী? আমি বললাম, এটা পড়া তাগা। এতে আমার জন্য ঝাঁড়-ফুঁক দেয়া হয়েছে। তা নিয়ে তিনি কেটে ফেললেন এবং বললেন, আব্দুল্লাহর পরিবার শিরক থেকে মুক্ত। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: ঝাড়-ফুঁক, সাধারণ তাবিজ ও ভালোবাসা সৃষ্টির তাবিজ ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে শিরক।[সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৮৮৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৩৫৩০]
এ সব দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, তাবিজ ব্যবহার করা হারাম ও শিরক।

তাবিজ ইত্যাদি ব্যবহার করা ছোট শিরক না বড় শিরক?

কেউ যদি তাবিজ-কবচ, মাদুলি-কড়ি, সামুক-ঝিনুক, গিড়া, হাঁড়, তাগা-তামা-লোহা বা অনুরূপ কোন ধাতব বস্তু গলায় বা শরীরের কোথায়ও ধারণ করে এবং এ ধারণা পোষণ করে যে, ঐ গুলো বালা-মুসিবত দূর করার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ক্ষমতা রাখে, তবে তা বড় শিরক। আর যদি এ ধরনের ধারণা না হয়, তবে তা ছোট শিরক।
শায়খ সুলাইমান বিন আব্দুল্লাহ বলেছেন, বালা-মুসিবত দূর করার উদ্দেশ্যে গিড়া, তাগা পরিধান করা ছোট শিরক। অর্থাৎ যদি তা মাধ্যম বা উসিলা মনে করে ব্যবহার করা হয়। শায়খ আব্দুল আজিজ বিন বাজ বলেছেন, শয়তানের নাম, হাড়, পূঁতি, পেরেক অথবা তিলিস্মা অর্থাৎ অর্থবিহীন বিদঘুটে  শব্দ বা অক্ষর প্রভৃতি বস্তু দিয়ে তাবিজ বানানো ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত। ফাতহুল মাজিদ গ্রন্থের টীকায় তিনি আরো বলেছেন: তাবিজ ব্যবহার করা জাহেলি যুগের আমল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাবিজ-কবচ অনেক ধর্মের প্রতিকি চিহ্ন ছিল। যেমন হিন্দু পুরোহিতদের মাদুলী ধারণ করা, বিশেষ করে কালী শিবের পূজায়। উয়ারী সম্প্রদায়ের আকীদার অন্যতম প্রতিক ছিল বিভিন্ন ধরণের তাবিজ।
শায়খ হাফেজ হেকমি বলেন: ‌’কুরআন ও হাদিস ব্যতীত, ইহুদিদের তিলিসমাতি, মূর্তি পূজারী, নক্ষত্র পূজারী, ফেরেশতা পূজারী এবং জিনের খিদমত গ্রহণকারী বাতিল পন্থীদের তাবিজ ব্যবহার; অনুরূপভাবে পূঁতি, ধনুকের ছিলা, তাগা এবং লোহার ধাতব চুড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে শিরক। কারণ, এগুলো সমস্যা সমাধানের বৈধ উপায় কিংবা বিজ্ঞান সম্মত ঔষধ নয়। এ হল সেসব তাবিজ কবচের হুকুম যাতে কুরাআনের আয়াত, হাদিসের দোয়া দরুদ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় না তার

কুরআন-হাদিসের তাবিজ :

হ্যাঁ, যে সব তাবিজ-কবচে কুরআন হাদিস ব্যবহার করা হয় সে ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। এক শ্রেণীর আলেম কুরআন-হাদিসে বর্ণিত দুআ সমূহের তাবিজ ব্যবহার করা বৈধ মনে করেন। যেমন, সাঈদ বিন মুসাইয়িব, আতা আবু জাফর আল-বাকের, ইমাম মালেক। এক বর্ণনা মতে ইমাম আহমদ, ইবনে আব্দুল বার, বাইহাকি, কুরতুবি, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়িম এবং ইবনে হাজারও রয়েছেন। তাদের দলিল, আল্লাহ তাআলা বলেন, আর আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করেছি যা রোগের সু-চিকিৎসা এবং মুমিনদের জন্য রহমত।‘ [সূরা আল-ইসরা:৮২]  এক কল্যাণময় কিতাব, ইহা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা আস-সাদ:২৯] সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আমরের ব্যক্তিগত আমল সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি নিজ ছোট বাচ্চা, যারা দোয়া মুখস্থ করতে অক্ষম, তাদেরকে অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য গায়ে দোয়ার তাবিজ ঝুলিয়ে দিতেন। দোয়াটি এই:‘আল্লাহর নামে তাঁর পরিপূর্ণ বাণী সমূহের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তাঁর গজব ও শাস্তি থেকে, তাঁর বান্দাদের অনিষ্টতা থেকে এবং শয়তানদের কুমন্ত্রণা ও তাদের উপস্থিতি থেকে।’ [ মুসনাদে আহমেদ, হাদীস নংঃ৬৬৯৬; সুনানে তিরিমিজী, হাদীস নং ৩৫২৮; হাদিসটি হাসান]
পক্ষান্তরে অধিকাংশ সাহাবি ও তাদের অনুসারীদের মতে কুরআন ও হাদিসের তাবিজ ব্যবহার করাও নাজায়েজ। তাদের মধ্যে রয়েছেন: আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, ইবনে আব্বাস, হুযাইফা, উকবা বিন আমের, ইবনে উকাইম, ইব্রাহিম নখয়ি, একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমদ, ইবনুল আরাবি, শায়খ আব্দুর রহমান বিন হাসান, শায়খ সুলাইমান বিন আব্দুল ওয়াহহাব, শায়খ আব্দুর রহমান বিন সাদি, হাফেজ আল-হেকমি এবং মুহাম্মদ হামিদ আলফাকি। আর সমসাময়ীক মনীষীদের মধ্যে আছেন শায়খ আলবানি ও শায়খ আব্দুল আজিজ বিন বাজ। তারা বলেন,
প্রথমত: উল্লেখিত আয়াত দ্বারা তাবিজের বৈধতা প্রমাণিত হয় না। উপরন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের দ্বারা চিকিৎসা করার স্বরূপ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, আর তা হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। এ ছাড়া কুরআনের আয়াত তাবিজ আকারে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোন প্রমাণ নেই, এমনকি সাহাবাদের থেকেও।
তা ছাড়া ইমাম আবু দাউদ বলেছেন, সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আমেরের বর্ণিত হাদিসের সূত্র (সনদ) হাদিস বিশারদদের নিকট বিশুদ্ধ নয়। আর শুদ্ধ হলেও এটা তার একার আমল, যা অসংখ্য সাহাবির বিপরীত হওয়ার ফলে এবং এর স্বপক্ষে কোন দলিল না থাকার কারণে অন্য সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়।
আরেকটি কারণ, যেসব দলিলের মাধ্যমে তাবিজ নিষিদ্ধ প্রমাণিত হয়েছে, সেসব দলিলে পৃথক করে কুরআন-হাদিসের তাবিজ বৈধ বলা হয়নি। যদি বৈধ হত, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তা বলে দিতেন। যেমন তিনি শিরক মুক্ত ঝাড়-ফুকের ব্যাপারটি অনুমতি দিয়েছেন। মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের ঝাড়-ফুঁক আমার কাছে পেশ কর, ওটা শিরকের আওতাধীন না হলে তাতে কোন বাধা নেই।’[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২০০]
পক্ষান্তরে তিনি তাবিজ সম্পর্কে এরূপ কিছু বলেননি।
দ্বিতীয়ত: সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের ছাত্র ইব্রাহিম নখয়ি বলেন, তারা অর্থাৎ আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের সঙ্গী-সাথী ও শিষ্যগণ কুরআন বা কুরআনের বাইরের সব ধরণের তাবিজ অপছন্দ করতেন। যেমন আলকামা, আসওয়াদ, আবু ওয়ায়েল, হারেস বিন সোয়ায়েদ, ওবায়দা সালমানি, মাসরুক, রাবি বিন খায়সাম এবং সোয়ায়েদ বিন গাফলাহ প্রমুখ তাবেয়িগণ। [ফতহুল মজিদ]
তৃতীয়ত: অবৈধ পন্থার পথ রুদ্ধ করার জন্য শরিয়ত অনেক বৈধ কাজও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সে হিসেবে নিষিদ্ধ তাবিজ থেকে উম্মতকে হিফাজত করার লক্ষ্যে বৈধ তাবিজও নিষিদ্ধ করা উচিত। কারণ এ পথ খোলা রাখলে বাতিল তাবিজপন্থীরা সাধারণ মানুষের মন আল্লাহর ওপর ভরসা থেকে বিমুখ করে, তাদের লিখিত তাবিজের প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলার সুযোগ পাবে। শুধু তাই নয়, ঐ সব শয়তানদের প্ররোচনার কারণে কতক সাধারণ মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আর তারা মানুষের আসক্তি দেখে তাদের সহায়-সম্পদ লুটে নেয়ার ফন্দি আটে। যেমন, তাদেরকে বলে, তোমাদের পরিবারে, ধন সম্পত্তিতে বা তোমার ওপর এরূপ বিপদ আসবে। অথবা বলে, তোমার পিছনে জিন লেগে আছে ইত্যাদি। এভাবে এমন কতগুলো শয়তানি কথা-বার্তা তুলে ধরে যা শুনে সে মনে করে, এ লোক ঠিকই বলছে। সে যথেষ্ট দয়াবান বলেই আমার উপকার করতে চায়। এভাবেই সরলমনা মূর্খ লোকেরা তাদের কথায় বিশ্বাস করে ও অতঃপর ভয়ে অস্থির হয়ে যায়, আর তার কাছে সমাধান তলব করে। তাই তাবিজ কুরআন-হাদিসের হলেও ব্যবহার করা, রুগির বালিশের নীচে রাখা বা দেয়ালে ঝোলানো নাজায়েজ বলাই অধিকতর শ্রেয়।
একটি সংশয়: অনেকে বলে থাকেন, তাবিজ, কবচ ইত্যাদি আমরা দোয়া-দরুদ ও প্রাকৃতিক ঔষধের ন্যায় ব্যবহার করি। যদি তার অনুমোদন থাকে তবে তাবিজ কবচ নিষিদ্ধ কেন?
এর উত্তর হচ্ছে: অসুখ-বিসুখ ও বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি পাওয়ার পদ্ধতি দুইটি :
এক. যা সরাসরি কুরআনের আয়াত বা রাসূলের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। একে শরিয়তি উপায় বা চিকিৎসা (রুকিয়া) বলা যেতে পারে। যেমন ঝাঁড় ফুক ইত্যাদি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করে দেখিয়েছেন এবং যার বর্ণনা হাদিসের বিভিন্ন কিতাবে রয়েছে। এ গুলো আল্লাহর ইচ্ছায় বান্দার মঙ্গল সাধন বা অমঙ্গল দূর করে।
দুই. প্রাকৃতিক চিকিৎসা অর্থাৎ বস্তু ও তার প্রভাবের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক, যা খুবই স্পষ্ট এমনকি মানুষ সেটা বাস্তবে অনুভব ও উপলব্ধি করতে পারে। যেমন: বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি করা ঔষধ। ইসলামি শরিয়ত এগুলো ব্যবহার করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছে। কারণ, এগুলো ব্যবহার করার অর্থই হচ্ছে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা, যিনি এ সব জিনিসে নির্দিষ্ট গুণাবলি দান করেছেন এবং তিনি ইচ্ছা করলে যে কোন সময় এসব বস্তুর গুন ও ক্রিয়া বাতিল করে দিতে পারেন। যেমন তিনি বাতিল করেছিলেন ইব্রাহিমের আলাইহিস সালামের জন্য প্রজ্বলিত অগ্নির দাহন ক্রিয়া। কিন্তু তাবিজ ইত্যাদির মধ্যে আদৌ কোন ফলদায়ক প্রভাব নেই এবং তা কোন অমঙ্গল দূর করতে পারে না। এতে জড় বস্তুর কোন প্রভাবও নেই। তাছাড়া, মহান আল্লাহ এগুলোকে কোন শরয়ি মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করেননি। মানুষও স্বাভাবিকভাবে এগুলোর কোন প্রভাব প্রতিক্রিয়া দেখে না, অনুভবও করতে পারে না। এ জন্য অনেকে বলেছেন, এগুলোর ওপর ভরসা করা, মুশরিকদের ন্যায় মৃত ব্যক্তি ও মূর্তির ওপর ভরসা করার সমতুল্য; যারা শুনে না, দেখে না, কোন উপকারও করতে পারে না, আর না পারে কোন ক্ষতি করতে। কিন্তু তারা মনে করে, এগুলো আল্লাহর কাছ থেকে তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, অথবা অমঙ্গল প্রতিহত করবে। আল্লাহ বলেন, ” বল রহমানের শাস্তি থেকে কে তোমাদের রক্ষা করবে দিনে ও রাতে? বরং তারা তাদের পালনকর্তার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।”[সূরা আল-আম্বিয়াঃ৪২]
উদাত্ত আহব্বান: এখনো যে সব আলেম-ওলামা তাবিজ-কবচ নিয়ে ব্যস্ত তাদের দরবারে আমাদের সবিনয় অনুরোধ, এর থেকে বিরত থাকুন। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগ, সাধারণ মানুষ খুব সহজেই টি্ভি চ্যানেল, ইন্টারনেট ও বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছে যে, তাবিজ-কবচ বৈধ নয় বা ইসলামে এর কোন স্বীকৃতিও নেই। এমতাবস্থায় যারা তাবিজ-কবচ করেন বা বৈধ বলেন তাদের ব্যাপারে তারা বিব্রতকর অবস্থায় পতিত হন। আল-হামদু লিল্লাহ, বর্তমান সময়ে আরবি শিক্ষিত ও সাধারণ শিক্ষিত অনেক ব্যক্তি, বিশেষ করে তরুন প্রজন্ম তাবিজ-কবজের অসারতা বুঝতে পেরে এর বিরোদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। নিজে রিবত থাকছেন এবং অপরকে বিরত থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। যেহেতু এটা আকীদার বিষয়, তাই এখানে শিথিলতার কোন সুযোগ নেই। অতএব, এ থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি। আল্লাহ সহায়।
সমাপ্ত

সুন্নাহ সম্পর্কে সাহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গী – ২

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-
                                 লেখকঃ মেরিনার।    মূল লেখা:জামাল আদ-দ্বীন জারাবোজো
প্রচারেঃজাহিদ হাসান নিলয়
[সুন্নাহকে মুসলিম জীবনে বাতিল ও অগুরুত্বপূর্ণ প্রমান করা হচ্ছে ইসলামবিদ্বেষী সকল অবিশ্বাসী এবং ইসলামী বিশ্বের আধুনিকতাবাদী তথা প্রগতিশীলদের একটা অন্যতম লক্ষ্য! কারণটা খুব সাধারণ: সুন্নাহ্ না থাকলে, ইসলামেরই আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না এবং কুরআন ও ইসলামকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যাখা করার সুযোগ তৈরী হবে।  মুসলিম উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম সাহাবীরা (রা.) সুন্নাহকে কি চোখে দেখতেন তার ২য় পর্ব দেখবো আজ আমরা ]
(………পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৫)আব্দুল্লাহ্‌ ইবন ওমর (রা.), রাসূল (সা.) থেকে বর্ণণা করেন যে, তিনি বলেন, “তোমাদের মেযেদের রাতে মসজিদে যেতে দিও ৷” আব্দুল্লাহর (রা.) একজন ছেলে বললেন যে, তিনি তা করবেন না ৷ এটা আব্দুল্লাহ (রা.) তাঁর ছেলেকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করলেন, তার বুকে ধাক্কা দিলেন এবং বললেন, “আমি আল্লাহর রাসূলের (সা.) একটা হাদীস তোমাকে বললাম, আর তুমি বলছো ‘না’ ৷” [জামে তিরমিজী ৭০৯/১; বুখারী ৩০৫/১] এই ঘটনায় আব্দুল্লাহ্‌ ইবন ওমর (রা.), যিনি সাহাবীদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানীদের একজন ছিলেন, তিনি তাঁর ছেলের বুকে এইজন্য আঘাত করেছিলেন যে, তাঁর ছেলে নবীর (সা.) একটা আদেশ না মানার প্রবণতা দেখিয়েছিলেন ৷ আব্দুল্লাহর (রা.) বক্তব্য থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, তিনি এমন একটা কিছু বলছিলেন: “আমি তোমাকে নবীর (সা.) একটা বক্তব্য শোনাচ্ছি, আর তুমি ভাবছো যে, তারপরও এ ব্যাপারে তোমার নিজস্ব কোন বক্তব্য রয়েছে ৷ নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তোমার আর নিজস্ব কোন বক্তব্য থাকতে পারে না ৷” [আল মাজমু’ আল কাবির ৩৬২/১২]
৬)কাতাদাহ বর্ণনা করেন, “আমরা ইমরান ইবন হুসায়েন ও বুশায়ের ইবন কাব এ সাথে বসেছিলাম ৷ ইমরান বর্ণনা করেন যে, ‘শালীনতাবোধ হচেছ একটি পরিপূর্ণ গুণ’ অথবা তিনি বলছিলেন ‘শালীনতাবোধ পুরোটাই ভাল ৷’ এটা শুনে বুশায়ের ইবন কাব বলেন `আমরা নিদিষ্ট কিছু বইয়ে অথবা জ্ঞানের বইয়ে দেখতে পাই যে, এটা হচ্ছে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত মনের প্রশান্তি অথবা আল্লাহর খাতিরে ভদ্র আচরণ এবং এর কিছু দুর্বল দিকও রয়েছে ৷’ ইমরান এতই রাগান্বিত হলেন যে, তাঁর চক্ষু লাল হয়ে উঠল এবং তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসূলের (সা.) একটি হাদীস বর্ণনা করছি আর তুমি তার বিরোধিতা করছো ৷’ ” [সহীহ আল বুখারী ৫৭৬৬, সহীহ মুসলিম ৩৭]
আব্দুল হামিদ সিদ্দিকী তাঁর সহীহ মুসলিমের অনুবাদ ও ব্যাখায় এই হাদীসের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:”এই হাদীস একজন নবীর মর্যাদা ব্যাখ্যা করে ৷ নবীদের জ্ঞানের উৎস হচ্ছে ঐশ্বরিক ৷ আর তাই তা নিখুঁত এবং সকল প্রকার ত্রুটিমুক্ত। মানুষের প্রজ্ঞা মূলত পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও মতামতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে ৷ আর তাই তা কখনোই নির্ভুল হতে পারে না ৷ এ কারণেই মানবজাতিকে সবসময়ই নবীদের আদেশ মানার তাগিদ দেয়া হয়েছে – দার্শনিকদের নয় ৷ এ হাদীস স্পষ্টতই আমাদের হাদীসের মর্যাদা সম্বন্ধেও জ্ঞান দান করে ৷ এটা হচেছ ঐশ্বরিক জ্ঞানের অংশবিশেষ ৷ আর তাই ধর্মীয় অনুভূতি সহকারে এটাকে গ্রহণ করা উচিত৷”
এ হাদীসে বুশায়ের আরবদের কিছু প্রাচীন পুস্তকের কথা উল্লেখ করছিলেন যেগুলোতে তাদের ‘প্রজ্ঞা ’ লিপিবদ্ধ ছিল ৷ কিন্তু তা যখন সর্বজ্ঞানী আল্লাহ্‌ যা নাযিল করছেনে, তার বিরোধিতা করে তখন সেটাকে কি করে ‘প্রজ্ঞা ’ বলা যায় ? রাসূল (সা.) যখন বললেন যে, এর উল্টোটাই করা সত্যি তখন সেটাকে আর কি করে ‘প্রজ্ঞা’ বলে বিবেচনা করা যায়? নবী (সা.) যখন কোন বিষয়ে কথা বলেছেন তখন সেই বিষয়ে নবীর (সা.) বক্তব্য বিরোধী কোন বক্তব্যকে কেউ কিভাবে সম্মান দেখাতে পারে?[দুভার্গ্যজনকভাবে যে কেউ এমন অনেক মুসলিম খুঁজে পাবেন যারা এমন সব ধ্যান-ধারণা অনুসরণ করেন, যা বিশেষত স্বল্পোন্নত দেশের কারো কারো জন্য, ‘বিজ্ঞান সমৃদ্ধ পশ্চিম’ থেকে আসা যে কোন কিছুই তাদের নিজেদের ‘ঐতিহ্যবাহী প্রজ্ঞার’ চেয়ে উন্নততর বলে মনে হয় ৷ এটা হয়তো একধরণের হীনমন্যতা থেকে উদ্ভূত ৷ অথচ একজন মুসলিম যে কিনা কেবল আল্লাহর ইবাদত করে এবং তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, তার উচিত নয় এমন কেউ বা এমন কোন সভ্যতা যা কিনা আল্লাহর হেদায়েত বিবর্জিত – তার মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা ৷]
আসলে এধরণের আরো বহু উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানে কেউ নবীর একটি হাদীস অস্বীকার করাতে অথবা সে সম্বন্ধে কোন বিরূপ মন্তব্য করাতে তার সাথে কেউ কথা বলতে অস্বীকার করেছে ৷ সুন্নাহর স্বপক্ষে অবস্থান করতে গিয়ে এ ধরণের আচরণের কথা আমরা আব্দুল্লাহ ইবন মুগাফাল, ইবাদা ইবন আল সামতি, আবু আদ দারদা এবং আবু সাঈদ আল-খুদরীর মতো সাহাবীদের বর্ণনায় জানতে পারি ৷ পরবর্তী আলেমদের কাছ থেকেও একই ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ এসব দুর্ব্যবহার কেবল একভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়: নবীর (সা.) কোন বক্তব্য কোন মুসলিম বিরোধিতা করবেন অথবা প্রত্যাখ্যান করবেন – এটা অকল্পণীয় ৷ ওরকম ব্যবহারের কোন অবকাশ নেই, আর তাই পাপকার্যের জঘন্যতা অনুযায়ী তার প্রতিক্রিয়া সেরকম ছিল ৷
৭) সাঈদ বিন আল-মুসাইয়্যেব বর্ণণা করেন,আলী (রা.) ও উসমান (রা.) মক্কা ও মদীনার যাত্রাপথের মাঝখানে ছিলেন ৷ সময়টা ছিল এমন যখন উসমান (রা.) কোন নিদিষ্ট কারণবশত লোকজনকে তামাত্তু সম্পাদন থেকে বিরত রাখছিলেন (অর্থাৎ একই নিয়তে মাঝখানে একটি বিরতি দিয়ে, হজ্জ এবং ওমরাহকে একই যাত্রায় সম্পাদন করা)৷ আলী (রা.) নিয়ত করলেন : “আমরা মাঝখানে একটি বিরতি সহ হজ্জ এবং ওমরাহর জন্য আসছি ৷” উসমান (রা.) তাঁকে বললেন, “তুমি দেখছো যে, আমি লোকজনকে এটা করা থেকে বিরত রাখছি অথচ তুমি তাই করছো?” আলী (রা.) তাঁকে উত্তর দিলেন, “আমি মানবজাতির কারো বক্তব্যে আল্লাহর রাসূলের (সা.) সুন্নাহ পরিত্যাগ করতে পারি না ৷” [সহীহ মুসলি্‌ অধ্যায়ঃ হজ্জ্ব, হাদীস নং ২৮১৬] এই ঘটনা থেকে আবারও দেখা যায় যে, নবীর (সা.) সাহাবীরা আল্লাহ অথবা তাঁর রাসূলের (সা.) কর্তৃত্ব ছাড়া আর কারো কর্তৃত্ব মেনে নিতেন না ৷ এই ঘটনায় আলী (রা.) দেখছিলেন যে, উসমানের (রা.) ফিকহী যুক্তিতে ভুল ছিল ৷ কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে, উসমান (রা.) তামাত্তু সংক্রান্ত সুন্নাহকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেন নি ৷ এখানে মনে রাখা উচিত যে, এই ঘটনার সময় উসমান (রা.) ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা ছিলেন ৷ এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, সাহাবীরা জানতেন যে ইসলামের ভূমিতে সর্বোচচ কর্তৃত্বের অধিকা্রী ব্যাক্তিও, তা তিনি যতই পরহেজগার হন না কেন, তিনিও এমন কোন আইন চাপিয়ে দিতে পারি না যা নবীর (সা.) সুন্নাহর বিপক্ষে যায় ৷
সাহাবীদের সম্বন্ধে অনেক কয়টি বিশ্বস্ত সূত্রে আমাদের কাছে যে বর্ণনা এসেছে তাতে দেখা যায় যে, কোন সমস্যা দেখা দিলে তাঁরা প্রথমে আল্লাহর কিতাবে তার সমাধান খুঁজতেন ৷ সেখানে সমাধান না পেলে তখন তাঁরা নবী (সা.)-এঁর সুন্নাহয় তার সমাধান খুঁজতেন ৷ সেখানেও কোন সমাধান না পেলে তখন তাঁরা ব্যক্তিগত যুক্তির সাহায্য নিতেন ৷ এটি প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) এবং তাঁর উত্তরসূরী ওমর (রা.) – তাদের পন্থা এবং আসলে সকল সাহাবীদের পন্থাই ছিল এটা ৷

উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি:

ক) (দ্বীনের জ্ঞানের ব্যাপারে যাঁরা সর্বোত্তম ও সবচেয়ে জ্ঞানী ছিলেন সেই প্রজন্ম অর্থাৎ) সাহাবীদের মাঝে এই ব্যাপারে একটা ঐকমত্য ছিল যে, নবীর (সা.) সুন্নাহ অনুসরণ করাটা তাঁদের জন্য অবশ্য করণীয় ছিল ৷ এবং তাঁদের কেউই নিজেকে এই বাধ্যবাধকতার উর্দ্ধে বলে কখনও দাবী করেন নি ৷
খ) নবীর (সা.) মৃত্যুর পরে মুসলিমরা তখনও একমত ছিলেন যে, তাঁদের অবশ্যই নবীর (সা.) সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে ৷
গ) জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে – ইবাদত থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা – সব ক্ষেত্রেই নবীর (সা.) সুন্নাহকে প্রয়োগ করতে হবে এবং এমনকি রাষ্ট্রের যিনি প্রধান, তাঁরও নবীর (সা.) সুন্নাহর বিপরীতে শাসনকার্য পরিচালনা করার অধিকার নেই ৷

সুন্নাহ সম্পর্কে সাহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গী – ১

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-
                                              মূল লেখা: জামাল আদ-দ্বীন জারাবোজো
[সুন্নাহকে মুসলিম জীবনে বাতিল ও অগুরুত্বপূর্ণ প্রমান করা হচ্ছে ইসলামবিদ্বেষী সকল অবিশ্বাসী এবং ইসলামী বিশ্বের আধুনিকতাবাদী তথা প্রগতিশীলদের একটা অন্যতম লক্ষ্য! কারণটা খুব সাধারণ: সুন্নাহ্ না থাকলে, ইসলামেরই আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না এবং কুরআন ও ইসলামকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যাখা করার সুযোগ তৈরী হবে। আজ আমরা ইনশা’আল্লাহ্ দেখবো মুসলিম উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম সাহাবীরা (রা.) সুন্নাহকে কি চোখে দেখতেন! ]
আল্লাহর রাসূলের (সা.) পরেই যাঁরা কুর’আনের সত্যিকারের অর্থ সবচেয়ে ভাল বুঝতেন এবং একজন বিশ্বাসীর কি ধরণের আচরণ করা উচিত তা সবচেয়ে ভাল যাঁরা জানতেন, তাঁরা হচ্ছেন সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুম ৷ আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজেই তাঁর প্রজন্মকে সর্বশ্রেষ্ট প্রজন্ম বলে আখ্যায়িত করেছেন: “তোমাদের (আমার উম্মতের) মাঝে সর্বশ্রেষ্ট হচ্ছে আমার প্রজন্ম, তারপর হচ্ছে তার পরের প্রজন্ম, এবং তারপর হচ্ছে তার পরের প্রজন্ম ৷”[সহীহ বুখারীঃ ৬০৬৫; সহীহ মুসলিমঃ ২৫৩৩] ৷ বাস্তবিকই সাহাবীদের (রা.) মাধ্যমে আল্লাহ কুর’আনকে সংরক্ষিত করেছিলেন এবং তাদের মাধ্যমেই পরবর্তী প্রজন্মগুলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তারিত দিকগুলো সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। নীচে আমরা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও জ্ঞানী সাহাবীদের কয়েকজনের মতামত এবং রাসূল (সা.)-এঁর সুন্নাহ সম্বন্ধে তাঁদের অবস্থান তুলে দিলাম ৷
সুন্নাহ সম্বন্ধে সাহাবীদের কিছু বক্তব্য উল্লেখ করার আগে, তাঁদের আচরণের একটা ব্যাপার সস্পর্কে উল্লেখ করার প্রয়োজন রয়েছে; তাঁরা হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ট ঐ প্রজন্ম যাঁরা নবী (সা.)-কে তাৎক্ষিণকভাবে অনুসরণ করেছেন – কোন একটা নির্দিষ্ট কর্ম রাসূল (সা.) কেন সম্পাদন করলেন, সে সম্বন্ধে কোন সংশয় বা প্রশ্ন উত্থাপন করা ছাড়াই ৷ উদাহরণস্বরূপ বুখারীর বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এঁর সূত্রে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি সোনার আংটি পরতেন, আর তাই লোকেরাও সোনার আংটি পরতে শুরু করলো ৷ তারপর নবী (সা.) আংটিটি পরিত্যাগ করলেন এবং বললেন, “আমি আর কখনো এটা পরবো না ৷” লোকেরাও সাথে সাথে তাদের সোনার আংটিগুলি পরিত্যাগ করলো ৷ [সহীহ বুখারী; অধ্যায়ঃ৭২/পোষাক-পরিচ্ছদ; হাদীস নংঃ ৭৫৬]
আরেকটি উপলক্ষে নবী (সা.) সালাত আদায় করছিলেন এবং সালাতের মাঝে তিনি তাঁর জুতা খুলে ফেললেন ৷ সাহাবীরা (রা.) যখন তাঁকে ঐরকম করতে দেখলেন, তখন তাঁরা নিজেরাও তা অনুসরণ করলেন ৷ পরবর্তীতে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন যে, তাঁরা কেন তাদের জুতা খুলে ফেলে দিলেন ৷ তাঁরা বললেন, “কেননা আমরা আপনাকে আপনার জুতো খুলে ফেলতে দেখেছি ৷” তিনি তাঁদের ব্যাখ্যা করলেন, “জিবরাইল (আ.) আমাকে জানিয়েছিলেন যে, আমার জুতোয় কিছু ময়লা লেগেছিল ৷”[আবু-দাঊদঃ ৬৫০, শাইখ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]
সাহাবীদের এই আচরণ এবং এর বাস্তবতা এই যে, তাঁদের এহেন আচরণের জন্য আল্লাহ এবং রাসূল (সা.) কখনোই তাদের তিরস্কার করেননি অথবা ভুল শুধরে দেননি – এটা হচ্ছে সুন্নাহ মর্যাদার ব্যাপারে আরেকটি প্রমাণ ৷ এ ধরনের ব্যাপার: ‘আল্লাহর নীরব অনুমোদন’ – এই শ্রেণীভূক্ত হবে ৷ এটা অকল্পণীয় যে তাঁরা যদি ভুল করে থাকতেন, তাহলে আল্লাহ তাঁর তরফ থেকে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত ছাড়া তাঁদের সে আচরণ অব্যাহত ভাবে চালিয়ে যেতে দেবেন ৷
আল্লাহর রাসূলের জীবিত অবস্থায় তাঁদের উপরোক্ত ধরনের কর্মকান্ড ছাড়াও সাহাবীরা সুন্নাহর মর্যাদা ও কর্তৃত্ব সম্বন্ধে পরবর্তীতে তাঁদের বিশ্বাস ব্যক্ত করে বক্তব্য প্রদান করে গেছেন এমন বহু উদ্ধৃতির মাঝে নীচের উদ্ধৃতিগুলোও রয়েছে:
১)সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বলেন, “যারা উল্কি আঁকে, যারা উল্কি আঁকাতে চায়, যারা ভ্রু তুলে সরু করে এবং যারা আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন ঘটাতে দাঁত ফাঁক করে তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ ৷” একথা উম্ম ইয়াকুবের কাছে পৌঁছালে তিনি তাঁর কাছে আসেন এবং বলেন, “আমি শুনেছি আপনি এমন এমন কথা বলেছেন ৷” তিনি তাঁকে বললেন, “আল্লাহর রাসূল (সা.) যেটাকে অভিশাপ দিয়েছেন এবং যা আল্লাহর কিতাবে পাওয়া যায় সেরকম ব্যাপারে যদি আমি অভিশাপ দিই তাহলে আমার দোষ কোথায়” মহিলা তাঁকে বললেন ,”আমি (আল্লাহর কিতাব) শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি, কিন্তু কোথাও (আপনি যা বলেছেন) তা পাইনি ৷” আব্দুল্লাহ্‌ (রা.) তাঁকে বললেন,”আপনি পড়ে থাকলে তো আপনার পাবার কথা ৷ আপনি কি পড়েন নি আল্লাহর রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করে তা থেকে দূরে থাকো’? (সূরা হাশর,৫৯;৭) মহিলা বললেন, “হ্যাঁ” তিনি বললেন, “তিনি [আল্লাহর রাসূল (সা.)] এসব জিনিস নিষেধ করেছেন ৷ ”[সহীহ বুখারীঃ ৪৬০৪; সহীহ মুসলিমঃ ২১২৫]
এই ঘটনায় একজন সাহাবী নবীর (সা.) প্রদত্ত বিধিনিষেধকে আল্লাহর বিধিনিষেধ বলে উল্লেখ করেছেন। ঐ ভদ্রমহিলা, অর্থাৎ, উম্ম ইয়াকুব, আব্দুল্লাহ্‌কে (রা.) ভুল বুঝেছিলেন, এবং ভেবেছিলেন যে, তিনি এমন কোন সুনিদিষ্ট আয়াতের কথা বলেছেন যেখানে ঐ কাজগুলির কথা নিদিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা রয়েছে ৷ আব্দুল্লাহ (রা.) তাঁর ব্যাখ্যায় দেখান যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা আসলে আল্লাহ যা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছেন তার মতই গুরুত্বপূর্ণ ৷ এ ব্যাপারে তাঁর প্রমাণ ছিল সূরা হাশরের সাত নম্বর আয়াত ৷
২)সাঈদ ইবন আল-মুসাইয়্যেব থেকে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে যে, উমর (রা.) বলেন, “একজন বিধবা তার স্বামী হত্যার বিপরীতে প্রাপ্ত রক্তপণ থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে কিছুই পাবে না ৷” আদ-দুহাক ইবন সুফিয়ান, উমর (রা.) কে বলেন যে, “রাসূল(সা.) একবার তাঁকে লিখেছিলেন যে, আস-শিয়াম আল-যাহাবীর স্ত্রীকে যেন তার স্বামীর রক্তপণের একটা অংশ উত্তরাধিকার হিসাবে দেওয়া হয় ৷” উমর (রা.) তারপর তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন ৷ এবং রক্তপণের একটা অংশ বিধবাকে দান করেন ৷[সুনানে আবু-দাঊদ; খন্ড ১২, হাদীস নং ২৯২১] এই ঘটনা থেকে উমর আল-খাত্তাব (রা.) সুন্নাহর প্রতি কেমন মনোভাব পোষণ করতেন, তা বোঝা যায় – যিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন এবং দ্বীনের জ্ঞান ও সঠিক ধারণার জন্য যাঁর সুখ্যাতি ছিল ৷ না জেনে তিনি এমন একটা অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, যেটা রাসূল (সা.)-এঁর সিদ্ধান্তের বিপরীত ৷ কিন্তু যখনি তিনি বুঝলেন যে, তাঁর সিদ্ধান্ত সুন্নাহর বিপরীতে চলে যাচ্ছে, তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর মতামত পরিত্যাগ করলেন এবং আল্লাহ্‌র রাসূলের (সা.) সিদ্ধান্তের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে সমপর্ণ করলেন ৷
আরেকটি ঘটনায় যেখানে উমর (রা.) সম্পৃক্ত ছিলেন, একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কেননা একজন সাহাবী একটা সদৃশ ঘটনার ব্যাপারে নবী (সা.)-এঁর একটা হাদীস বর্ণনা করেছিলেন ৷ তারপর উমর (রা.) বলেছিলেন , “আমরা যদি এই হাদীস না শুনতাম, তবে আমরা একটা ভিন্ন সিদ্ধান্ত দিতাম ৷ আমরা আমাদের মতামত অনুযায়ী বিচার করতাম ৷ এখানেও ইমাম শাফি’ঈ যেমন মন্তব্য করেন – উমরের (রা.) সিদ্ধান্ত নবীর (সা.) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হতো না ৷ কিন্তু যখন তাঁকে নবীর (সা.) সিদ্ধান্ত জানানো হলো, উমর (রা.) জানলেন যে, এ ব্যাপারে তাঁর আর কিছুই বলার রইলো না এবং উপরন্তু তিনি জানাতেন যে, একজন বিশ্বাসীকে অবশ্যই নবীর (সা.) সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে, এমনকি তা যদি তাঁর নিজের মতের বিপক্ষেও যায় ৷ 
সহীহ বুখারী ও মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় একটি ঘটনার কথা উল্লিখিত হয়েছে, যেখানে উমর (রা.) আল-শামে (বৃহত্তর সিরিয়া) যাবার জন্য মনস্থির করেছিলেন, সেখানে তখন একটা মহামারির প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ৷ এমতাবস্থায় তাঁর সাথে আব্দুর রহমান ইবন আউফ (রা.)-এঁর দেখা হলো, তখন আব্দুর রহমান (রা.) তাঁকে বললেন যে, নবী (সা.) বলেছেন, “যদি তোমরা শোন যে, কোন নিদিষ্ট স্থানে মহামারী দেখা দিয়েছে তবে, সে স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করো না; এবং তুমি যদি সেই স্থানে আগে থেকেই অবস্থান করে থাকো, তবে সেই স্থান ত্যাগ করে বাইরে যেও না ৷”[সহীহ বুখারীঃ ৫৭৩৯; সহীহ মুসলিমঃ ২২১৯] এটা শুনে উমর (রা.) বুঝলেন যে, তাঁর জন্য আল-শামের দিকে যাওয়াটা সঠিক হবে না, তাই তিনি মদীনায় ফিরে এলেন ৷
বুখারীতে লিপিবদ্ধ আরেকটি ঘটনায় দেখা যায় যে, ওমর (রা.) মাজুসিদের কাছ থেকে জিযিয়া কর সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকেন যতক্ষণ না আব্দুর রহমান ইবন আউফ (রা.) সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নবী (সা.) তাঁদের কাছ থেকে ঐ কর সংগ্রহ করেছিলেন ৷ [সহীহ বুখারীঃ ৩১৫৭] এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, এমনকি রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নবীর(সা.) আদেশ ও সুন্নাহর কাছে সমর্পিত ৷ মাজুসীদের কাছ থেকে জিযিয়া কর গ্রহণ করার ব্যাপারে সংশয় থাকার দরুণ [যতক্ষণ না তিনি এ ব্যাপারে নবীর(সা.) উদাহরণ সম্পর্কে জানতে পারেন, ততক্ষণ], উমর (রা.) বর্ধিষ্ণু ইসলামী রাষ্ট্রের বাজেটের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছিলেন ৷
৩)আল- বাইহাকী ও আল-হাকিম কর্তৃক লিপিবদ্ধ সহীহ সনদে দেখা যায় যে, তাউস আসরের ফরজ সালাতের পরে ২ রাকাত নফল সালাত পড়ছিলেন ৷ ইবন আব্বাস (রা.) তাঁকে তা থেকে বিরত থাকতে বললেন ৷ তিনি উত্তর দিলেন যে, তিনি তা ত্যাগ করবেন না ৷ ইবন আব্বাস (রা.) তখন তাঁকে বললেন, আল্লাহ্‌র রাসূল (সা.) আসরের সালাতের পরে সালাত নিষিদ্ধ করেছেন [মাগরেবের আগ পর্যন্ত] সুতরাং, আমি জানিনা (তুমি যে সালাত আদায় করেছো তার জন্য) তুমি শাস্তি পাবে না পুরষ্কৃত হবে ৷ [বাইহাকী ৪৪০৪]নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বলেছেন:“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে আদেশ দিলে, কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন কোন সিদ্ধান্ত্তের অধিকার থাকবে না ৷ কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে ৷”(সূরা আল-আহাযাব,৩৩:৩৬)
এই ঘটনা থেকে যে কেউ নবীর আদেশের গুরুত্বটা সহজেই বুঝতে পারবেন ৷ ইবাদতের মত একটা সৎকর্মের বেলায়ও যে কারো মনে রাখতে হবে যে, সে সম্বন্ধে নবী (সা.) প্রদত্ত নিয়ম-নীতি কী ৷ ইবন আব্বাস (রা.) তাউস-কে বললেন , “আমি জানি না তুমি পুরষ্কৃত হবে না শাস্তি লাভ করবে” – তাউস যে অতিরিক্ত সালাত আদায় করার জন্য শাস্তি লাভ করবেন তা কিভাবে হয়? তা এজন্যই যে, তিনি আসলে নবীর আদেশ অমান্য করছিলেন! এ থেকে বোঝা যায়, সকল সৎকর্ম – তা যতই উন্নতমানের হোক না কেন – গ্রহণযোগ্য হবার জন্য সেগুলোকে অবশ্যই কুর’আন ও সুন্নাহ দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে ৷

Wednesday, November 28, 2018

কীভাবে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসব?

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-
লিখেছেনঃ মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
প্রচারেঃজাহিদ হাসান নিলয়
মুমিন মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বত পোষণ করে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বত রাখা ঈমানের এক অপরিহার্য অংশ। পরম শ্রদ্ধা, গভীর ভালোবাসা আর বিপুল মমতার এক চমৎকার সংমিশ্রণের সমন্বিত রূপ হচ্ছে ‘মহব্বত’ নামের এ আরবী অভিব্যক্তিটি।
ঈমানের আলোকে আলোকিত প্রত্যেক মুমিনের হৃদয় আলোড়িত হয়, শিহরিত হয়, মনে আনন্দের বীনা বাজতে থাকে যখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উচ্চারিত হয়, তাঁর জীবন-চরিত আলোচিত হয় কিংবা তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী পাঠ করা হয়। সত্যের দীক্ষায় দীক্ষিত হৃদয় তাঁর আদর্শের শ্রেষ্ঠতায় ও সৌন্দর্যে মোহিত হয়, উম্মতের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসায় আপ্লুত হয়। তাঁর একনিষ্ঠ দিক নির্দেশনায় পথ খুঁজে পায় পথহারা বিভ্রান্ত মানব সন্তানেরা, আর দুর্বল চিত্তের লোকেরা ফিরে পায় মনোবল। মানবতার কল্যাণকামীরূপেই আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন এ বিপর্যস্ত ধরাধামে। সত্যিই তিনি তাঁর যুগের যমীনকে মুক্ত করেছেন অশান্তির দাবানল হতে, উদ্ধার করেছেন অজ্ঞানতা ও মুর্খতার নিকষ অন্ধকার হতে। তাইতো জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে বরণ করে নিয়েছে মানবতার বন্ধুরূপে।
সত্যের এহেন প্রতিষ্ঠাতা, চারিত্রিক মাধূর্য ও ব্যবহারিক সৌন্দর্যের এমন রূপকারের প্রতি একটু বেশী পরিমাণে ভালোবাসা পোষণ করা এবং তাঁর প্রতি পাহাড়সম প্রগাঢ় শ্রদ্ধা রাখা মুমিন জীবনে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ইসলামী শরী‘আত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বত পোষণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য বলে আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘‘বল, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দ হওয়ার আশংকা তোমরা করছ, এবং সে বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তার পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত।’’ [আত-তাওবাহ: ২৪] যাদের কাছে আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাধিক প্রিয় নয়, তাদেরকে আল্লাহ এ আয়াতটিতে ভীষণ আযাবের হুমকি দিয়েছেন। ওয়াজিব ও অপরিহার্য কাজ বর্জন না করলে এ ধরনের হুমকি দেয়া হয় না। ইমাম বুখারী রাহেমাহুল্লাহ আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে তার সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘শপথ ঐ সত্ত্বার যার হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের কেউই ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা ও সন্তান হতে অধিকতর প্রিয় হব।’’ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমাদের কেউই ঈমানদার হবে না যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা, সন্তান ও সকল মানুষ হতে প্রিয়তম না হই।’’ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং১৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭৮] উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণ না করলে ঈমানদার বলে কেউ বিবেচিত হবে না। অতএব ঈমানের অনিবার্য দাবী হল- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসা।
তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা পোষণে আমাদের সমাজের সকল মুসলিম ভাই ও বোনেরা ব্যালেন্স রক্ষা করতে পারেন না। দেখা যায় যে, একদল লোক তাঁর মহব্বতে পাগলপারা হয়ে তাকে অতিমানবীয় পর্যায়ে উন্নীত করে এবং তাঁকে আল্লাহর বহু গুণাবলীতে শরীক করে। যেমন তিনি গায়েব জানেন, মৃত্যুর পরও মানুষের ভাল-মন্দ করতে পারেন, মানুষের জন্য দো‘আ করেন ও দো‘আ কবুল করতে পারেন, তিনি এখনই আমাদের শাফা‘আত কবুল করতে পারেন ইত্যাদি আরো নানাবিধ ভ্রান্তিপূর্ণ আকীদা পোষণ। আরেকদিকে অন্যদল তাকে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে ফেলে অন্য মানুষের মতই তাকে ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয় বলে বিশ্বাস করে। এদের কেউ কেউ তাঁর মুখনিঃসৃত কোন কোন হাদীস ও আমলকে অস্বীকার করে। ফলে তাঁকে অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা এ প্রকার লোকেরা অনুভব করে না। এ উভয় শ্রেণীর লোকেরা প্রকৃতপক্ষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্যিকার ভাবে মহব্বত করা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে। কারণ তারা এমন সব কাজ করছে যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তাদের মহব্বতের দাবীর অসারতা প্রমাণ করছে। এসব কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

১. প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ থেকে দূরে সরে থাকা:

সুন্নাহ থেকে অপ্রকাশ্যে দূরে থাকার উদাহরণ হল:যেমন মৌলিক ইবাদতসমূহকে আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব প্রথা মনে করা এবং আল্লাহর কাছে সাওয়াবের আশা না করেই এগুলো পালন করা, অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করা ও তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন থেকে বিরত থাকা, তাঁর প্রতি হৃদয়ে মহব্বত পোষণ না করা, সুন্নাহ ভুলে যাওয়া ও তা না শেখা এবং এর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করা।
আর প্রকাশ্যে সুন্নাহ থেকে দূরে সরে থাকার উদাহরণ হল: ওয়াজিব ও মুস্তাহাব পর্যায়ের দৃশ্যমান সুন্নতী আমল ত্যাগ করা, যেমন ‘‘রাতেব’’ তথা সুন্নাতে মোয়াক্কাদা নামের সালাতসমূহ, বিতর এর সালাত, খাওয়া ও পরার সুন্নাতসহ, হজ্জ ও সিয়ামের নানাবিধ সুন্নাত পরিত্যাগ করা। এমন কি কেউ কেউ এগুলোকে নিতান্ত ফুজুলী বা অতিরিক্ত কাজ বলে মনে করে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত একটি  হাদীসে বলেন, ‘‘অতঃপর যারা আমার সুন্নাত থেকে বিরাগভাজন হয়, তারা আমার দলভুক্ত নয়।’’[সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০৬৩ , সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৪৬৯]

২. বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ প্রত্যাখ্যান করাঃ

যুক্তির বিচারে উত্তীর্ণ নয় কিংবা বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় অথবা এ হাদীস অনুযায়ী বর্তমানে আমল করা সম্ভব নয় ইত্যাদি নানা যুক্তিতে সহীহ ও বিশুদ্ধ হাদীস অস্বীকার করা কিংবা সেগুলোকে তার প্রকৃত অর্থ থেকে অপব্যাখ্যা করে মনগড়া অর্থে প্রণয়ন করা। অনেকে একজন রাবীর বর্ণনা হওয়ার কারণেও খবরে আহাদকে অস্বীকার করে। কেউ কেউ আবার শুধুমাত্র কুরআন দ্বারা আমালের অজুহাত দেখিয়ে সুন্নাহকে অস্বীকার করে। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘‘রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও।’’[সূরা আল হাশরঃ ৭]

৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত অনুসরণ থেকে সরে আসাঃ

প্রগতি ও উন্নতির প্রভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত ও আদর্শ অনুসরণ হতে সরে এসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতি ঝুঁকে পড়তে দেখা যায় অনেককে। এর চেয়ে মারাত্মক হল- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা ও কাজের সাথে অন্যদের কথা-কাজ তুলনা করে সাধারণের উদ্দেশ্যে পেশ করা। এতে সাধারণ মানুষ রাসূলের প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা ও কাজ ইসলামী শরী‘আতেরই অংশ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘‘এতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি প্রেরণ করা হয়।’’ [আন নাজমঃ ৪]
৪. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আলোচনার সময় মনসংযোগ না করা এবং আগ্রহের সাথে শ্রবণ না করা অথচ আল্লাহ বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তার সাথে সেকরকম উচ্চস্বরে কথা বলো না।’’ [সূরা হুজুরাতঃ ২]
৫. সুন্নার যারা প্রকৃত অনুসারী তাদেরকে ত্যাগ করাতাদের গীবিত করা ও তাদেরকে উপহাস করা।
৬. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বৈশিষ্ট্য ও তার মুজিযাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞান না রাখা।
৭. দ্বীনের মধ্যে নানা প্রকার বিদআত চাল করা।
দেখা যায়, অনেক লোক ইবাদাতের নামে নানাবিধ বিদ‘আত চালু করেছে আমাদের সমাজে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদ‘আত থেকে উম্মতকে সাবধান করেছেন। এদেরকে যখন বিদ‘আত ছেড়ে দেয়ার আহবান জানানো হয়, তখন তারা বিদ‘আতকে আরো শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে।
৮. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পর্কে বাড়াবাড়িঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বাড়াবাড়ির অর্থ হচ্ছে তাঁকে নবুওয়াত ও রিসালাতের উর্ধ্বে স্থান দেয়া এবং অনেকক্ষেত্রে আল্লাহর গুণাবলীতে তাঁকে শরীক করা ও তাঁর কাছে দো‘আ করা, শাফা‘আত চাওয়া ইত্যাদি। অথচ সহীহ বুখারীর বর্ণনায় তিনি স্বয়ং বলেন, ‘‘তোমরা আমার সম্পর্কে অতিরঞ্জন করো না, যেমন নাসারাগণ অতিরঞ্জন করেছে ইবনু মারইয়াম সম্পর্কে। আমি তো শুধূ আল্লাহর বান্দা। বরং তোমরা বলো – (আমি) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’’ সুনান আবি দাউদে একটি হাদীসে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমরা আমার কবরকে উৎসবস্থলে পরিণত করো না, আর আমার উপর সালাত পড়। কেননা তোমরা যেখানেই থাক তোমাদের সালাত আমার কাছে পৌঁছে।’’ [সহীহ সুনান আবি দাউদ, হাদীস নং ২০৪২] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় তিনি আরো বলেন, ‘‘আল্লাহ লানত করুন ইহুদী ও নাসারাদেরকে, তারা তাদের নবীদের কবরকে মাসজিদরূপে গ্রহণ করেছে।’’ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩৩০, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১২]

৯. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সালাত ও দরূদ পাঠ না করাঃ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দরূদ পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। অথচ তার নাম উচ্চারণ করে অথবা শুনে অনেকেই দরূদ ও সালাম পাঠ করে না। তিরমিযীর একটি বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘ঐ ব্যক্তির নাক ধুলি ধুসরিত হোক যার কাছে আমার উলেস্নখ করা হয় কিন্তু সে আমার উপর সালাত পাঠ করেনি।’’ তিরমিযী অন্য আরেকটি বর্ণনায় তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘কৃপণ ঐ ব্যক্তি, যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হয় অথচ সে আমার উপর সালাত পাঠ করেনি।’’
উপরোক্ত বিষয়ের সবগুলোই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহব্বতের পরিপন্থি। সুতরাং আজ যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার শরয়ী দায়িত্ব পালন করে নিজেদের ঈমানের যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়, তাদের উচিত উপরোক্ত দল দু’টির চিন্তা-চেতনা ও কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে আসা এবং শরী‘আত তাঁর জন্য ভালোবাসার যে উপায়, উপকরণ ও উপাদান নির্ধারণ করেছে তা সত্যিকারভাবে অনুসরণ করা। ‘তাঁকে ভালবাসি’ – মুখে এ দাবী করে জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাঁকে ও তাঁর আদর্শকে উপেক্ষা করা যেমন ভালোবাসার দাবীকে অসার প্রমাণিত করে, তেমনি অতিরিক্ত ভালোবাসা প্রদর্শন করতে গিয়ে তাঁকে স্রষ্টার সমপর্যায়ে উন্নীত করাও অত্যন্ত গর্হিত ও শরী‘আতের দৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যাত।

ইসলামী শরীআত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেভাবে ভালোবাসার নির্দেশনা আমাদেরকে দিয়েছে নিম্নে আমরা সে বিষয়টি তুলে ধরছিঃ

১. সকল মানবের উপর রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দেয়াঃ আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টির আদি ও অন্তের সকলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। অতএব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সর্বশেষ নবী, নবীদের নেতা ও সর্দার। সহীহ মুসলিমের একটি বর্ণনায় এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ ইসমাঈলের সন্তান থেকে কিনানাকে চয়ন করেছেন এবং কিনানা থেকে কুরাইশকে নির্বাচন করেচেন। আর কুরাইশ থেকে চয়ন করেছেন বনু হাশিমকে এবং আমাকে চয়ন করেছেন বনু হাশিম থেকে।’’[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬০৭৭] সহীহ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘আমি আদম সন্তানের নেতা এবং এতে কোন অহংকার নেই। আর আমি ঐ ব্যক্তি প্রথম যার কবর বিদীর্ণ হবে, প্রথম যিনি শাফা‘আতকারী হবে এবং প্রথম যার শাফা‘আত কবুল করা হবে।’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠত্বের আকীদা, মনে-মগজে ধারণ করার অর্থই হল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্ভ্রম পোষণ করা এবং তাকে যাবতীয় সম্মান ও মর্যাদা দেয়া।
২. সকল ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আদব ও শিষ্টাচার রক্ষা করাঃ নিম্ন বর্ণিত রূপে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে শিষ্টাচার রক্ষা করা যায়।
. উপযুক্ত বাক্য দ্বারা তার প্রশংসা করা। এক্ষেত্রে আল্লাহ রাববুল আলামীন যেভাবে তার প্রশংসা করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং তাঁর নিজ সম্পর্কে বলার জন্য যা শিখিয়ে দিয়েছেন, তাই হলো তাঁর প্রশংসা করার জন্য সর্বোত্তম অভিব্যক্তি। সালাত ও সালাম পেশের মাধ্যমে এ কাজটি অতি উত্তমভাবে আদায় হয়। আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ নবীর উপর সালাত পেশ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তার উপর সালাত ও সালাম পেশ কর।’’ [সূরা আহযাবঃ ৫৬] সালাত ও সালাম রাসূলের স্তুতি বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম বলেই তাশাহুদ, খুতবা, সালাতুল জানাযা, আযানের পর ও যে কোন দো‘আর সময়সহ আরো বহু ইবাদাতে তা পেশ করার নিয়ম করে দেয়া হয়েছে; বরং তার উপর সালাত ও সালাম পেশ আলাদাভাবেই একটি ইবাদাত হিসেবে স্বীকৃত।
খ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা, ফযীলত, বৈশিষ্ট্য, মু‘জিয়া ও সুন্নাহ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তাঁকে বেশী বেশী স্মরণ করা। মানুষকে তাঁর সুন্নাহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা, তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও উম্মতের উপর তাঁর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, তাঁর সীরাতকে সদাপাঠ্য বিষয় বস্তুতে পরিণত করা। এর মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সদা জাগরুক থাকবে।
গ. শুধু ‘মুহাম্মদ’ নামে তাকে উল্লেখ না করা, বরং এর সাথে ‘নবী’ বা ‘রাসূল’ সংযোজন করে সালাত ও সালাম পাঠ করা। আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা একে অপরকে যেভাবে ডাক, রাসূলকে তোমাদের মধ্যে সেভাবে আহবান করো না।’’ [সূরা নূরঃ ৬৩]
. মসজিদে নববীতে কেউ এলে এ মসজিদের আদব রক্ষা করা, বিশেষ করে তাঁর কবরের পাশে এসে স্বর উচ্চ না করা। উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু একদল লোককে এজন্য খুব সতর্ক করেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর শহর মদীনা মুনাওয়ারার সম্মান রক্ষা করাও অপরিহার্য।
. তাঁর হাদীসের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন, হাদীস শোনার সময় ধৈর্য ও আদবের পরিচয় দেয়া, হাদীস শেখার প্রতি অনুপ্রাণিত হওয়া। এক্ষেত্রে এ উম্মতের প্রথম প্রজন্মসমূহের আদর্শ অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়।
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সব বিষয়ে সংবাদ দিয়েছেন তা সত্য বলে প্রতিপন্ন করাঃ এসব বিষয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল- ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ, দ্বীনের মৌল স্তম্ভসমূহ, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে তাঁর দেয়া যাবতীয় সংবাদ ইত্যাদি। তাঁর সত্যতা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘‘শপথ তারকার, যখন তা অস্ত যায়। তোমাদের সাথী (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  ভ্রষ্ট হননি  এবং বিভ্রান্তও হননি। তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোন বক্তব্য প্রদান করেননি। এতো শুধুই ওহী, যা তাঁর কাছে প্রেরিত হয়।’’ (সূরা নাজমঃ ১-৪)
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেয়া সংবাদকে অসত্য বলা ও একে কোন অপবাদ দেয়া হল সম্পূর্ণ কুফুরী ও মারাত্মক অশিষ্টতা, যার কোন ক্ষমা আল্লাহর কাছে নেই। আল্লাহ বলেন, ‘‘আর এ কুরআন তো আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো থেকে রচিত নয়, বরং এ হচ্ছে তার পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যতা প্রতিপাদনকারী এবং সে গ্রন্থের বিশদ বিবরণ যা রাববুল আলামীনের পক্ষ থেকে সন্দেহাতীতভাবে অবতীর্ণ। তারা কি বলে যে, সে তা রচনা করেছে? বল, তাহলে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে এস এবং তোমাদের সাধ্যানুযায়ী আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। বরং যে জ্ঞান তাদের আয়ত্বে নেই সে সম্পর্কে তারা মিথ্যাচার করছে….।’’(সূরা ইউনুসঃ ৩৭-৩৯)
ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে শিষ্টাচারিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল- তাঁর সবকিছু পরিপূর্ণভাবে মেনে নেয়া ও তাঁর নির্দেশের আনুগত্য করা, তাঁর দেয়া সব সংবাদ সত্য বলে মেনে নেয়া এবং খেয়ালের বশবর্তী হয়ে যুক্তির খাতিরে তা প্রত্যাখ্যান না করা কিংবা কোন সংশয়ের কারণে তাতে সন্দেহ প্রকাশ না করা অথবা অন্য লোকদের মতামত ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্যাসকে তাঁর উপর প্রাধান্য না দেয়া।’ [মাদারিজুস সালেকীন ২/৩৮৭]
৪. তাঁর ইত্তেবা করাআনুগত্য পোষণ ও তাঁর হিদায়াতের আলোকে পরিচালিত হওয়াঃ এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘নিশ্চয় রাসূলুল্লাহর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ, বিশেষ করে ঐ ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা পোষণ করে এবং আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করে।’’ [সূরা আহযাবঃ ২১] ইমাম ইবনু কাসীর বলেন, ‘‘সকল কথা, কাজ ও অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণের ক্ষেত্রে এ আয়াতটি একটি মৌলিক দলীল।’’ [তাফসীরুল কুরআনিল আযীম: ৩/৪৭৫]
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল আমি তো তোমাকে তাদের হেফাযতকারী রূপে প্রেরণ করিনি।’’ [সূরা নিসাঃ ৮০]  ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুসরণ কর আল্লাহর এবং অনুসরণ কর রাসূলের; আর তোমাদের মধ্যে যারা উলুল আমর তাদের। আর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিতণ্ডায় লিপ্ত হও, তাহলে আল্লাহ ও রাসূলের (সমাধানের) দিকে ফিরে আস, যদি তোমরা ঈমান পোষণ করে থাক আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি। এটাই পরিণামের দিক দিয়ে সর্বোত্তম ও সুন্দরতম।’’[সূরা নিসাঃ ৫৯] এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই অসংখ্য হাদীসে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছেন।
৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের বিধান দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়াঃ এ বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার অন্যতম একটি মানদন্ড। এর বাস্তবায়ন না হলে ভালোবাসা তো নয়ই বরং ঈমানের দাবীও কেউ করতে পারে না। সেটিই আল্লাহ বলেছেন এভাবে, ‘‘তোমার রবের শপথ! কক্ষণও নয়, তারা ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না তারা তোমাকে নিজেদের মধ্যকার বাদানুবাদের ক্ষেত্রে হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নেয়, অতঃপর তুমি যে মিমাংসা করে দাও তাতে তাদের মনে কোন দ্বিধা তারা রাখে না এবং পরিপূর্ণভাবে মেনে নেয়।’’ [সূরা নিসাঃ ৬৫]
ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘‘যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত থেকে বের হয়ে যায়, আল্লাহ নিজে তাঁর পবিত্র সত্ত্বার কসম করে বলেছেন যে, তারা ঈমানদার নয়।’’ [মাজমু আল ফাতাওয়া ২৮/৪৭১]
৬. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে অবস্থান নেয়াঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মহব্বত করার একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ও বড় উপায় হচ্ছে তাঁর পক্ষে অবস্থান নেয়া ও তাঁকে সাহায্য করা। আল্লাহ বলেন, ‘‘যে সকল দরিদ্র মুহাজিরকে তার বাসস্থান ও সম্পত্তি হতে বহিষ্কৃত করা হয়েছে, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে, তারাই হল সত্যবাদী।’’ [সূরা হাশরঃ ৮]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে অবস্থান নেয়া ও তাঁকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে চমৎকার ও সত্যিকার সব উদাহরণ পেশ করেছেন তাঁরই প্রিয় সাহাবাগণ। আজকের প্রেক্ষাপটে যেখানে বিভিন্ন দেশের অমুসলিমগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্নক কথা বলছে, সেখানে আমাদের উচিত তার প্রতিবাদ করা এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে অবস্থান নেয়া। অতএব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশের সারবত্তা তুলে ধরা ও মানুষকে তা মেনে নেয়ার আহবান জানানোই হল মূলত আজকের প্রেক্ষাপটে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাহায্য করার অর্থ।
৭. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মহব্বত করার আরেকটি উপায় হল তাঁর প্রিয় সাহাবাদেরকে ভালোবাসা ও তাদের পক্ষে অবস্থান নেয়াতাদেরকে আমাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ ও তাদের সুন্নাতের অনুসরণ করা। আল কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সাহাবাদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন এবং তাদের গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন ও তাদের প্রতি তিনি যে সন্তুষ্ট সে ঘোষণাও দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সাহাবাগণের প্রতি ভালোবাসা পোষণের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা আরো পাকাপোক্ত হয়।
৮. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের প্রচার ও প্রসার করা তাঁর প্রতি ভালোবাসা পোষণের অন্যতম একটি উপায়। নিজের জীবনে সুন্নাতকে বাস্তবায়ন না করে এবং সুন্নাতের প্রচার প্রসারের জন্য কোনরূপ চেষ্টা না করে শুধু মৌখিকভাবে তাঁকে ভালোবাসার দাবী করলেই তাঁর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা হয় না- বিষয়টি সবার কাছেই স্পষ্ট। আজ আমাদের সমাজে যেখানে সুন্নাত ও বিদ‘আতের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটেছে, অথবা যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত সুন্নাত থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, কিংবা তথাকথিত কতিপয় আধুনিক শিক্ষিতরা সুন্নাতের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করছে, সেখানে সত্যিকার সুন্নাতের বিপুল প্রচার ও প্রসার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসার দাবীদারদের উপর এক অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিশেষে এ কথা বলে শেষ করবো যে, আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে জানা, বোঝা ও আমল করার মাধ্যমে আমাদের প্রিয় নেতা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রকৃত অর্থেই ভালোবাসার তাওফীক  দিয়ে আমাদের ঈমানকে পরিপূর্ণ করে দেন। আমীন।

গল্প থেকে শিক্ষা: শিকারি ও বুদ্ধিমান পাখি

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
প্রচারেঃজাহিদ হাসান নিলয়

শিকারি ও বুদ্ধিমান পাখি

একবার এক শিকারি ছোট্ট একটি পাখি ধরে ফেলল। পাখিটি খুব বুদ্ধিমান ছিল। পাখিটি শিকারির খুব প্রশংসা করতে লাগল যে, তুমি এতবড় শিকারি! জীবনে অনেক বাঘ মেরেছ, অনেক ভাল্লুক মেরেছ, এই করেছ, সেই করেছ। আমি একটা ছোট্ট পাখি, আমার ওজন ১০০ গ্রামও না, আমাকে খেয়ে তুমি কী করবে? আমাকে খেলে তো তোমার পেটের একটা কোনাও ভরবে না। তার চেয়ে বরং আমাকে ছেড়ে দাও। তোমাকে এমন তিনটি মূল্যবান বাণী শোনাব যা তোমার সারাজীবন কাজে লাগবে।
এমনভাবে সে কথাবার্তা বলছিল যে শিকারির মন গলে গেল। কারণ তেল পেতে সবাই পছন্দ করে। আরেকজনকে গলানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তেল। সে ভেবে দেখল, ঠিকই তো। এত ছোট পাখি খেয়ে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে শুনি, পাখিটা কী বলতে চায়। হয়তো এতে আমার লাভ বেশি হবে। শিকারি রাজি হওয়ায় পাখিটি বলল, আমি প্রথম বাক্যটি বলব তোমার হাতের ওপর বসে, দ্বিতীয় বাক্যটি বলব এই গাছের ডালে বসে, তৃতীয় বাক্যটি বলবো গাছের মগডালে বসে। শিকারি বললো, ঠিক আছে।
পাখি বলল, ‘কখনো অলীক কল্পনা কর না, যা অবাস্তব সেটা কখনো বিশ্বাস কর না’। শিকারি বলল, খুব ঠিক কথা। সত্যিই তাই। কখনো অবাস্তব কথায় বিশ্বাস করতে নেই। পাখি বলল, এবার আমাকে গাছের ডালে যেতে দাও। আমি দ্বিতীয় বাক্যটি বলব। শিকারি ছেড়ে দিল। গাছের ডালে উঠে পাখি বলল, ‘যা হাতছাড়া হয়ে গেল তা নিয়ে কখনো আফসোস কর না।’ শিকারি বললো, এটাও ঠিক। যা আর আমার নেই, তা নিয়ে আফসোস করা তো বোকামি। পাখি এবার মগডালে উঠল।
শিকারি বলল, এবার তৃতীয় উপদেশটি বল। পাখি বলল, তৃতীয়টি বলার আগে দেখে নিই, আগের দুটি উপদেশের শিক্ষা তোমার জীবনে কাজে লাগিয়েছ কি না। পাখিটি বলল, আমার পেটে আছে ২০০ গ্রাম ওজনের একটি মুক্তো। শুনে শিকারি খুব আফসোস শুরু করলো। হায় হায়! এ কী করলাম আমি! এভাবে হাতছাড়া করলাম ধনী হওয়ার এত সহজ সুযোগ! বলেই পাখিকে ধরার ব্যর্থ চেষ্টায় ওপরের দিকে লাফাতে লাগল।
কিন্তু পাখি তো তখন মগডালে। সে হাসল। বলল, দেখ, আমি আগেই বলেছিলাম, অবাস্তব কথা কখনো বিশ্বাস কর না। আমার ওজনই ১০০ গ্রাম। আমার ভেতরে ২০০ গ্রামের মুক্তো থাকবে কীভাবে? বলেছিলাম, যা হাতছাড়া হয়ে গেল তা নিয়ে কখনো আফসোস কর না। কিন্তু তুমি তা-ই করছ। তোমাকে আর কোনো উপদেশ দেয়া অর্থহীন। কারণ অধিকাংশ মানুষের মতো তুমিও উপদেশ কান দিয়ে শুনেছ। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নাও নি। তোমার মতো বোকা ও লোভীদের কারণেই প্রতারকরা প্রতারণা করার সুযোগ পায়।
(সংগৃহীত)

Friday, November 9, 2018

ধর্মের কি দরকার? মানবতাবাদীতাই কি শ্রেষ্ঠ ধর্ম না?

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-
huddleCLR
লিখেছেনঃ আদনান ফায়সাল
প্রচারেঃজাহিদ হাসান নিলয়

প্রশ্ন ১:

আচ্ছা ধর্মের দরকার কি আমি এটাই বুঝি না। সেই প্রাচীন যুগ তো এখন আর নাই। এখন আমরা সভ্য, বুদ্ধিমান প্রানী। মানবতাবাদীতাই কি শ্রেষ্ঠ ধর্ম না?

উত্তর:

মানবতাবাদীতে কেন শ্রেষ্ঠ ধর্ম না তার অনেকগুলো কারণ আছে, নিচের তার কয়েকটি উল্লেখ করছি।
এক – মানবতাবাদীতার সমস্যা হলো যে মানবতাবাদীতার কোন স্ট্যান্ডার্ড নাই। যেমন, আমরা সবাই জানি যে আমাদের উচিত বাবা-মার সাথে ভালো ব্যবহার করা। কিন্তু, কতটুকু ভালো ব্যবহারকে ভালো ব্যবহার বলবো? কে এটার স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দিবে? অথচ, ইসলাম বলে, বাবা-মার সাথে এমনভাবে ভালো ব্যবহার করো যে তাদের প্রতি কখনো উহ্‌ শব্দ পর্যন্ত করবে না। এমনিভাবে, মানুষের জীবনের প্রতিটা কাজের স্ট্যান্ডার্ড ধর্ম (বিশেষ করে ইসলাম) নির্ধারিত করে দেয়, ফলে পথহারা মানুষ পথ খুঁজে পায়।
দুই – মানুষ এমন একটা প্রাণী যার ব্রেইন ওয়াশ করা খুব সহজ, আর একবার ব্রেন ওয়াশ হয়ে গেলে সে মানুষ হত্যার মত ঘোরতর খারাপ কাজকেও সে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মেনে নিতে পারে (যেটা আসলে অমানবিক!)। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার জার্মানদের এমনভাবে ব্রেইন ওয়াশ করেছিল যে তারা অনায়াসে গণহত্যা সমর্থন করেছিলো। আবার, প্রিয়নবী মুহাম্মদ(সা) এর আগমনের আগে আরবের রীতি ছিল মেয়েদের জ্যান্ত কবর দেয়া, এটাকে তারা খুব স্বাভাবিক মনে করত! কারণ, তাদের ব্রেইন এভাবেই ওয়াশ হয়ে গিয়েছিল। এক সময় আমেরিকায় সমকামীদের ঘৃণার চোখ্যে দেখা হতো, অথচ এখন দেখা হয় সম্মানের চোখে! আজকের সমাজে ভাই-বোন বিছানায় শোয়াকে (Incest) ঘৃণার চোখে দেখা হয়, কিন্তু সেইদিন খুব বেশী দূরে নাই যেইদিন এই নোংরা কাজটাকেও মানবতার চোখে ‘হালাল’ হবে!
সত্যি কথা হলো, স্ট্যান্ডার্ড ঠিক না করে দিলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, ক্রমশ:ই পশু হয়ে যায় আর ভালো-মন্দের এই স্ট্যান্ডার্ড মানুষ দিতে পারবে না, কারণ সে সব সময়ই সুবিধাবাদী, সব সময়ই কিছু না কিছু দ্বারা ব্রেইন ওয়াশড।  এই স্ট্যান্ডার্ড আসতে হবে উপরের লেভেল থেকে। এই প্রসঙ্গে এমন একজনের উক্তি দিচ্ছি যাকে কোন ‘মানবতাবাদী’ উপেক্ষা করতে পারবে না! We cannot solve our problems with the same thinking we used when we created them. – Albert Einstein
একটু চিন্তা করলে বুঝবেন উপরের কথাটায় একটা অসীম পুনরাবৃত্তির চক্র রয়েছে। আপনাকে যে কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে যে লেভেলে তা তৈরী করা হয়েছিলো তার উপরের লেভেলে যেয়ে চিন্তা করতে হবে, কিন্তু ঐ লেভেলে চিন্তা করতে যেয়ে আপনি আবার কিছু সমস্যা তৈরী করবেন, যার সমাধান করতে হলে যেতে হবে আরো উপরে, তারপর আরো, তারপর আরো … শেষমেশ আপনি আসলে সমস্যার সমাধানই করতে পারবেন না। সুতরাং, মানবজীবনের সমস্যার সমাধান আসতে পারে শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছ থেকে। তোমরা কি বেশী জানো, না আল্লাহ্‌? তার চেয়ে বড় জুলুমকারী কে যে আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ গোপন করে? – (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৪০)
তিন – মানুষকে সোজা রাখার সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো Carrot and Stick পদ্ধতি ধর্মকে বাদ দিলে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতা বাদ দেয়া হয়, বাকী থাকে শুধু মানুষের কাছে জবাবদিহিতা। কাজেই, যার স্রষ্টাভীতি (ইসলামী পরিভাষায় তাকওয়া) নাই সে যখন মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তার লোভ-লালসা পূরণের কোন উপায় পেয়ে যায়, তখন সেই কাজটা খারাপ হলেও খুব সহজেই সেই পাপগুলো সে করে ফেলে বা ভালো কাজ করা থেকে বিরত থাকে।
উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন আপনার এক প্রতিবেশী আপনার কাছে একদিন সাহায্য চাইলো, আপনি তাকে সাহায্য করলেন, কিন্তু বিনিময়ে সে আপনাকে ধন্যবাদ জানালো না, আপনি কিন্তু মন:ক্ষুণ্ন হবেন। দ্বিতীয় একদিন সে সাহায্য চাইলো, আপনি সেদিনো তাকে সাহায্য করলেন, এবারো সে আপনাকে ধন্যবাদ জানালো না, আপনি কিন্তু আসলেই মন:ক্ষুন্ন হবেন এবার, এবং খুব সম্ভবত: তৃতীয়দিন সে যখন সাহায্য চাইবে আপনি তাকে সাহায্য করবেন না। কারণ, মানুষ জন্মগতভাবে প্রতিদান প্রিয় (এরজন্যই বছর শেষে বেতন না বাড়লে আপনার মন খারাপ হয়ে যায়!), সে একদিন ফ্রি ফ্রি কাজ করে দিবে, ২ দিন করে দিবে, কিন্তু তৃতীয় দিন আর করবে না। অথচ, আপনি যদি একজন প্রকৃত ধার্মিক হয়ে থাকেন, আপনি কিন্তু তা-ও ঐ মানুষটির উপকার করে যাবেন, ধন্যবাদে তোয়াক্কা করবেন না কারণ, যে আল্লাহয় বিশ্বাস করে, সে পরকালে বিশ্বাস করে। একজন প্রকৃত ধার্মিক মানুষ এই দুনিয়ায় মানুষের কাছ থেকে প্রতিদান পাবার আশায় কাজ করে না, সে কাজ করে করে আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাবার আশায়। একজন মু’মিন গীবত করবে না, অশ্লীল কথা বলবে না – যদিও সে  জানে এই কাজের জন্য তাকে পুলিশ ধরবে না, যদিও জানে কেউ তাকে দেখছে না, কিন্তু সে জানে আল্লাহর কাছে তাকে একদিন জবাবদিহি করতেই হবে, আর তাই সে সর্বাবস্থায় সকল খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করবে। কাজেই ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থা অবশ্যই ধর্মহীন জীবন ব্যবস্থা থেকে শ্রেষ্ঠ।
গবেষনায় দেখা গেছে যে ধার্মিক মানুষেরা ধর্মহীনদের চেয়ে দান বেশী করে এবং ভলান্টিয়ার কাজেও বেশী অংশগ্রহণ করে। বিশ্বখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আর্থুর সি ব্রুকস স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত তার গবেষনাপত্র Religious Faith and Charitable Giving এ তথ্য-উপাত্তসহ এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কোন্‌ কোন্‌ ফ্যাক্টর মানুষের civic behavior (যেমন – দানশীলতা এবং ভলান্টিয়ার কাজ) কে প্রভাবিত করে তা জানার জন্য ২০০০ সালে আমেরিকার কিছু রিসার্চার ৫০টি কমিউনিটির থেকে ৩০ হাজার অবজারভেশন সংগ্রহ করে। তাদের গবেষনায় প্রাপ্ত ফল দেখে তারা বিস্মিত হয়ে যায় – নাস্তিকেরা মুখে যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, ভালো কাজের হিসাব নিলে দেখা যায় যে ধার্মিকেরা ভালো কাজে অংশগ্রহণে সেক্যুলারদের থেকে বহুগুণে এগিয়ে আছে। আমি আর্থুর সি ক্লার্কের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি:
  • The differences in charity between secular and religious people are dramatic.Religious people are 25 percentage points more likely than secularists to donate money (91 percent to 66 percent) and 23 points more likely to volunteer time (67 percent to 44 percent).    
  • The data show that if two people — one religious and the other secular — are identical in every other way, the secular person is 23 percentage points less likely to give than the religious person and 26 points less likely to volunteer.
চার- মানবতাবাদীরা প্রায়শ:ই হয়ে দাঁড়ায় সুবিধাবাদী।একজন মানবতাবাদী যে শাস্তি সবার জন্য অমানবিক মনে করে, সেই একই শাস্তি তার চরম শত্রুর জন্য সঠিক বলে মনে করতে পারে। উদাহরণ দিচ্ছি। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় মানবতাবাদীরা কিন্তু এইসব অপরাধীদের ফাঁসীর জন্য গলা ফাটিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু, এরাই আবার অন্য আলোচনায় বলবেন মানুষের ফাঁসী দেয়া ঘোরতর অপরাধ, যেহেতু আমরা প্রাণ দিতে পারি না, কাজেই প্রাণ নেয়ার অধিকারো আমাদের নেই। [আপনি আবার ভেবে বসবেন না আমি ৭১ এর খুনীদের মৃত্যুদন্ড বিরোধী! আমি শুধু ৭১ কেন, সকল প্রকার খুনীরই মৃত্যুদন্ডের পক্ষে, কারণ আল্লাহর আইন সকল অপরাধীর জন্য সমান]।
পাঁচ – শেষ কথা হলো ধর্মকে বাদ দিলে আপনি সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দিচ্ছেন। অথচ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব যুক্তি প্রমাণিত দিয়ে (আমার এই লেখাটি পড়ুন), সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করা মানুষের মানসিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ্‌ মানুষকে উপাসনা করার need দিয়ে তৈরী করেছেন, আর তাই বিপদে পড়লে বা আটকে গেলে ঘোর নাস্তিকও স্রষ্টাকে ডাকে (এই ভিডিওতে উদাহরণ দেখুন)। কাজেই, স্রষ্টাকে উপাসনা না করে মানুষ কখনোই মানসিক প্রশান্তি পাবে না।  

প্রশ্ন ২:

ধর্ম ছাড়া পৃথিবীটা কত সুন্দর হতো! এই ধর্মের কারণে মানুষে মানুষে কত বিভেদ, হানাহানি, যুদ্ধ! ধর্মের ব্যাপারটা বাদ দিলে হয় না?

উত্তর:

আপনি উপরের বক্তব্যে বিশ্বাসী হলে বুঝে নিতে হবে হয় আপনি জ্ঞান রাখেন না, নতুবা আপনার ব্রেইন শয়তান ভালো মতই ওয়াশ করে রেখেছে। পৃথিবীতে হানাহানি আর যুদ্ধ বরং তখনই হয় যখন মানুষ ধর্ম মানে না। পৃথিবীর বেশীরভাগ যুদ্ধেরই কারণ হলো অর্থ আর ক্ষমতা – ধর্ম না। বিংশ শতাব্দী ছিল  ধর্ম-নিরপেক্ষতা এবং ধর্মহীনতার উত্থান এর শতক। আসুন দেখি এই শতকের মানবতার কিছু অর্জন! (তথ্যসূত্র: How Do You Kill 11 Million People – Andy Andrews)
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কীর নবগঠিত সেক্যুলার সরকার তাদের দেশের জ্ঞানী-গুনী, ধর্মীয় নেতা, নারী, গর্ভবতী মা, আর শিশুসহ ২ মিলিয়ন মানুষ
  • ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হিটলার পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে ১১ মিলিয়ন মানুষ।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আরো মারা যায় ৫ মিলিয়ন জার্মান বেসামরিক ও সামরিক মানুষ, ২.৮ মিলিয়ন ইউরোপীয়ান
  • কম্বোডিয়ার সরকার ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত মেরেছে তার দেশের তিন মিলিয়ন মানুষ – যে দেশের মোট জনসংখ্যা ছিলো ৮ মিলিয়ন
  • ১৯১৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘মানবতাবাদী’ কমিউনিষ্ট সরকার হত্যাকরেছে তাদের দেশের ৫৫ মিলিয়ন (জ্বী ঠিক পড়ছেন, সাড়ে পাঁচ কোটি) পুরুষ, নারী এবং শিশুদের!! (গত শতাব্দীর বৃহত্তম গণহত্যা!)
  • ৩রা নভেম্বর ২০০২ থেকে শুরু করে পরের ১০ বছরে মার্কিন দ্রোন হামলায় মারা গেছে ৪৭০০ মানুষ যাদের মধ্যে আছে স্কুলগামী শিশু, বিয়েতে যোগ দিতে যাওয়া বরযাত্রীসহ অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ (সূত্র: Josh Begle’s DroneStream)আপনার কাছে আমার প্রশ্ন: এই হত্যাকান্ডের কোন্‌টি ধার্মিকেরা করেছে? আর স্পেসিফিকভাবে বললে, কোন্‌টা মুসলমানেরা করেছে? বরং, যে জাতি যত ধর্মবিরোধী ছিল, সেই জাতি ছিল ততো নিষ্ঠুর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ছিল ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মতপার্থক্য, শত্রুতা, জোটবদ্ধতা, সামরিকবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়বাদ। ধর্ম এখানে সম্পূর্ন অনুপস্থিত!The main causes of World War I, which began in central Europe in late July 1914, included many factors, such as the conflicts and hostilitybetween the great European powers of the four decades leading up to the war. Militarism, alliances, imperialism, and nationalism played major roles in the conflict as well. – Wikipedia
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ছিলো হিটলারের ক্ষমতার লোভ , অর্থের লোভ। আর মানুষকে motivate  করার জন্য হিটলার ব্যবহার করেছিলেন মিথ্যা কথা আর ঘৃণাকে। কাজেই, এই যুদ্ধের জন্যও ধর্মকে দোষ দেয়ার কোন কারণ নেই! The main cause of World War II was the desire and ability of Adolf Hitler, in control of Nazi Germany, to dominate Europe and gain controlespecially of the agrarian resources to the east of Germany.– Wikipedia
৭১ সালে পাকিস্তান আর্মির গণহত্যা, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা আগ্রাসন, এমনকি সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের হত্যাযজ্ঞ – এই প্রত্যেকটি নৃশংসতার পিছনের কারণ হলো অর্থ আর ক্ষমতার লোভ । সুতরাং, সত্য হলোপৃথিবীর হত্যা, হানা-হানির মূলে আছে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করতে হবে এই সত্য উপেক্ষা করে মানুষের কাছের জবাবদিহিতা কৌশলে এড়িয়ে যেয়ে অন্ধভাবে ক্ষমতা আর অর্থের পিছনে ছুটা!
আমেরিকার বিখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ Stephen Carter বলেন যে বিংশ শতাব্দী হলো মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত শতক। আর এই বিশাল হত্যাযজ্ঞের পিছনে কারণ ধর্ম না, ছিলো ক্ষমতালোভী চিন্তা-ভাবনা! বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Zbigniew Brzezinski তার Out of Control: Global Turmoil on the Eve of the Twenty-First Century (1993) লেখায় এই হত্যাকান্ডের যে কারণ উল্লেখ করেছেন তা উদ্ধৃত করে Shaikh Hamza Tzortzis  বলেন: Lives had been deliberately extinguished, by politically motivated carnage via state backed entities. The war dead alone for politically motivated reasons is eighty seven and a half million people. State terrorism is the real terrorism.

সুতরাং, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাস হলো ক্ষমতালিপ্সু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস! গত শতাব্দীতে ৮ কোটি ৭৫ লক্ষ মানুষ মারা গেছে সেক্যুলার চিন্তা-ভাবনার রাস্ট্রগুলোর সন্ত্রাসের কারনে আর এই রাষ্ট্রগুলোই কিনা দোষ দেয় ধর্মকে! ধর্ম মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে না, ধর্ম মানুষকে একত্রিত করে, কমন লক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে, অন্য মতের প্রতি সহিষ্ণু হতে শেখায়। অন্যদিকে মানুষকে বিভক্ত করে মুনাফালোভী ধর্মবিদ্বেষী চিন্তা-ভাবনা। প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা থেকে মানুষ যত বেশী দূরে সরে যাবে, ততই সে দূরে সরে যাবে মনুষ্যত্ব থেকে। … যে ব্যক্তি নরহত্যা বা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী কাজের শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করল। আর যে কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষের প্রানরক্ষা করল।  – সূরা মায়িদাহ্‌ ৫:৩২
ইসলামের ইতিহাস যদি ঘাটেন তো দেখবেন মুসলিমরা কখনোই জোর করে তাদের ধর্ম অন্য মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়নি। ইসলামী রাষ্ট্রে অন্য ধর্মাবলম্বীদের নির্বিঘ্নে ধর্ম-চর্চার অধিকারের ইতিহাস নিয়ে মুসলিমরাই শুধু নয়, অমুসলিমেরাও শত শত গবেষণামূলক লেখা লিখেছেন (পড়ুন Alexander Knysh এর লেখা Islam in Historical Perspective)।  
ইসলামের সহমর্মিতার আমি শুধু কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি:
  • মদীনায় রাসূলুল্লাহ(সা) নিশ্চিত করেছিলেন যাতে  ইহুদীরা নির্বিঘ্নে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে।
  • উমার(রা) জেরুজালেম এর চাবি হিরাক্লিয়াস এর কাছ থেকে বুঝে নেয়ার পর পাদ্রীর অনুরোধের পরেও গীর্জায় যোহরের নামাজ পড়েননি শুধুমাত্র এই কারণে যে ভবিষ্যতের মুসলিমরা এই গীর্জাকে হয়তো আমিরুল মু’মিনীন এর মসজিদ বলে দাবী করবে।
  • খালিদ বিন ওয়ালিদ(রা) এর নেতৃত্বে ৬৩৪ খ্রীষ্টাব্দে সিরিয়ার দামাস্কাস বিজয় করার পর মুসলিমরা সেন্ট জন দি ব্যাপ্টিস্ট গির্জাতে শুক্রবারে জুমুআর নামাজ পড়ত, একই সপ্তাহের রবিবারে খ্রীষ্টানেরা সেই একই গির্জায় তাদের সাপ্তাহিক উপাসনা করত। মুসলিমরা দামাস্কাসে এসে খ্রিস্টানদের গির্জা ভেঙ্গে দেই নাই। বরং মুসলিমদের ব্যবহার আর চারিত্রিক গুনাবলিতে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
  • ক্রুসেডারেরা ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই জেরুজালেম দখল করে মুসলমানদের রক্তে পুরো শহরকে হাঁটু পর্যন্ত রক্তে ডুবিয়ে দেয়, কিন্তু এর প্রায় ১শ বছর পর ১১৮৭ সালে সালাহ-আদ-দীন আইউবী (রহিমাহুল্লাহ) যখন জেরুজালেম পুনরূদ্ধার করেন তখন তিনি কোনও প্রতিশোধ তো নেনই নি বরং খ্রীষ্টানসহ সকল বিধর্মীদের ক্ষমা করে দেন, তাদেরকে তাদের মতো করে ধর্ম পালন করতে দেন, এমনকি তাদের কে তাদের সকল সম্পদ নিয়ে অন্য দেশে (ইউরোপে) চলে যাওয়ারও স্বাধীনতা দেন।
[বিস্তারিত জানতে দেখুন: PBS Documentary – Islam: Empire of Faith.]
সকল ধর্মের মানুষের প্রতি ইসলাম সহনশীলতার কথা বলে, সহমর্মিতার আর ন্যায়বিচারের কথা বলে। কারণ এটা মানুষের তৈরী ধর্ম না, এটা এসেছে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছ থেকে, যিনি সবচেয়ে বেশী ন্যায়বিচারক। একজন মু’মীনের কাছে একজন মুসলমান যতটুকু নিরাপদ, একজন অমুসলিমও ততটুকুই নিরাপদ – যেরকম রাসূলুল্লাহ(সা) শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: সাবধান! যে ব্যক্তি কোনও মুয়াহিদের (মুয়াহিদ: মুসলিম রাষ্ট্রে ন্যায়সঙ্গতভাবে বসবাসরত অমুসলিম) উপর অত্যাচার করবে অথবা তার কোন অধিকার ছিনিয়ে নিবে অথবা তাকে অসহনীয় যন্ত্রণা দিবে অথবা তার অনুমতি ছাড়া তার কোনও কিছু নিবে, সে জেনে রাখুক যে বিচার দিবসে আমি তার (অত্যাচারী ব্যক্তির) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।  – (সুনান আবু দাউদ, ভলিউম ৩, হাদিস ৩০৫২)
copied from Quraner alo    

দাওয়াতি কাজ সকল মুসলিমের জন্য ফরজ এবং সাধারণ মানুষদের দাওয়াতি কাজের কতিপয় পদ্ধতি

  ▬▬▬✪✪✪▬▬▬ প্রশ্ন: সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ কি সবার উপরে ফরজ? যাদের দ্বীনের জ্ঞান নেই যেমন জেনারেল লাইনে পড়া মানুষ কিন্তু দ্বীন জানার...