Friday, August 16, 2019

ইসলামে হালাল উপার্জন : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

লিখেছেন: ড. মোঃ আবদুল কাদের | ওয়েব সম্পাদনা: মোঃ মাহমুদ ইবনে গাফফার
ইসলাম পরিপূর্ণ এক জীবন ব্যবস্থার নাম।এতে মানবজীবনের ব্যক্তিগত পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের যাবতীয় বিষয়ের সমাধানে হিকমতপূর্ণ বিধানের বর্ণনা রয়েছে। এটি মানুষের জন্য যা কল্যাণকর ও হিতকর সে বিষয় বৈধ করত: সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতিকর বিষয় হতে মানবজাতিকে সর্তক করেছে। অতএব, ইসলাম মানবজাতির জন্য কল্যাণের আঁধার হিসেবে শান্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। মানবদেহের জীবনীশক্তি হিসেবে রক্তের যে গুরুত্ব রয়েছে, মানবজীবনে অর্থের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। ফলে অর্থ মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এর জন্য প্রয়োজন মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার। জীবন নির্বাহের এ মাধ্যমটিই পেশা হিসেবে পরিগণিত।
মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নির্ধারিত ফরজ ইবাদত (যেমন নামায) সম্পন্ন করার পর জীবিকা অন্বেষনে জমীনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব নিজেই জীবিকা অর্জনে ব্রতী হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পরিশ্রম লব্দ উপার্জনকে সর্বোত্তম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে নিশ্চয় উপার্জনের পন্থা শরীয়াত নির্ধারিত পন্থায় হতে হবে। এমন উপার্জনকে ইসলাম অবৈধ ঘোষনা করেছে, যাতে প্রতারনা, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, জনসাধারণের অকল্যাণ সর্বোপরি জুলুম রয়েছে। দুনিয়ার জীবনে অবৈধ পন্থায় উপার্জন করে সুখ-সাচ্ছন্দ লাভ করলেও পরকালীন জীবনে রয়েছে এর জন্য জবাবদিহিতা ও সুবিচার। সে লক্ষে ইসলাম হালাল উপার্জনের অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছে। নিম্নে এসম্পর্কে আলোচনা প্রদত্ত হলো:

উপার্জনের গুরুত্ব

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, মানুষের মৌলিক অধিকার। এগুলোর যোগান দিতে মানুষকে বেছে নিতে হয় সম্পদ উপার্জনের নানাবিধ পন্থা। জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ যেসব পেশা অবলম্বন করে তা হলো: কৃষি, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকুরী, শিল্প প্রভৃতি। উপার্জনের মাধ্যম ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষেই উপর্যুক্ত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। মানুষকে মহান আল্লাহ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব হিসেবে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তাদের যাবতিয় মৌলিক অধিকারও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে লক্ষে তিনি মহাশুণ্যের সব সৃষ্টিকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: ‘‘তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (ব্যবহারের জন্য) তৈরী করেছেন।’’ [1]
তবে এক্ষেত্রে তিনি মানুষকে দিয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা যা তার ইখতিয়ারভুক্ত একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। ফলে প্রত্যেকে স্ব-স্ব যোগ্যতা, মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যেমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রয়াস চালায়।
মানবজীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মানুষের জীবন নির্বাহের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে সমাদৃত, মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত। মহান আল্লাহ মানুষকে এর গুরুত্ব অনুধাবন বোধগম্য করার নিমিত্তে পবিত্র কুরআনে সালাতের পাশাপাশি যাকাত তথা অর্থের উল্লেখ ৮২ স্থানে করেছেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ অর্থনৈতিক বিধানও নির্দেশ করেছেন। ফলে কুরআনুল কারিমকে একটি অর্থবিদ্যার মহাকোষ বললেও অত্যুক্তি হবে না। মানুষ কিভাবে উপার্জন করবে, কোন পন্থায় তা ব্যয় করবে এবং উপার্জনের ক্ষেত্রে যাবতীয় অর্জনীয় ও বর্জনীয় গুণাবলীর সম্পর্কে এর সুষ্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান। তাইতো ব্যক্তির উপার্জিত সম্পদে তিনি যাকাত ফরয করেছেন, যেন সম্পদ এক শ্রেণির লোকদের মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে। আল্লাহ তা‘আলা ফরয ইবাদত সমাপনান্তে জীবিকা নির্বাহে উপার্জন করার লক্ষ্যে যমিনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: ‘‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে, এবং আল্লাহকে অধিক স্মরন করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।’’ [2]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন: ‘‘যখন নামায শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমরা ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেড়িয়ে পড়ো।’’ [3]
এখানে উপার্জনের একটি মূলনীতি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। আর তাহলো এমন পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে আল্লাহর স্মরণে ব্রত থাকা যায়।
অতএব, যেসব পেশায় বা উপার্জনের পন্থায় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ইসলাম তা অবৈধ হিসেবে ঘোষনা করেছে। পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। সেটি হলো ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যদি কখনও আল্লাহর স্মরণে ব্রত হওয়ার আহবান আসে, তাহলে তখন যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্ম পরিহার করা সকল ইমানদারদের জন্য ওয়াজিব। [4]
জীবিকা অর্জনের নিমিত্তে বিদেশে পাড়ি জমানোরও নির্দেশও রয়েছে এবং এটিকে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সমপর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘আল্লাহ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে দেশভ্রমন করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।’’ [5]
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন: ‘‘অর্থ্যাৎ যারা ব্যবসা-বানিজ্য ও রিযিক উপার্জনের বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের অন্বেষায় পৃথিবীতে ভ্রমনরত।’’ [6]
তাছাড়া ব্যক্তি জীবনে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে উৎসাহিত করেছেন যে, ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি নিন্দা করেছেন। এ মর্মে যুবাইর ইবনে ‘আউয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘তোমাদের কেউ তার রশি নিয়ে চলে যাক, পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে এনে বিক্রয় করুক এবং তার চেহারাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচিয়ে রাখুক এটা তার জন্য মানুষের নিকট ভিক্ষা করা, চাই তাকে দান করুক বা না করুক তার চাইতে উত্তম।’’ [7]
অতএব উপার্জন করার মনোবৃত্তি ব্যতিরেকে যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হয় তাদের এ ধরনের পেশাকে অবৈধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায় সে কিয়ামতের দিন এমন অরস্থায় আগমন করবে যে, তার মুখমণ্ডলে এক টুকরো গোশতও থাকবে না।’’ [8]
ইসলাম মানবতার ধর্ম। দুস্থ মানবতার সেবায় দান করার রীতি ইসলামে চালু আছে। তবে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে ইসলাম অনুমোদন দেয় নি। বরং একে বার বার নিরুৎসাহিত করেছে যা, নিষেধের পর্যায় পৌঁছে গিয়েছে।
উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম নিজ হাতে উপার্জন করাকে সর্বোত্তম উপার্জন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এ মর্মে হাদীসে এসেছে: “হযরত রাফে ইবনে খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন: ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্দ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়।’’ [9]
নবী রাসূলগণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁরা নিজ হাতে কর্ম সম্পাদনকে অধিক পছন্দ করতেন। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে প্রাথমিক সময়ে ছাগল চড়ানো ও পরবর্তীতে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ব্যবসায়িক দায়িত্ব পালনের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহে উৎকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল উপার্জন

হালাল বলতে আমরা সাধারণত: যাবতীয় বৈধ পন্থাকেই বুঝি। যা কল্যানকর ও হিতকর এবং যাবতীয় অবৈধ ও অকল্যাণকর হতে মুক্ত। ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে উপার্জনের জন্যে উৎসাহ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং যাবতীয় বৈধ ও অবৈধ পন্থাও বাতলে দিয়েছেন। অতএব হালাল উপার্জন বলতে বুঝায় উপার্জনের ক্ষেত্রে বৈধ ও শরী‘আত সম্মত পন্থা অবলম্বন।
হালাল উপায়ে জীবিকা উপার্জনের ফলে সমাজ ব্যবস্থায় ধনী দরিদ্রের মাঝে সুষম ভারসাম্য ফিরে আসে; কৃষক দিন মজুর, ক্রেতা-বিক্রেতা, শ্রমিক-মালিক এবং অধস্তনদের সাথে উর্ধ্বতনদের সুদৃঢ় ও সংগতিপূণ সর্ম্পক তৈরী হয়। ফলে সকল শ্রেণীর নাগরিকই তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায় এবং সমাজ সংসারে নেমে আসে শান্তির সুবাতাস। মূলত: ইসলাম যে পেশাকে অবৈধ বলে ঘোষনা করেছে সেসব পন্থায় উপার্জন ব্যতীত অন্যান্য পন্থায় উপার্জন করা বৈধ বলে বিবেচিত।[10]
ইসলাম প্রদত্ত সীমারেখা ও মূলনীতি ঠিক রেখে বৈধ যে কোন পণ্যের ব্যবসা করার মাধ্যমে উপার্জনকে ইসলামী শরী‘আত হালাল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া যদি কেউ বৈধ উপায়ে যোগ্যতানুযায়ী চাকুরী করে এবং ঘুষ সহ যাবতীয় অবৈধ লেন-দেন ও অসৎ মানসিকতা থেকে দুরে থাকে তবে সেটাও জীবিকার্জনের হালাল পন্থা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এটি শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রোযা, যাকাত প্রভৃতির উপরই সীমাবদ্ধ নয়। জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ রেখার প্রণেতা হিসেবে ইসলামে রয়েছে জীবন ধারনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা। এ দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে হালাল উপায়ে উপার্জনের ব্যবস্থা গ্রহণও অন্যতম একটি মৌলিক ইবাদত। শুধু তাই নয়, ইসলাম এটিকে অত্যাবশ্যক (ফরয) কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস প্রনিধানযোগ্য। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘ফরয আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও ফরয।’’ [11]
উপর্যুক্ত হাদীসের মাধ্যমে প্রতিভাত হয় যে, ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব কতখানি এবং কোন ব্যক্তি যেন হারাম কোন পেশা অবলম্বন না করে উপরোক্ত হাদীসে সে মর্মেও অর্ন্তনিহীত নির্দেশ রয়েছে। পরকালীন জীবনে এ ফরয ইবাদতটি সম্পর্কে যে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা যাবতীয় ফরয সম্পর্কে বান্দা জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব এটি ফরয কাজ সমূহের অন্তর্গত এক মৌলিক অত্যাশ্যকীয় ইবাদতে গণ্য হয়েছে।
উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব পন্থাকে হালাল করেছে সেগুলোর মূলনীতিসহ সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো:

১.১ ব্যবসা বাণিজ্য

উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য সব চেয়ে বড় সেক্টর। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি মহৎ পেশা। সমাজ জীবনে যার ক্রিয়াশীলতা ও প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূঢ় প্রসারী। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে শুধু বৈধ বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং এ ব্যাপারে সবিশেষ উৎসাহ ও গুরুত্ব প্রদান করেছে। যেন মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীর বুকে একটি শ্রেষ্ট জাতি হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি ও স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘তিনি (আল্লাহ) ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’’ [12]
উপরোক্ত আয়াতের মর্ম উপলব্দিতে প্রতীয়মান হয় যে, সুদভিত্তিক লেন-দেনের মাধ্যমে যারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করছে তাদের মুকাবিলায় মহান আল্লাহ ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ বলে ঘোষনা দিয়েছেন। অতএব অবৈধ পন্থা হতে বাঁচার এবং প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি লাভের এটি অনেক বড় অবলম্বণ। এছাড়াও জীবিকার একটি বৃহৎ অংশ রয়েছে এ ব্যবস্থাপনায়। মুরসাল হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: ‘‘তোমরা ব্যবসা বানিজ্য কর। কারণ তাতেই নিহিত রয়েছে নয়-দশমাংশ জীবিকা’’ [13]
তাছাড়া সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়নতা, ধোঁকামুক্ত, কল্যাণমুখী মানসিকতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের প্রশংসায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনেক হাদীস বিদ্যমান। এ ধরনের ব্যবসায়ীকে তিনি নবীগণ, ছিদ্দিক, ও শহীদদের সমমর্যাদাপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী (পরকালে) নবী, সিদ্দিকীন ও আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনকারী শহীদদের সঙ্গী হবে।[14]
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব মূলনীতি দিয়েছে তাহলো: ধোঁকা ও প্রতারনামুক্ত, মিথ্যার আশ্রয় বিহীন, পণ্যের দোষ – গুণ স্পষ্ট থাকা, ভাল পণ্যের সাথে খারাপ পণ্যের মিশ্রণ না করা, মুনাফাখোরী মানোবৃত্তি পরিহার করে কল্যাণমুখী মানষিকতা পোষণ, মজুদদারি চিন্তা-চেতনা পোষণ না করা, ওজনে হের-ফের না করা, সর্বোপরি যাবতীয় শঠতা ও জুলুম থেকে বিরত থাকা।

১.২. চাকুরী

এটি জীবিকা নির্বাহে উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের দেশে সরকারী আধা-সরকারী, বেসরকারী, ব্যাংক-বীমা, এন.জি.ও. ও ব্যক্তিমালিকানাধিন এবং স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। এসব চাকুরীর ক্ষেত্রে ইসলামের মূল দর্শন হলো প্রত্যেক চাকুরে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সচ্ছতার সাথে পালন করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ের মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: ‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’’ [15]
তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই সকলকে যাবতীয় অনিয়ম, দুর্নীতি যেমন ঘুষ গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি অন্যায়ভাবে কাউকে  সুযোগ সুবিধা (undue Facilities) দান, কারো প্রতি জুলুম করা প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি-পরায়ণদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। [16]
এছাড়াও কর্তব্যে অবহেলা, অনিয়মানুবর্তিতা ও কার্যে উদাসীনতার দরুন চাকুরীজীবিদের উপার্জন অনেক সময় বৈধতা হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে দেখা যায় অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠ দানের পরিবর্তে টিউশনী ও কোচিং সেন্টারের প্রতি বেশী ঝুকে পড়েছেন। অনেক ডাক্তার হাসপাতালে রোগী না দেখে ক্লিনিকে জমজমাট ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। যা কর্তব্যে অবহেলার নামান্তর। তারা যদি স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ ও পূর্ণভাবে পালন করার পর অতিরিক্ত সময় এসব কাজ করেন তবে তা দোষের নয়।

১.৩.কৃষিকর্ম

কৃষিকর্ম জীবিকা নির্বাহে অন্যতম উপার্জন মাধ্যম। ইসলাম এটিকে মহৎ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষিকার্যের সুচনা হয়েছে আদিপিতা আদম আলাইহিস সালাম থেকেই তাঁকে কৃষি কার্য, আগুনের ব্যবহার ও কুটির শিল্প শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। [17]
পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে এ ব্যবস্থাকে সাব্যস্ত করেছেন।[18]
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অধিকাংশ লোকই কৃষি নির্ভর জীবিকা নির্বাহ করে। অথচ ইসলামের কৃষিনীতি সম্পর্কে অবগত হয়ে যদি কেউ তাঁর এ ব্যবস্থাপনায় ইসলামী নীতি অনুসরণ করে তবেই তা হালাল উপার্জন হবে। আর সেগুলো হলো:
[ক]. ভূমির মালিক নিজেই চাষ করবে। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘যার জমি রয়েছে সে নিজেই চাষাবাদ করবে।’’ [19]
তবে এক্ষেত্রে কারো জমি অন্যায়ভাবে অধিকারে আনে কিংবা উত্তরাধিকারকে অংশ না দিয়ে চাষ করলে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। [20]
অথবা, মজুরের দ্বারা নিজের তত্বাবধানে চাষ করবে অথবা কোন ভূমিহীনকে চাষাবাদ ও ভোগদখল করতে দিবে।
[খ]. উৎপন্ন ফসলের নির্দিষ্ট অংশ দেয়ার শর্তে কাউকে চাষ করতে দেয়া।
[গ]. প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকার বিনিময়ে কাউকে এক বছরের জন্য তার ভোগাধিকার দান করা। [21]
[ঘ]. জমিতে হারাম দ্রব্য উৎপাদন না করা, যাতে ক্ষতিকর কোন উপাদান রয়েছে্ যেমন: আফিম, গাঁজা, চারস বা অনুরূপ মাদক দ্রব্য। [22]
[ঙ]. অংশীদারিত্ব চাষাবাদ যাবতীয় প্রতারণা, ধোঁকা, ঠকবাজি, ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত থেকে ন্যায়পরায়নতা ও ইনসাফ ভিত্তিক নীতির লালন করতে হবে। আল্লামা মাওয়ারদী উল্লেখ করেছেন যে: উৎপাদনের মূল উপাদান দু’টি, এক. কৃষি, দুই. ব্যবসা-বানিজ্য। তবে এদুয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম হলো কৃষি। [23]
ইসলামে মানুষের অর্থ-সম্পদ লাভের তিনটি নৈতিক পন্থা নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে। আর তা হলো:
১. পরিশ্রম: পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ অর্থ সম্পদ উপার্জন করতে পারে। সে সঙ্গে মেধা ও যোগ্যতার সমন্বয়ে মানুষ অর্থের পাহাড় গড়তে সক্ষম হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আল্লাহর নিকট ঐ জীবিকাই উত্তম যা মানুষ নিজ হাতে উপার্জন করে। এভাবে শ্রমদানের ক্ষেত্রও বহুবিধ ও বিচিত্র ধরনের। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
২. শিল্পকর্ম: ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি শিল্পকর্মও মানুষের অন্যতম পেশা। এ মহতি পেশায় জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত রয়েছে। এ কর্মটি সম্পর্কে ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্বরোপ করেছে। যুগে যুগে প্রেরিত নবী-রাসূলগণ শুধু উৎসাহের বানী প্রদান করেই ক্ষান্ত হননি; বরং শিল্প ও ব্যবসার ময়দানে তাদের বিশাল অবদান রয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: ‘‘আমি তাঁকে (দাউদ আলাইহিস সালাম) বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে।’’ [24]
শিল্প শিক্ষাকে মহান আল্লাহ নিয়ামত হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এ-জন্য শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর নবীগণ কোন না কোন শিল্পকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। উপরোক্ত আয়াতে দাউদ আলাইহিস সালাম বর্ম শিল্পে নিয়োজিত ছিলেন বলে আভাস রয়েছে। এছাড়াও তিনি প্রথম জীবনে চাষী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি শষ্য বপন ও কর্তন করতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে জমি মানুষের খিদমতের জন্য কোন কাজ করে তাঁর দৃষ্টান্ত মূসা আলাইহিস সালাম জননীর ন্যায়। তিনি নিজে সন্তানকে দুধ পান করিয়েছেন; আবার ফেরাউনের কাছ থেকে পাবিশ্রমিক পেয়েছেন।
এছাড়া মূসা আলাইহিস সালাম মাদইয়ানে ৮ বছর চাকরী করছেন, নূহ আলাইহিস সালাম জাহাজ নির্মান করেছেন। যাকারিয়া আলাইহিস সালাম কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাল্যকালে ছাগল চরাতেন, যৌবনে ব্যবসা করেছেন, চাকরী করেছেন, খন্দকের যুদ্ধে মাটি কেটেছেন, মাথায় বোঝা বহন করেছেন। কূপ থেকে পানি তুলেছেন, নিজ হাতে জামা ও জুতা সেলাই করেছেন, স্ত্রীকে ঘরে রান্নার কাজে সাহায্য করেছেন, এমনকি দুধ দোহনও করেছেন। এজন্য পেশা ক্ষুদ্র হোক, বৃহৎ হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। নিজে পরিশ্রম করে শ্রমলব্দ আয়ে নিজের পরিবারবর্গের আস্বাদনের জন্য সংগ্রাম করা অতিশয় সম্মান ও পূণ্যের কাজ।
৩. উত্তরাধিকার: উত্তরাধিকারসূত্রে মানুষ অর্থ সম্পদ লাভ করে থাকে। কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিগণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী মৃতের পরিত্যক্ত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি হতে যে সম্পদ লাব করে থাকে তা হালাল।
৪. হেবা বা দান: কোন বিনিময় মূল্য বা প্রতিদান ব্যাতিরেকে কাউকে নিজের সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর বা দান করা এবং যার অনুকুলে হস্তান্তর বা দান করা হয় সে ব্যাক্তি কর্তৃক তা গ্রহণ করাকে হেবা বলা হয়। হেবার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সম্পদ হালাল।

উপার্জন বৈধ হওয়ার ইসলামী মূলনীতি

ইসলামে উপার্জনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় দু’টি মূলনীতি রয়েছে।
এক. মূলগত: যা উপার্জন করা হবে তা মূলগতভাবে হালাল হতে হবে।
দুই. পদ্ধতিগত: যা উপার্জন করব তা বৈধ পন্থায় হতে হবে।

এক. মূলগত

একজন ব্যক্তি যা উপার্জন করবে সে উপার্জেয় বস্ত্তটি অবশ্যই উত্তম ও হালাল হতে হবে। আর ইসলাম যাবতীয় কল্যাণকর ও হিতকর বস্ত্তকে মানবজাতির জন্য হালাল করেছে।
সেলক্ষ্যেই পবিত্র কুরআনে طيبات ও حلال শব্দের অবতারনা হয়েছে। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে সম্বোধন করে হালাল ও তাইয়্যিব যা রয়েছে তা থেকে আহার করতে বলেছেন। তিনি বলেন: ‘‘হে মানুষ! পৃথিবীতে হালাল ও তাইয়্যেব যা রয়েছে তা থেকে আহার কর। আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নি:সন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [25]
উপরোক্ত আয়াতের আলোকে বলা যায় যে, শুধুমাত্র হালাল হলেই চলবে না; বরং তা অবশ্যই তাইয়্যিব (পবিত্র ও উত্তম) হতে হবে। এখানে তাইয়্যিব বলতে ভেজালমূক্ত স্বাস্থসম্মত উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এমন উপায় অবলম্বন করতে হবে যা মূলগত ভাবেই নির্ভেজাল, খাটি ও পবিত্র। অবশ্য অধিকাংশ মুফাস্সিরগণ আয়াতে হালাল শব্দ দ্বারা মূলগত বৈধতার এবং তাইয়্যিব দ্বারা পদ্ধতিগত বৈধতার অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং এ দু’শব্দ দিয়ে দু’টি মূলনীতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

দুই. পদ্ধতিগত

উপার্জনের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় উপায় ও মাধ্যমটি অবশ্যই বৈধ পন্থায় হতে হবে। কেননা যাবতীয় অবৈধ উপায় ও পন্থায় অর্থসম্পদ উপার্জন করতে ইসলাম নিষেধ রয়েছে। পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতের মাধ্যমে এ বিষয়ে মুমিনগণকে সর্তক করা হয়েছে।মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করোনা। কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাযি হয়ে ব্যবসা করা বৈধ; এবং একে অপরকে হত্যা করিওনা; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। আর যে কেউ সীমালংঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে, তাকে আমি অগ্নিতে দগ্ধ করব, আর এটা করা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’’ [26]
মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দাংশ জেনে শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকগণের নিকট পেশ করো না।’’ [27]
উপরোক্ত আয়াতদ্বয় দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, উপার্জনের পদ্ধতি ও পন্থা অবশ্যই বৈধ হতে হবে। অন্যথায় কঠোর শাস্তির ঘোষনা রয়েছে। আর এ ধরনের উপায় জুলমের নামান্তর। যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। অতএব প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত উচিত উপার্জনের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত দু’টি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা।
প্রখ্যাত আধুনিক তাফসিরকার আল্লামা রশিদ রেজা আয়াতে উল্লেখিত হালাল ও তাইয়্যিবা এ দু’টি শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, কোন বস্ত্ত তাইয়্যিব বা উত্তম হওয়ার অর্থ হলো তাতে অন্যের অধিকার সম্পৃক্ত না থাকা। কেননা পবিত্র কুরআনে যেসব বস্ত্তর ব্যাপারে হারাম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলো মূলগতভাবেই হারাম বা নিষিদ্ধ। একমাত্র নিরূপায় অবস্থা ছাড়া কোন অবস্থাতেই তার ব্যবহার বৈধ নয়। এ ছাড়াও এক ধরনের হারাম রয়েছে যা মূলগতভাবে হারাম নয় কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোন কারণে তাকে হারাম বলা হয়েছে। মূলত: এ জাতীয় বস্ত্তর বিপরীতেই তাইয়্যিব বা উত্তম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং যেসব বস্ত্ত অন্যায়ভাবে উপার্জন করা হয়েছে, ন্যায়ানুগ পন্থায় করা হয়নি। যেমন: সুদ, ঘুষ, জুয়া, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, ধোঁকা-প্রতারনা, আমানতের খিয়নত ইত্যাদি পন্থায় করা হয়েছে এগুলো হারাম। অর্থ্যাৎ এগুলো তাইয়্যিব বা উত্তম নয়। সারকথা প্রতিটি অপবিত্র বস্ত্তই হারাম, তা মূলগত কারণেই হোক কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্য কোন কারণেই হোক।

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:

জীবিকা নির্বাহের জন্য উপার্জনের গুরুত্ব ইসলামে যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও অত্যাধিক। ইসলাম মানুষের জন্য যাবতীয় জীবনোপকরণকে সহজসাধ্য, সুস্পষ্ট, ও পবিত্র করার নিমিত্বে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা দিয়েছে। অতএব নির্দেশনা বহির্ভূত যাবতীয় উপার্জনই হারাম বা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত। ইসলামের বক্তব্য হল মানুষকে নিজের সার্মথ্য ও যোগ্যতানুযায়ী নিজেই নিজের প্রয়োজনীয় অর্থ ও দ্রব্য সামগ্রীর সন্ধান করবে। এটি মানুষের অন্যতম অধিকার। তবে ইসলাম মানুষকে এ অধিকার দেয়নি যে, সে অর্থ সম্পদ উপার্জনের জন্য স্বীয় খেয়ালখুশিমত যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারবে। তাইতো ইসলাম অর্থসম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সমাজ রাষ্ট্র ও ব্যাক্তির জন্য কল্যানকর যাবতীয় ব্যবস্থাকে ইসলাম হালাল করেছে। নিম্নে এ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হল:

এক. হালাল উপার্জন একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান

ইসলাম মানুষের জন্য হালাল ও হারামের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপন করেই শেষ করেনি, বরং হালাল উপার্জনে রয়েছে এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ফরজ ইবাদত সমূহের আদায়ের পর এ মহতি কর্মে ঝাপিয়ে পরতে উৎসাহিত করা হয়েছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও বৈধ উপায় অবলম্বন করা ব্যবসায়ীসহ সকল মানুষের উপর ইসলামের একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। যারা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না তাদের ব্যপারে নবী করিম সতর্কবাণী করেছেন। তিনি বলেন: ‘‘মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোন উৎস থেকে সম্পদ আহরন করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করবে না।’’ [28]

দুই. হালাল উপার্জন দু’আ কবুলের পূর্বশর্ত

মানুষের প্রত্যহিক ও জাগতিক জীবনের চাহিদার কোন অন্ত নেই। তবে এগুলো মানুষের কাঙ্খিত ও বাঞ্চিত হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মহান স্রষ্ট্রার অনুগ্রহের, ভূমিকাই সবচেয়ে বেশী। আর এর জন্য প্রয়োজন একান্তে তাঁর দরবানে আরাধনা করা। মহান আল্লাহ ও মানুষে এ ব্যপারে সাড়া দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এটি অন্যতম ইবাদত ও বটে। রাসূল সা. বলেন: ‘‘দোয়া হচ্ছে ইবাদত’’ অতএব দু’আ ইসলামে অন্যতম একটি ইবাদতে পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে বান্দার সাথে আল্লাহর গভীর প্রেম নিবেদন করা চলে এবং যাবতীয় প্রয়োজন পূনণে সহায়ক হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি আল্লাহর দরবারে গৃহীত হতে হলে উপার্জন অবশ্যই হালাল হতে হবে। কেননা আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কোন কিছুই গ্রহণ করেননা, অতএব অবৈধ উপার্জন যারা করে তাদের খাদ্যের উপার্জন হয় অবৈধ অর্থে হওয়ায় ইসলম যাবতীয় রক্ত মাংশ সবই হারাম দ্বারা পুষ্ট হয়। ফলে এ ধরনের ব্যক্তির প্রার্থনাকে ইসলামে কখনো সমর্থন করেনা। [29]
এ মর্মে রাসূল সা. বলেন: ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআল পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণের।’’ আল্লাহ তা’আলা বলেন : ‘‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।’’ অতঃপর রাসূল সা. এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছেঃ হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ! অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে?’’ [30]
ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছেঃ ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একদা এ আয়াতটি তেলাওয়াত করা হল। ‘‘হে মানবমন্ডলী ! পৃথিরীর হালাল ও পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী ভক্ষন কর।’’ তখন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লহর কাছে দু’আ করুন যেন আমার দু’আ কবুল হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হে সা‘দ, তোমার পানাহারকে হালাল কর, তবে তোমার দু’আ কবুল হবে।’’  [31]

তিন. হালাল উপার্জনে বরকত লাভ হয়

উপার্জনে বরকত লাভ করতে হষে একমাত্র হালাল পন্থায় হতে হবে। কেননা বরকত দানের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি শুধু বৈধ উপার্জনেকেই বরকত মন্ডিত করেন। এবং যাবতীয় অবৈধ উপার্জনের বারকত নষ্ট করে দেন। আর যেখানে অপচয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সম্পদের প্রাচুর্যতা লাভে বিলম্ব হয়। অন্যদিকে হালাল উপার্জন কম হলেও তাতে বরকতের কারণে খুব স্বল্প সময়েই বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

চার. হালাল উপার্জন জান্নাত লাভের একমাত্র উপায়

মানুষের দু’টি জীবন রয়েছে, একটি ইহলৌকিক, অপরটি পরলৌকিক। অতএব হালাল পন্থায় উপার্জনকারী পরকালে জান্নাতে যাবে। আর অবৈধ পন্থায় উপার্জনকারী ব্যাক্তি দুনিয়ার জীবনে সম্পদের পাহাড় গড়লেও পরকালীন জীবনে তার জন্য ভয়াবহ আযাব ও শাস্তি অপেক্ষা করছে।

পাঁচ. অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনকারীর জন্য জাহান্নাম অবধারিত

ইবন আববাস রা.বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘‘আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম।’’ [32]
কাব ইবন উজরাহ রা. রাসূলে কারীম সা. থেকে বর্ণনা করেন: ‘‘যে শরীর হারাম পেয়ে হ্রষ্ট পুষ্ট হয়েছে, তা জান্নাতে যাবে না।’’  [33]
দুনিয়ার জীবনের কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য পুরুস্কার ও শাস্তি উভয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যারা তাঁর অনুগত বান্দা তারাই পুরুস্কার প্রাপ্ত হবে। যেহেতু অবৈধ উপায়ে উপার্জনকারী ব্যক্তি তার অবাধ্য ও দুশমন তাই তাদের জন্য ও শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। অতএব এ পন্থা অবলম্বনকারী ব্যক্তি জাহান্নামী।

ছয়. হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের শর্ত

অর্থ-সম্পদ দ্বারাই মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে, খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে তার দেহের বৃদ্ধি ঘটে এবং সুস্বাস্থ্য লাভ হয়। কিন্তু এ উপকরণ ক্রয়ের অর্থ যদি অবৈধ উপায়ে উপার্জিত হয় তবে তা কিভাবে বৈধ শারিরিক বৃদ্ধি হতে পারে। ফলে তার শরীরের রক্তে ও মাংসে অবৈধ বিষয়ের সংমিশ্রন ঘটে। আর এর দ্বারা যত ইবাদতই করা হোক না তা গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। কেননা আল্লাহ অপবিত্র কোন কিছুই গ্রহণ করে না। অতএব হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের পূর্ব শর্ত হিসেবে শিরোধার্য। সালাত, যাকাত ও হজ্জ ইত্যাদি ফরয ইবাদতসমূহ কবুল হওয়ার জন্র অবশ্যই বৈধ পন্থায় উপার্জন করতে হবে।

খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন হালাল উপার্জনের অন্বেষক

তাঁরা যাবতীয় লেন দেন হালাল পন্থা অবলম্বন করতেন। হারামের ভয়াবহতা সম্পর্কে তারা খুবই সচেতন ছিলেন। আবু বকর রা. এর একটি ঘটনা থেকে তাঁর হারাম বর্জন প্রবণতা ও হালালের বিষয়ে কঠোরতা সহজেই অনুমেয়। বর্ণিত আছে যে, আবু বকর রা. এর এক গোলাম ছিল সে তাঁর সঙ্গে কিছু অর্থের বিনিময়ে মুক্তির চুক্তি পত্র করে। অতঃপর সে যখন প্রতিদিন মুক্তিতপনের কিছু অর্থ নিয়ে আসতো, তখন আবু বকর রা. তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, এ অর্থ কিভাবে সংগ্রহ করেছো? যদি সে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারতো, তবেই তিনি তা গ্রহণ ও ব্যবহার করতেন। অন্যথায় ব্যবহার করতেন না। এক রাতে সে আবু বকর রা. এর জন্য কিছু খাবার নিয়ে এলো। সে দিন তিনি রোযা রেখেছিলেন। তাই সেই খাবার সম্পর্কে প্রশ্ন করতে ভুরে যান এবং তা থেকে এক লোকমা খেয়ে ফেলেন। অতঃপর মনে হওয়া মাত্র তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ খাবার তুমি কিভাবে অর্জন করেছ? সে বললোঃ জাহেলিয়াতের আমলে আমি মানুষের ভাগ্য গণনা করতাম। আমি ভাল গণক ছিলাম না। তাই মানুষকে শুধু ধোঁকা দিতাম। এই খাবার সেই ধোঁকার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংগৃহীত। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ সর্বনাশ তুমি আমায় একি করেছ! অতঃপর তিনি গলায় আঙ্গুল দিয়ে ভমি করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সে খাবারের কিছুই বের হয়নি। অতঃপর তিনি পানি পান করে ইচ্ছাকৃত বমির মাধ্যমে পেটের সব খাবার বের করে দিলেন। তিনি আরো বললেনঃ উক্ত খাবার বের করতে গিয়ে আমার মৃত্যুর ঝঁকি থাকত তাহলেও তা বের করে ছাড়তাম। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘যে শরীর হারাম খাদ্য দিয়ে স্বাস্থ্য লাভ করে, তার জন্য জাহান্নাম উপযুক্ত স্থান। তাই আমি ভয় পেয়ে যাই, যে এক লোকমা হারাম খাবার দিয়ে আমার শরীর কিভাবে মোটা-তাজা হতে পারে।’’

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের বক্তব্য

বৈধ পন্থায় উপার্জনের গুরুত্ব উপলব্দি করতঃ তার তাৎপর্য ও পরিণাম বর্ণনা করতে গিয়ে বিদগ্ধ উলামায়ে কিরাম ও মুফাসসিরগণ পান্ডিত্যপূণ উক্তির অবতারনা করেছেন। যেমন: সুফিয়ান সাওরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ ‘‘না জানি তা হারামের অন্তর্ভক্ত হয়ে যায় এ আশংকায় আমরা হালাল সম্পদের দশভাগের নয়ভাগ পরিহার করতাম।’’
দুই. ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ তাওবা করে হালাল উপার্জনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহ এমন কোন মানুষের নামায কবুল করেন না, যার উদরে হারাম খাদ্য রয়েছে।
তিন. ইমাম ওহাব ইবনুল ওয়ারদ (রহ.) বলেনঃ যদি তুমি রাত ভর খুটির ন্যায় ইবাদতে দাড়িয়ে থাক, তবুও তা তোমার কোন কাজে আসবে না! যতক্ষন পর্যন্ত তুমি নিশ্চত হবে যে, তুমি যা খাচ্ছ তা হালাল না হারাম।
চার. সুফিয়ান সাওরী (রহ.) বলেনঃ যে লোক অবৈধ অর্থ দিয়ে কোন নেক কাজ করে, সে পেশাব দিয়ে কাপড় পবিত্র কারীর মত।

উপসংহার:

ইলাম কল্যাণকর এক মহতি জীবন ব্যবস্থা এতে যাবতিয় পবিত্র ও উত্তম বিষয় ও বস্ত্তকে বৈধ করা হয়েছে। কেননা বস্তু মাত্রের মাঝেই কিছু কল্যাণ ও কিছু অকল্যাণের সমাহার রয়েছে। গুনাগুণের বিচারে যে বস্ত্ততে মানুষের জন্য কল্যানকর উপাদানের পরিমাণ বেশী, অকল্যানের পরিমাণ কম, সেই গুলোকেই মহান আল্লাহ মানুষের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। আর যে সকল বস্ত্ততে কল্যান কম অথচ অকল্যানের পরিমাণ বেশী, সেগুলোকে মনুষের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। (যেমন মদ হারাম হওয়ার কারণ কুরআনে বিধৃত হয়েছে) অতএব, আমাদেরক খাওয়া-দাওয়া, পোষাক-আষাক এবং বিভিন্ন দ্রব্য সামগী্রর ব্যবহার, এমনকি যাবতীয় আয় উপার্জনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সেগুলো যেন হালাল ও উত্তম হয়। যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্নক পদার্থ্য দিয়ে তৈরী অথবা যা মানুষের মানবতা বোধকে ধ্বংস করে অথবা যা মানুষের জন্য পাশবিকতার জন্ম দেয় এবং তার সংযমী স্বভাবকে বিনষ্ট করে! কিংবা যা মানুষের আধ্যাতিক ও নৈতিক ক্ষতির (ব্যধি) কারণ হয়, এসকল বস্ত্ত ও উপার্জন মাধ্যম অবশ্যই পরিহার করতে হবে। তাছাড়া যেসব উপায় দম্ভ, অহংকার জন্ম দেয়, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধকে নষ্ট করে, নিষিদ্ধ ভোগ-বিলাসের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে, জুলুম-স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্নকেন্দ্রিকতার জন্ম দেয়, দুশ্চরিত্রের প্রতিধাবিত করে, মুসলমানদেরকে অবশ্যই এসব মাধ্যম বর্জন করতে হবে। আমাদের রুজি-রোজগার যখন এসব থেকে পূতে পবিত্র হবে তখনই তা হালাল ও সিদ্ধ হবে।

[1]. সূরা আল-বাকারাহ: ২৯।
[2]. সূরা জুমআহ: ১০।
[3]. কুরতুবী, আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ, আলজামেউ লি আহকামিল কুরআন, খ.১৮,পৃ.৯৬।
[4]. সূরা জুমআহ: ৯।
[5]. সূরা মুয়যাম্মিল: ২০।
[6]. আবুল দিদা ইসমইল ইবন উমর ইবন কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, সম্পাদনায়: সামী ইবন মুহাম্মদ সাল্লামা, বৈরুত: দারু তাইবা নিন্ন্যাসরী, দিত্বীয় সংস্করণ, ১৪২০ হি, খ. ৮, পৃ. ২৫৮।
[7]. ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম. হাদীস নং. (১০৪২)।
[8]. ইমাম বুখারী, আলজামে‘উসসাহীহ, হাদীস নং ১৪৭৪; ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম. হাদীস নং. ১০৪০।
[9]. ইমাম আহমাদ, মুসনাদ, খ.৪, পৃ. ১৪১.
[10]. ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম পেশা হলো: অপ্রয়োজনে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ, বেশ্যাবৃত্তি, নৃত্য ও যেনৈশিল্প, অবৈধ ব্যবসা-বানিজ্য যেমন, মুর্তি, অবৈধ পাণীয়, ভাষ্কর্য ও প্রতিকৃতি নির্মান শিল্প, সুফী কারবার, ওজনে কম দেয়া, ধোঁকা ও প্রতারণামূলক ব্যবসা, মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, ও চাকুরী হতে অবৈধ উপার্জন যেমন ঘুষ গ্রহণ।
[11]. আবূ বকর আহমদ ইবনুল হুসাইন আল-বায়হাকী, সুনান আল-বায়হাকী, সম্পাদনায়: আব্দুল কাদির আতা (মক্কা আল-মুকাররমা: মাকতাবাতু দারুল বায, ১৪১৪ হি/১৯৯৪ খ্রী.) খ. ৬, পৃ. ১২৮। ইমাম বায়হাকী বলেন, এর রাবী দুর্বল।
[12]. সূরা আল-বাকারা: ২৭৫।
[13]. গাযালী, ইহইয়াউ উলুমুদ্দীন, (মাকতবাতুল মুস্তফা আল বাবী ওয়াল হালবী) খ. ২, পৃ. ৬৪। ইমাম ‘ইরাকী বলেন: মুরসাল
[14]. ইমাম তিরমিযী, জামে’ আত্-তিরমিযী, হাদীস নং- ১২০৯। তবে আল্লামা আলবানী এটাকে দুর্বল বলেছেন।
[15]. ইমাম বুখারী, সহীহ, হাদীস নং ৮৯৩ ; ইমাম মুসলিম, সহীহ, হাদীস নং ১৮২৯।
[16]. ঘুষ গ্রহীতা ও দাতা উভয়ের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي ‘‘ঘুষ দাতা ও গ্রহীতাকে আল্লাহ্‌র রাসূল লা‘নত করেছেন।” [ইমাম তিরমিযী, সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ১৩৩৭; ইমাম আবু দাউদ, আসসুনান, ৩৫৮০] জুলুম, স্বজনপ্রীতি সংক্রান্ত হাদীস আসবে।
[17]. ইসলামী বিশ্বকোষ, (ঢাকা: ই. ফা. বা. তা. বি.) খ. ১, পৃ. ২৪৩; ইবন খালদুন, মুবাদ্দমা, (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১ম প্রকাশ, ১৯৮১) খ. ২, পৃ. ৭-৮।
[18]. আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿فَلۡيَنظُرِ ٱلۡإِنسَٰنُ إِلَىٰ طَعَامِهِۦٓ ٢٤ أَنَّا صَبَبۡنَا ٱلۡمَآءَ صَبّٗا ٢٥ ثُمَّ شَقَقۡنَا ٱلۡأَرۡضَ شَقّٗا ٢٦ فَأَنۢبَتۡنَا فِيهَا حَبّٗا ٢٧ وَعِنَبٗا وَقَضۡبٗا ٢٨ وَزَيۡتُونٗا وَنَخۡلٗا ٢٩ وَحَدَآئِقَ غُلۡبٗا ٣٠ وَفَٰكِهَةٗ وَأَبّٗا ٣١ مَّتَٰعٗا لَّكُمۡ وَلِأَنۡعَٰمِكُمۡ﴾
  সূরা আবাসা: ২৪-৩২।)
[19]. ইমাম বুখারী, সহীহ আল বুখারী, হাদীস নং – ২৩৪০।
[20]. কেউ এক খন্ড জমি অন্যায়ভাবে অধিকারে নিলে কিয়ামতের দিন ঐ জমির সাত স্তবক পর্যন্ত তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। নবী (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তির উপর আল্লাহ অভিসম্পাত করেন। তাদের একজন হলো যে জমির আইল বা সীমানা পরিবর্তন করে ফেলে। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, আল-মুসনাদ (মিসর: মুয়াসসাতুল কুরতবা, তা. বি) খ. ৪, পৃ. ১০৩।
[21]. মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ইসলামের অর্থনীতি, (ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৮৭) পৃ. ১৫৮-১৫৯।
[22]. রাসূল (সা.) বলেছেন, মাদক দ্রব্য উৎপাদনকারী, যে উৎপাদন করার, মদ্যপায়ী, বহনকারী, যার কাছে বহন কলে নেয়া হয়, যে পান করায়- পরিবেশনকারী, বিক্রয়কারী, মূল্য গ্রহণ ও ভক্ষনকারী এবং যার জন্য তা ক্রয় করা হয় । এ সকলের উপরই অভিশাপ। (আবূ দাউদ সুলাইমান ইবনুল আণআম আস-সিজিস্তানী। সুনান, সম্পাদনা: মহিউদ্দীন আবদুল হামিদ ) বৈরুত দারুল ফিকর, তা.বি) খ. ৩ পৃ. ২৪৪।
[23]. আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রুপায়ন (ঢাকা: কওমী পাবলিকেশন্স ১ম সংস্করণ ১৪০৮ হি:/ ২০০১ খ্রী:) পৃ. ১৭৯।
[24]. সূরা আল-আম্বিয়া: ৮০।
[25]. সূরা আল-বাকারা: 168।
[26]. সূরা নিসা:২৯।
[27].  সূরা আল-বাকারাহ্: ১৮৮।
[28]. ইমাম বুখারী, আস-সাহীহ, হাদীস নং ২০৫৯।
[29].  আবু দাউদ, সুনান, হাদীস নং ১৪৭৯।
[30]. ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১০১৫।
[31].  ইমাম তাবারানী, মু‘জামুল আওসাত, খ. ৬, পৃ. ৩১০
[32]. তাবারানী।
[33]. আবু ইয়া‘লা, মুসনাদ আবী ইয়া‘লা, খ.১ পৃ. ৮৪।
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক' 
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে 
আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

Thursday, August 15, 2019

বিদ‘আতীদের সাথে ওঠাবসা বর্জন করা আহলুস সুন্নাহ’র একটি অন্যতম মূলনীতি



▌বিদ‘আতীদের সাথে ওঠাবসা বর্জন করা আহলুস সুন্নাহ’র একটি অন্যতম মূলনীতি

·
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর:

আমাদের অগ্রবর্তী ন্যায়নিষ্ঠ ইমামদের সর্বজনগৃহীত একটি নীতি ছিল—বিদ‘আতীদের সাথে কেউ যেন ওঠাবসা বা চলাফেরা বা মেলামেশা না করে। এটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের একটি অন্যতম মূলনীতি। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের শ্রদ্ধেয় ইমাম, শাইখুল ইসলাম, হাফিয আবূ ‘আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪১ হি.] আহলুস সুন্নাহ’র মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,

أصول السنة عندنا : ترك الخصومات والجلوس مع أصحاب الأهواء.

“আমাদের নিকট সুন্নাহ’র মূলনীতি হচ্ছে, বিদ‘আতীদের সাথে তর্কবিতর্ক এবং (তাদের সাথে) ওঠাবসা বর্জন করা।” [ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ), উসূলুস সুন্নাহ; পৃষ্ঠা: ৩; তারিখ ও প্রকাশনার বিহীন; ইমাম আল-লালাকাঈ (রাহিমাহুল্লাহ), শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ৩১৭; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৪৮; দারুল বাসীরাহ, আলেকজান্দ্রিয়া কর্তৃক প্রকাশিত; সন-তারিখ বিহীন]

·
এই মূলনীতি গৃহীত হয়েছে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবীবর্গ এবং তাঁদের পরবর্তী অনুসারীগণ কর্তৃক অবলম্বিত মানহাজ থেকে।

আম্মিজান ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) [মৃত: ৫৮ হি.] থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “এক ব্যক্তি নাবী ﷺ এর নিকট প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি লোকটিকে দেখে বললেন, ‘সে সমাজের নিকৃষ্ট লোক এবং সমাজের দুষ্ট সন্তান।’ এরপর সে যখন এসে বসল, তখন নাবী ﷺ আনন্দ সহকারে তার সাথে মেলামেশা করলেন। লোকটি চলে গেলে ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, যখন আপনি লোকটিকে দেখলেন তখন তার ব্যাপারে এমন বললেন, পরে তার সাথেই আপনি আনন্দচিত্তে সাক্ষাৎ করলেন।’ তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “হে ‘আইশাহ, তুমি কখনো আমাকে অশালীন দেখেছ? কেয়ামতের দিন আল্লাহ’র কাছে মর্যাদার দিক দিয়ে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি, যার দুষ্টামির কারণে মানুষ তাকে ত্যাগ করে।” [সাহীহ বুখারী, হা/৬০৩২; সাহীহ মুসলিম, হা/২৫৯১]

·
প্রখ্যাত তাবি‘ঈ, মাদীনাহ’র শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ ও মুফতী, ইমাম সুলাইমান বিন ইয়াসার (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১০৭ হি.] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “বানূ তামীম গোত্রে সাবীগ বিন ‘ইসল নামে এক ব্যক্তি ছিল। একবার সে মাদীনাহ’য় আগমন করে। তার কাছে বেশ কিছু গ্রন্থ ছিল। সে লোকদেরকে কুরআনের মুতাশাবিহ তথা দ্ব্যর্থবোধক আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করছিল। ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি তাকে ডেকে পাঠান। আর তার জন্য তিনি খেজুর গাছের (কাঁদির) অনেকগুলো শুকনো দণ্ড প্রস্তুত করেন। সে যখন তাঁর নিকটে প্রবেশ করে আসন গ্রহণ করে, তখন তিনি বলেন, ‘তুমি কে?’ সে বলে, ‘আমি আল্লাহ’র গোলাম সাবীগ।’ ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, ‘আর আমি হলাম আল্লাহ’র গোলাম ‘উমার।’ এই বলে তিনি তার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ওই প্রস্তুতকৃত শুকনো খর্জূর দণ্ডগুলো দিয়ে পিটাতে লাগলেন। তিনি তাকে মারতেই থাকলেন, এমনকি মারতে মারতে তার মাথা ফাটিয়ে দিলেন, আর ওই ব্যক্তির মুখ থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল। সে বলল, ‘আমীরুল মু’মিনীন, যথেষ্ট হয়েছে। আল্লাহ’র কসম, আমার মাথায় যা (ভ্রান্ত বিশ্বাস) ছিল তা উধাও হয়ে গেছে’।” [ইমাম আল-লালাকাঈ (রাহিমাহুল্লাহ), শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ১১৩৮; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫৬০; দারুল বাসীরাহ, আলেকজান্দ্রিয়া কর্তৃক প্রকাশিত; সন-তারিখ বিহীন]

ইবনু যুর‘আহ (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “আমি সাবীগ বিন ‘ইসলকে বসরায় দেখেছি। সে যেন খোস-পাঁচড়ায় আক্রান্ত এক উট, সে (লোকদের) বৈঠকগুলোতে যেত। যখনই সে কোনো বৈঠকে বসত, তখনই ওই বৈঠকের লোকেরা উঠে চলে যেত এবং তাকে বর্জন করত। সে যদি এমন সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে বসত যারা তাকে চিনে না, তাহলে অপর বৈঠকের লোকেরা তাদের ডাক দিয়ে বলত, আমীরুল মু’মিনীনের কড়া নির্দেশ আছে (অর্থাৎ, ওই লোককে পরিত্যাগ করো)।” [প্রাগুক্ত; আসার নং: ১১৪০; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫৬১]

·
প্রখ্যাত সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৩২ হি.] বলেছেন,

من أحب أن يكرم دينه فليعتزل مجالسة أصحاب الأهواء، فإن مجالستهم ألصق من الجرب.

“যে ব্যক্তি স্বীয় দ্বীনকে সম্মান করতে পছন্দ করে, সে যেন বিদ‘আতীদের সংস্রব বর্জন করে। কেননা বিদ‘আতীদের সংস্রব খোস-পাঁচড়ার চেয়েও অধিক সংক্রামক।” [ইমাম ইবনু ওয়াদ্বদ্বাহ (রাহিমাহুল্লাহ), আল-বিদা‘উ ওয়ান নাহয়ু ‘আনহা; আসার নং: ১৩১; পৃষ্ঠা: ৯৬; মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়্যাহ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৯ হি./২০০৮ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]

যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] বলেছেন,

لا تجالس أهل الأهواء فإن مجالستهم ممرضة للقلوب.

“তুমি বিদ‘আতীদের সাথে ওঠাবসা কোরো না। কেননা তাদের সাথে ওঠাবসা অন্তরে রোগ সৃষ্টি করে।” [ইমাম ইবনু বাত্বত্বাহ (রাহিমাহুল্লাহ), আল-ইবানাহ; আসার নং: ৩৭১]

·
প্রখ্যাত তাবি‘ তাবি‘ঈ, আহলুস সুন্নাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘আলিম, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ফুদ্বাইল বিন ‘ইয়াদ্ব (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৮৭ হি.] বলেছেন,

لا تجلس مع صاحب بدعة، فإني أخاف أن ينزل عليك اللعنة.

“তুমি বিদ‘আতীর সাথে ওঠাবসা কোরো না। কেননা আমি আশঙ্কা করছি যে, তোমার উপর লা‘নাত বর্ষণ করা হবে।” [ইমাম ইবনু বাত্বত্বাহ (রাহিমাহুল্লাহ), আল-ইবানাহ; আসার নং: ৪৪১; ইমাম আল-লালাকাঈ (রাহিমাহুল্লাহ), শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ২৬২]

ইমাম ফুদ্বাইল বিন ‘ইয়াদ্ব (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৮৭ হি.] আরও বলেছেন,

ومن جلس مع صاحب بدعة فاحذره، ومن جلس مع صاحب البدعة لم يعط الحكمة، وأحب أن يكون بيني وبين صاحب بدعة حصن من حديد، آكل مع اليهودي والنصراني أحب إلي من أن آكل عند صاحب بدعة.

“যে ব্যক্তি বিদ‘আতীর সাথে বসে, সে ব্যক্তি থেকে সাবধান থাক। যে ব্যক্তি কোনো বিদ‘আতীর সাথে বসে, তাকে হিকমাহ (প্রজ্ঞা) দেওয়া হয় না। আমি তো এটা পছন্দ করি যে, আমার ও বিদ‘আতীর মধ্যে একটি লোহার কেল্লা (স্থাপিত) হবে। কোনো বিদ‘আতীর নিকট খাওয়া অপেক্ষা কোনো ইহুদি বা খ্রিষ্টানের নিকট খাওয়া আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়।” [আবূ নু‘আইম (রাহিমাহুল্লাহ), হিলইয়াতুল আউলিয়া; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১০৩; ইমাম আল লালাকাঈ (রাহিমাহুল্লাহ), শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ১১৪৯ (শব্দগুচ্ছ লালাকাঈ’র)]

·
শাইখুল ইসলাম, হাফিয আবূ নু‘আইম ফাদ্বল বিন ‘আমর আত তাইমী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২১৮ হি.] বলেছেন,

دخل الثوري يوم الجمعة فإذا الحسن بن صالح بن حي يصلي، فقال: نعوذ بالله من خشوع النفاق وأخذ بنعليه فتحول.

“এক জুমু‘আহর দিন সুফইয়ান সাওরী [মৃত: ১৬১ হি.] মাসজিদে প্রবেশ করলেন। সে সময় (বিদ‘আতী) হাসান বিন সালিহ বিন হাই সালাত পড়ছিল। (তা দেখে) তিনি বললেন, ‘আমরা আল্লাহ’র কাছে মুনাফিক্বের বিনয়নম্রতা থেকে পানাহ চাচ্ছি।’ তারপর তিনি তাঁর জুতো নিয়ে ফিরে গেলেন।” [তাহযীবুল কামাল; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৮০; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৩৬৩]

·
প্রখ্যাত তাবি‘ তাবি‘ঈ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আওযা‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৫৭ হি.] কে বলা হলো,

إن رجلاً يقول: أنا أجالس أهل السنة وأجالس أهل البدع، فقال الأوزاعي: هذا رجل يريد أن يساوي بين الحق والباطل.

“এক ব্যক্তি বলছে, ‘আমি আহলুস সুন্নাহ’র সাথেও ওঠাবসা করি, আবার বিদ‘আতীদের সাথেও ওঠাবসা করি।’ তখন আওযা‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বললেন, ‘এই লোক হক এবং বাতিলকে সমান করতে চাচ্ছে’।” [আল-ইবানাহ; আসার নং: ৪৩০]

এই আসারটি বর্ণনা করার পর ইমাম ইবনু বাত্বত্বাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৩৮৭ হি.] বলেছেন, “আওযা‘ঈ সত্যই বলেছেন। আমি বলছি, এই ব্যক্তি হক ও বাতিলের এবং ঈমান ও কুফরের পার্থক্য সম্পর্কে অবগত নয়। এ ধরনের লোকদের ব্যাপারেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং নাবী ﷺ থেকে সুন্নাহ বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَىٰ شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ “যখন তারা মু’মিনদের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’; আর যখন তারা নিভৃতে তাদের শয়তানদের (সর্দারদের) সঙ্গে মিলিত হয়, তখন বলে, ‘আমরা তো তোমাদের সাথেই আছি’।” (সূরাহ বাক্বারাহ: ১৪)” [আল-ইবানাহ; আসার নং: ৪৩০ – এর টীকা]

·
❏ বিদ‘আতীদের সাথে মেলামেশার কুফল:

ইমাম ইয়া‘কূব বিন শাইবাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৬২ হি.] বলেছেন, “বানূ সাদওয়াস গোত্রে ‘ইমরান বিন হিত্বত্বান নামে এক ব্যক্তি ছিল। সে নাবী ﷺ এর একদল সাহাবীকে পেয়েছিল। এতৎসত্ত্বেও সে খারিজী মতবাদে দীক্ষিত হয়েছিল। এর কারণ সম্পর্কে আমাদের কাছে যে সংবাদ পৌঁছেছে তা হলো, তার এক চাচাতো বোন ছিল, যে খারিজী মতাদর্শ লালন করত। ‘ইমরান সেই মেয়েকে বিয়ে করে, তাকে তার ভ্রান্ত মতাদর্শ থেকে ফেরানোর জন্য। কিন্তু ওই মেয়েই তাকে নিজের মতাদর্শে দীক্ষিত করে ফেলে।” [তারীখু দিমাশক্ব; খণ্ড: ৪৩; পৃষ্ঠা: ৪৯০; তাহযীবুল কামাল; খণ্ড: ২২; পৃষ্ঠা: ৩২৩; গৃহীত: শাইখ জামাল বিন ফুরাইহান আল-হারিসী (হাফিযাহুল্লাহ), লাম্মুদ দুর্রিল মানসূর মিনাল ক্বাওলিল মা’সূর ফিল ই‘তিক্বাদি ওয়াস সুন্নাহ; পৃষ্ঠা: ১৮৮; দারুল মিনহাজ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৫ হিজরী (১ম প্রকাশ)]

পরবর্তীতে এই খারিজী ‘ইমরান বিন হিত্বত্বান ইসলামের চতুর্থ খলিফা ‘আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র হত্যাকারী ‘আব্দুর রহমান বিন মুলজিম আল-খারিজী’র প্রশংসা করে দীর্ঘ কবিতা রচনা করে। আল্লাহ’র কাছে যাবতীয় বিদ‘আত ও তার বাহকদের সংস্পর্শ থেকে পানাহ চাচ্ছি।

·
ভারতবর্ষের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুহাদ্দিস, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম ‘উবাইদুল্লাহ বিন ‘আব্দুস সালাম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪১৪ হি./১৯৯৪ খ্রি.] বলেছেন, “এই সাদৃশ্য স্থাপনের মধ্যে বেশ কিছু জ্ঞাতব্য বিষয় রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এ সকল বিদ‘আত এবং তা পালনকারী বিদ‘আতীদের নিকটবর্তী হওয়া থেকে সতর্ক থাকা। যেহেতু জলাতঙ্ক রোগ সংক্রামক ব্যাধির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর জলাতঙ্ক রোগের উৎস রয়েছে কুকুরের মধ্যে। সেই কুকুর যখন কাউকে কামড় দেয়, তখন সেও তার মতোই (ব্যাধি বহনকারী) হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে এই রোগ থেকে না মরে নিস্তার পায় না। একইভাবে একজন বিদ‘আতী যখন কারও কাছে নিজের (ভ্রান্ত) মতাদর্শ এবং সংশয় পরিবেশন করে, তখন খুব কম সময়ই সে ওই (বিদ‘আতীর) দুর্যোগ থেকে নিস্তার পায়। বরং (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই) হয় সে ওই বিদ‘আতীর সাথে তার (সংশয়পূর্ণ) মতাদর্শে পতিত হয় এবং তার দলেরই একজন সদস্য বনে যায়। নতুবা ওই বিদ‘আতী এই ব্যক্তির অন্তরে সংশয় প্রোথিত করে; যা থেকে সে বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু সক্ষম হয় না।

এটা পাপাচারিতার বিপরীত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাপচারী ব্যক্তি তার সাথের ব্যক্তিটির অনিষ্ট করে না এবং স্বীয় পাপাচারিতায় তাকে প্রবিষ্ট করে না। তবে তার সাথে দীর্ঘ সময়ের ঘনিষ্ঠতা ও মেলামেশা থাকলে এবং তার পাপকাজে বারবার উপস্থিত হলে ভিন্ন কথা। (সালাফদের থেকে বর্ণিত) আসারসমূহে যে বর্ণনা এসেছে তা এই ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে। কেননা ন্যায়নিষ্ঠ সালাফগণ তাদের (বিদ‘আতীদের) সাথে ওঠাবসা করতে ও তাদের সাথে কথাবার্তা বলতে নিষেধ করেছেন, এবং বিদ‘আতীদের সাথে যারা কথা বলে তাদের সাথেও কথা বলতে নিষেধ করেছেন। আর এ ব্যাপারে তাঁরা কঠোরতা অবলম্বন করেছেন।” [ইমাম ‘উবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ), মির‘আতুল মাফাতীহ শারহে মিশকাতুল মাসাবীহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৭৮; গৃহীত: শাইখ খালিদ আয-যাফীরী (হাফিযাহুল্লাহ), ইজমা‘উল ‘উলামা ‘আলাল হাজরি ওয়াত তাহযীরি মিন আহলিল আহওয়া; পৃষ্ঠা: ১০২-১০৩; মাকতাবাতুল আসালাতিল আসারিয়্যাহ, জেদ্দা কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৩ হি./২০০২ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]

·
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, বিদ‘আতীদের সাথে ওঠাবসা বর্জন করা আহলুস সুন্নাহ’র একটি মহান মূলনীতি। তাই আমরা আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে উক্ত মূলনীতিটি হেফাজত করার মাধ্যমে সালাফী মানহাজের প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তাওফীক্ব দান করেন। আমীন, ইয়া রাব্বাল ‘আলামীন।

·
অনুবাদ ও সংকলনে: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/SunniSalafiAthari

বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া এবং তাদের লেকচার ক্লিপস শোনার বিধান



▌বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া এবং তাদের লেকচার ক্লিপস শোনার বিধান

·
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর:

অনেক অজ্ঞ ও ধোঁকাগ্রস্ত সালাফী বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়েন এবং তাদের লেকচার ক্লিপস শোনেন। আমি মনে করি, তাঁরা এই কাজের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারেননি এবং এই বিপজ্জনক কর্মের ব্যাপারে সালাফদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেননি। কিছু ভাই আবার ইবলিসী ধোঁকায় পতিত হওয়ার কারণে মনে করেন—‘আমি তো আর বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়ে এবং তাদের লেকচার ক্লিপস শুনে সব কথা গ্রহণ করছি না, আমি স্রেফ হকটাই নিচ্ছি, আর বাতিলটা বর্জন করছি!’ তাই এই বিপজ্জনক কর্মের ব্যাপারে সালাফ ও খালাফদের মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ বিদ্বানদের বক্তব্য পেশ করা জরুরি মনে করছি। আর উপরিউক্ত ভ্রান্ত ধারণার ব্যাপারে সামনে আলোচনা আসবে, ইনশাআল্লাহ।

·
আমাদের সবসময় মনে রাখা উচিত যে, ‘ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের জন্য আল্লাহ’র কিতাব, রাসূলের ﷺ সুন্নাহ এবং সালাফদের সমঝই যথেষ্ট। ১২শ হিজরী শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন ‘আব্দুল ওয়াহহাবের সুযোগ্য পৌত্র ইমাম ‘আব্দুর রাহমান বিন হাসান আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১২৮৫ হি./১৮৬৯ খ্রি.] বলেছেন,

ومن له نهمة في طلب الأدلة على الحق، ففي كتاب الله، وسنّة رسوله، ما يكفي ويشفي؛ وهما سلاح كل موحد ومثبت، لكن كتب أهل السنّة تزيد الراغب وتعينه على الفهم وعندكم من مصنفات شيخنا -رحمه الله- ما يكفي مع التأمل؛ فيجب عليكم هجر أهل البدع، والإنكار عليهم.

“হকের দলিল অন্বেষণে যার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে, তার জন্য আল্লাহ’র কিতাব ও রাসূলের ﷺ সুন্নাহতেই যথেষ্ট ও সন্তোষজনক উপাদান রয়েছে। এই দুটি বস্তু (কিতাব ও সুন্নাহ) প্রত্যেক তাওহীদবাদী ও জ্ঞানীর অস্ত্র। কিন্তু আহলুস সুন্নাহ’র গ্রন্থসমূহ আগ্রহী ব্যক্তিকে পাথেয় যোগায় এবং (কিতাব ও সুন্নাহ) বুঝতে সাহায্য করে। তোমাদের কাছে আমাদের শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ)’র গ্রন্থসমূহ রয়েছে, যা গবেষণার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং তোমাদের জন্য বিদ‘আতীদের বর্জন করা এবং তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক।” [আদ-দুরারুস সানিয়্যাহ, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২১১; গৃহীত: শাইখ খালিদ বিন দ্বাহউয়ী আয-যাফীরী (হাফিযাহুল্লাহ), ইজমা‘উল ‘উলামা ‘আলাল হাজরি ওয়াত তাহযীরি মিন আহলিল আহওয়া; পৃষ্ঠা: ৬৫; মাকতাবাতুল আসালাতিল আসারিয়্যাহ, জেদ্দা কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৩ হি./২০০২ খ্রি. (৩য় প্রকাশ)]

·
স্বয়ং রাসূল ﷺ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বইপুস্তক পড়া থেকে সতর্ক করেছেন, অথচ সেগুলো বিলকুল হকমুক্ত নয়। জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,

أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ أَتى رَسُولَ اللهِ ﷺ بِنُسْخَةٍ مِنْ التَّوْرَاةِ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ هَذِهِ نُسْخَةٌ مِنْ التَّوْرَاةِ فَسَكَتَ فَجَعَلَ يَقْرَأُ وَوَجْهُ رَسُولِ اللهِ يَتَغَيَّرُ فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ ثَكِلَتْكَ الثَّوَاكِلُ مَا تَرَى مَا بِوَجْهِ رَسُولِ اللهِ ﷺ فَنَظَرَ عُمَرُ إِلى وَجْهِ رَسُولِ اللهِ ﷺ فَقَالَ أَعُوذُ بِاللهِ مِنْ غَضَبِ اللهِ وَغَضَبِ رَسُولِه رَضِينَا بِاللهِ رَبًّا وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِه لَوْ بَدَا لَكُمْ مُوسى فَاتَّبَعْتُمُوهُ وَتَرَكْتُمُونِي لَضَلَلْتُمْ عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ وَلَوْ كَانَ حَيًّا وَأَدْرَكَ نُبُوَّتِي لَاتَّبَعَنِي.

“একদা ‘উমার ইবনুল খাত্বত্বাব (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে তাওরাত কিতাবের একটি পাণ্ডুলিপি এনে বললেন, ‘হে আল্লাহ’র রাসূল! এটা হলো তাওরাতের একটি পাণ্ডুলিপি।’ রাসূলুল্লাহ ﷺ চুপ থাকলেন। এরপর ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) তাওরাত পড়তে আরম্ভ করলেন। (এদিকে রাগে) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মুখমণ্ডল বিবর্ণ হতে লাগল। আবূ বাকর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন, ‘উমার, তোমার সর্বনাশ হোক। তুমি কি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিবর্ণ মুখমণ্ডল দেখছ না? ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) রাসূলের চেহারার দিকে তাকালেন এবং (চেহারায় ক্রোধান্বিত ভাব লক্ষ করে) বললেন, ‘আমি আল্লাহ’র শাস্তি ও তাঁর রাসূলের ক্রোধ হতে পানাহ চাচ্ছি। আমি ‘রব’ হিসেবে আল্লাহ তা‘আলার ওপর, দ্বীন হিসেবে ইসলামের ওপর এবং নাবী হিসেবে মুহাম্মাদ ﷺ এর ওপর সন্তুষ্ট আছি।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “আল্লাহ’র কসম, যার হাতে আমার জীবন! যদি (তাওরাতের নাবী স্বয়ং) মূসা (‘আলাইহিস সালাম) তোমাদের মধ্যে থাকতেন, আর তোমরা তাঁর অনুসরণ করতে এবং আমাকে ত্যাগ করতে, তাহলে তোমরা সঠিক সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে। মূসা (‘আলাইহিস সালাম) যদি এখন জীবিত থাকতেন এবং আমার নুবুওয়্যাতের যুগ পেতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবে তিনিও আমার অনুসরণ করতেন।” [দারিমী, হা/৪৪৯; মিশকাত, হা/১৯৪; সনদ: হাসান]

·
এমনকি কতিপয় ইমাম বিদ‘আতীদের বইপুস্তক না পড়ার উপর ইজমা‘ নক্বল (বর্ণনা) করেছেন। তাঁরা বলেননি যে, তোমরা বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়ে এবং তাদের কথাবার্তা শুনে তা থেকে হকটা গ্রহণ করো, আর বাতিলটা বর্জন করো।

ইমাম ইবনু খুযাইমাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৩১১ হি.] কে আল্লাহ’র নাম ও গুণাবলির সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,

 بدعة ابتدعوها، لم يكن أئمة المسلمين وأرباب المذاهب وأئمة الدين، مثل مالك، وسفيان، والأوزاعي، والشافعي، وأحمد، وإسحـاق، ويحيى بن يحيى، وابن المبارك، ومحمد بن يحيى، وأبي حنيفة، ومحمد بن الحسن، وأبي يوسف: يتكلمون في ذلك، وينهون عن الخوض فيه، ويدلّون أصحابهم على الكتاب والسنّة، فإياك والخوض فيه والنظر في كتبهم بحال.

“এটি একটি নবআবিষ্কৃত বিষয় (বিদ‘আত), যা তারা আবিষ্কার করেছে। মুসলিমদের ইমামগণ, মাযহাবসমূহের প্রধানগণ ও দ্বীনের ইমামগণ যেমন: মালিক, সুফইয়ান, আওযা‘ঈ, শাফি‘ঈ, আহমাদ, ইসহাক্ব, ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া, ইবনুল মুবারাক, মুহাম্মাদ বিন ইয়াহইয়া, আবূ হানীফাহ, মুহাম্মাদ বিন হাসান, আবূ ইউসুফ প্রমুখ এই বিষয়ে সমালোচনা করেননি। তাঁরা এ ব্যাপারে নিরর্থক কথাবার্তা বলা থেকে নিষেধ করেছেন এবং তাঁদের সাথীদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ’র দিকে পথনির্দেশ করেছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে নিরর্থক কথাবার্তা থেকে দূরে থাক এবং সাথে সাথে তাদের বইপুস্তক পড়া থেকেও দূরে থাক।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), আল-ইস্তিক্বামাহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১০৮; গৃহীত: ইজমা‘উল ‘উলামা ‘আলাল হাজরি ওয়াত তাহযীরি মিন আহলিল আহওয়া; পৃষ্ঠা: ৬৫-৬৬]

ইমাম আবূ মানসূর মা‘মার বিন আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৪১৮ হি.] বলেছেন,

ثم من السنة: ترك الرأي والقياس في الدين، وترك الجدال والخصومات، وترك مفاتحة القدرية وأصحاب الكلام وترك النظر في كتب الكلام وكتب النجوم، فهذه السنة التي اجتمعت عليها الأمة.

“অতঃপর সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে দ্বীনের ক্ষেত্রে রায় ও ক্বিয়াস বর্জন করা, তর্কবিতর্ক পরিত্যাগ করা, ক্বাদারিয়্যাহ ও যুক্তিবিদ সম্প্রদায়ের মতবাদের আলোচনার শুরু না করা এবং কালামশাস্ত্র (তর্কশাস্ত্র) ও জ্যোতিষশাস্ত্রের বইপুস্তক পাঠ বর্জন করা। এটি এমন সুন্নাহ, যে ব্যাপারে উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।” [ইমাম আবুল ক্বাসিম আল-আসবাহানী (রাহিমাহুল্লাহ), আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৪২; গৃহীত: ইজমা‘উল ‘উলামা ‘আলাল হাজরি ওয়াত তাহযীরি মিন আহলিল আহওয়া; পৃষ্ঠা: ৬৬]

·
এতদ্ব্যতীত ইসলামের ইমামগণ বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া ও তাদের কথাবার্তা শোনা বর্জন করাকে সুন্নাহ’র মূলনীতি সাব্যস্ত করেছেন এবং এহেন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নসিহত করেছেন। শাইখুল ইসলাম ইমাম মুওয়াফফাক্বুদ দীন ইবনু ক্বুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,

ومن السنة هجران أهل البدع ومباينتهم وترك الجدال والخصومات في الدين، وترك النظر في كتب المبتدعة، والإصغاء إلى كلامهم، وكل محدثة في الدين بدعة.

“সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বিদ‘আতীদের বর্জন করা, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, দ্বীনের ব্যাপারে তর্কবিতর্ক পরিত্যাগ করা এবং বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া ও তাদের কথা শোনা বাদ দেওয়া। আর দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক নবআবিষ্কৃত বিষয়ই হল বিদ‘আত।” [ইমাম ইবনু ক্বুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ), লুম‘আতুল ই‘তিক্বাদ; পৃষ্ঠা: ৩৩; গৃহীত: ইজমা‘উল ‘উলামা ‘আলাল হাজরি ওয়াত তাহযীরি মিন আহলিল আহওয়া; পৃষ্ঠা: ৭৪]

ইমাম ইবনু মুফলিহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৮৮৪ হি.] বলেছেন,

ذكر الشيخ موفق الدين –رحمه الله– في المنع من النظر في كتب المبتدعة، قال: كان السلف ينهون عن مجالسة أهل البدع، والنظر في كتبهم والإستماع لكلامهم.

“শাইখ মুওয়াফফাক্বুদ দীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পাঠের নিষিদ্ধতা প্রসঙ্গে বলেছেন, সালাফগণ বিদ‘আতীদের সাথে ওঠাবসা করতে, তাদের বইপুস্তক পড়তে এবং তাদের কথাবার্তা শুনতে নিষেধ করতেন।” [আল-আদাবুশ শারী‘আহ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৩২; গৃহীত: ইজমা‘উল ‘উলামা ‘আলাল হাজরি ওয়াত তাহযীরি মিন আহলিল আহওয়া; পৃষ্ঠা: ৭৪-৭৫]

·
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] যখন এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন যে, “প্রত্যেক যে বিষয় আল্লাহ’র অবাধ্যতায় উদ্বুদ্ধ করে এবং আল্লাহ’র আনুগত্য থেকে নিষেধ করে, সেটাই আল্লাহ’র অবাধ্যতার শামিল”, তখন তিনি বলেছেন,

ومن هذا الباب سماع كلام أهل البدع، والنظر في كتبهم لمن يضره ذلك ويدعوه إلى سبيلهم وإلى معصية الله.

“এই বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ওই ব্যক্তি কর্তৃক বিদ‘আতীদের কথাবার্তা শ্রবণ এবং তাদের বইপুস্তক পঠন, যা (শ্রবণ ও পঠন) তার ক্ষতি করে এবং তাকে তাদের (বিদ‘আতীদের) পথের দিকে ও আল্লাহ’র অবাধ্যতার দিকে আহ্বান করে।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ৩৩৬; গৃহীত: ইজমা‘উল ‘উলামা ‘আলাল হাজরি ওয়াত তাহযীরি মিন আহলিল আহওয়া; পৃষ্ঠা: ৭৪-৭৫]

ভারতবর্ষের প্রখ্যাত মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম সিদ্দীক্ব হাসান খান ভূপালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩০৭ হি./১৮৯০ খ্রি.] বলেছেন,

ومن السنة هجران أهل البدع ومباينتهم وترك الجدال والخصومات في الدين، وكل محدثة في الدين بدعة، وترك النظر في كتب المبتدعة، والإصغاء إلى كلامهم في أصول الدين وفروعه، كالرافضة والخوارج والجهمية والقدرية والمرجئة والكرامية والمعتزلة، فهذه فرق الضلالة وطرائق البدع.

“সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বিদ‘আতীদের বর্জন করা, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, দ্বীনের ব্যাপারে তর্কবিতর্ক পরিত্যাগ করা; আর দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক নবআবিষ্কৃত বিষয়ই হলো বিদ‘আত। এছাড়াও বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া এবং দ্বীনের মৌলিক ও শাখাগত বিষয়ে তাদের কথাবার্তা শোনা বাদ দেওয়া সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত। যেমন: রাফিদ্বী সম্প্রদায়, খারিজী সম্প্রদায়, জাহমী সম্প্রদায়, ক্বাদারী সম্প্রদায়, মুরজিয়া সম্প্রদায়, কাররামী সম্প্রদায়, মু‘তাযিলী সম্প্রদায়; এগুলো পথভ্রষ্ট ফিরক্বাহ এবং বিদ‘আতী ত্বরীক্বাহ।” [ইমাম সিদ্দীক্ব হাসান (রাহিমাহুল্লাহ), ক্বাতফুস সামার ফী ‘আক্বীদাতি আহলিল আসার; পৃষ্ঠা: ১৫৭; গৃহীত: ইজমা‘উল ‘উলামা ‘আলাল হাজরি ওয়াত তাহযীরি মিন আহলিল আহওয়া; পৃষ্ঠা: ৭৭-৭৮]

·
বিদ‘আতীদের কথাবার্তা শোনার ক্ষেত্রে সালাফদের কঠোরতা:

ন্যায়নিষ্ঠ সালাফগণ (রাহিমাহুমুল্লাহ) বিদ‘আতীদের কথাবার্তা শোনার ক্ষেত্রে খুবই কঠোর ছিলেন। নিম্নোক্ত আসার তিনটি বিদ‘আতীদের ব্যাপারে তাঁদের কঠোর অবস্থান এবং দ্বীনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র শিথিল না হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করবে, ইনশাআল্লাহ।

১. আসমা বিন ‘উবাইদ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪১ হি.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

دخل رجلان من أصحاب الأهواء على ابن سيرين فقالا: يا أبا بكر نحدثك بحديث؟ قال: لا، قالا: فنقرأ عليك آية من كتاب الله؟ قال: لا، لتقومان عني أو لأقومن. قال: فخرجا، فقال بعض القوم: يا أبا بكر، ما كان عليك أن يقرآ عليك آية من كتاب الله تعالى؟ قال: إني خشيت أن يقرآ علي آية فيحرفانها، فيقر ذلك في قلبي.

“দুজন বিদ‘আতী ইবনু সীরীনের [মৃত: ১১০ হি.] নিকট প্রবেশ করে বলল, ‘হে আবূ বাকার, আমরা আপনার কাছে একটি হাদীস বর্ণনা করি?’ তিনি বললেন, ‘না।’ তখন তারা দুজন বলল, ‘তাহলে আমরা আপনাকে আল্লাহ’র কিতাব থেকে একটি আয়াত পড়ে শোনাই?’ তিনি বললেন, ‘না; হয় তোমরা আমার নিকট থেকে উঠে চলে যাবে, অথবা আমি উঠে চলে যাব।’ বর্ণনাকারী বলছেন, তারা দুজন প্রস্থান করল। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল, ‘হে আবূ বাকার, আপনার কী (ক্ষতি) হতো, যদি তারা দুজন আপনাকে আল্লাহ’র কিতাব থেকে একটি আয়াত পড়ে শোনাত?’ তিনি (ইবনু সীরীন) বললেন, ‘নিশ্চয় আমি আশঙ্কা করেছি যে, তারা দুজন আমার কাছে একটি আয়াত পড়বে, অতঃপর তারা সে আয়াতে বিকৃতি (তাহরীফ) সাধন করবে, ফলে তা আমার অন্তরে গেঁথে যাবে’।” [দারিমী, হা/৪১১; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: হুসাইন সালীম আসাদ); ইবনু বাত্বত্বাহ, আল-ইবানাহ; আসার নং: ৩৯৮; লালাকাঈ, শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ২৪২; আজুর্রী, আশ-শারী‘আহ; আসার নং: ৬২]

২. ইমাম সাল্লাম বিন আবূ মুত্বী‘ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৭৩ হি.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أن رجلا من أهل الأهواء قال لأيوب: يا أبا بكر، أسألك عن كلمة؟ قال: فولى وهو يشير بأصبعه ولا نصف كلمة. وأشار لنا سعيد بخنصره اليمنى.

“একজন বিদ‘আতী আইয়ূব (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩১ হি.] কে বলল, হে আবূ বাকার, আমি আপনাকে একটি শব্দ সম্পর্কে প্রশ্ন করি? বর্ণনাকারী বলছেন, তখন তিনি দ্রুত প্রস্থান করলেন, এমতাবস্থায় তিনি তাঁর আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলছিলেন, আধা শব্দও নয়। বর্ণনকারী সা‘ঈদ আমাদেরকে তাঁর ডান কনিষ্ঠা দিয়ে ইশারা করে দেখিয়েছেন।” [দারিমী, হা/৪১২; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: হুসাইন সালীম আসাদ); ইবনু বাত্বত্বাহ, আল-ইবানাহ; আসার নং: ৪০২; লালাকাঈ, শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ২৯১]

৩. শাইখুল ইসলাম ইমাম মা‘মার (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৫৩ হি.] বলেছেন,

كان ابن طاوس جالسًا فجاء رجل من المعتزلة فجعل يتكلم، قال فأدخل ابن طاوس أصبعيه في أذنيه، قال: وقال لإبنه: أي بني، أدخل أصبعيك في أذنيك وتشدد، ولا تسمع من كلامه شيئًا. قال معمر: يعني أن القلب ضعيف.

“একদা ইবনু ত্বাউস [মৃত: ১৩২ হি.] উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় এক মু‘তাযিলী এসে কথা বলা শুরু করল। বর্ণনকারী বলছেন, তখন ইবনু ত্বাউস তাঁর দু’কানে দুই আঙুল প্রবেশ করালেন এবং তাঁর ছেলেকে বললেন, “হে বৎস, তুমি তোমার দু’কানে দুই আঙুল প্রবেশ করাও এবং চেপে ধরে থাকো, তুমি তাঁর সামান্য কথাও শুনো না।” মা‘মার (তাঁর এই কাজের ব্যাখ্যা দিয়ে) বলেছেন, ‘অর্থাৎ অন্তর খুবই দুর্বল (আমরা তার কথা শুনলে আমাদের অন্তরে তা গেঁথে যেতে পারে)’।” [ইবনু বাত্বত্বাহ, আল-ইবানাহ; আসার নং: ৪০০; লালাকাঈ, শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ২৪৮]

প্রিয় পাঠক, একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন। সালাফগণ বিদ‘আতীদের কথায় প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাঁদের কথা শুনেননি। যারা ছিলেন উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ইমাম। তাঁরাই বিদ‘আতীদের কথায় প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন, তাহলে আমাদের অবস্থান কোথায়? এরপরেও কি আমাদের এটা বলা সমীচীন হবে যে, আমরা বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়ে এবং তাদের লেকচার ক্লিপস শুনে শুধু হকটাই নিব, বাতিলটা নিব না?!

·
বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া ও তাদের লেকচার ক্লিপস শোনার ব্যাপারে ‘আলিমদের ফাতাওয়া:

বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া ও তাদের লেকচার ক্লিপস শোনার ব্যাপারে ‘আলিমদের অনেক ফাতওয়া রয়েছে। আমরা এখানে আহলুস সুন্নাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘আলিমগণের ৭ টি ফাতওয়া উপস্থাপন করলাম।

·
১. ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,

ومن هجر أهل البدع: ترك النظر في كتبهم خوفًا من الفتنة بها، أو ترويجها بين الناس، فالابتعاد عن مواطن الضلال واجب لقوله ﷺ، في الدجال: «مَنْ سَمِعَ بِالدَّجَّالِ فَلْيَنْأَ عَنْهُ، فَوَاللَّهِ إِنَّ الرَّجُلَ لَيَأْتِيهِ وَهُوَ يَحْسِبُ أَنَّهُ مُؤْمِنٌ فَيَتَّبِعُهُ، مِمَّا يَبْعَثُ بِهِ مِنَ الشُّبُهَاتِ» رواه أبو داود قال الألباني: وأسناده صحيح.
لكن إن كان الغرض من النظر في كتبهم معرفة بدعهم للرد عليها فلا بأس بذلك إن كان عنده من العقيدة الصحيحة ما يتحصن به وكان قادرًا على الرد عليهم، بل ربما كان واجبًا؛ لأن رد البدعة واجب وما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب.

“বিদ‘আতীদের বর্জন করার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তাদের বইপুস্তকের মাধ্যমে ফিতনাহগ্রস্ত হওয়া এবং সেগুলো মানুষের মধ্যে প্রচলিত হওয়ার আশঙ্কায় তা না পড়া। ভ্রষ্টতার জায়গাসমূহ থেকে দূরে থাকা ওয়াজিব। যেহেতু নাবী ﷺ দাজ্জালের ব্যাপারে বলেছেন, “কেউ দাজ্জালের আবির্ভাবের কথা শুনলে সে যেন তার থেকে দূরে চলে যায়। আল্লাহ’র কসম, যে কোনো ব্যক্তি তার নিকট এলে সে অবশ্যই মনে করবে যে, সে ঈমানদার। অতঃপর সে দাজ্জাল কর্তৃক তার মধ্যে জাগরিত সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে তার (দাজ্জালের) অনুসরণ করবে।” আবূ দাঊদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন (হা/৪৩১৯)। আলবানী বলেছেন, ‘হাদীসটির সনদ সাহীহ (বিশুদ্ধ)’।

কিন্তু তাদের বইপুস্তক পড়ার পিছনে যদি তাদের বিদ‘আতগুলো জানার উদ্দেশ্য থাকে, যাতে করে তাদের রদ করা যায়, তবে এতে কোনো সমস্যা নেই। আর এটা (রদ) ওই ব্যক্তির জন্য, যার নিজেকে সুরক্ষিত করার মতো বিশুদ্ধ ‘আক্বীদাহ আছে এবং যে তাদেরকে রদ করতে সক্ষম। বরং কখনো কখনো এই কাজ ওয়াজিব। কেননা বিদ‘আতকে রদ করা ওয়াজিব। আর যা ব্যতীত ওয়াজিব পূর্ণ হয়না, সেটাও ওয়াজিব।” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), শারহু লুম‘আতিল ই‘তিক্বাদ; পৃষ্ঠা: ১১১; মুআসসাসাতুর রিসালাহ (বৈরুত) ও মাকতাবাতুর রুশদ (রিয়াদ) কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪০৪ হি./১৯৮৪ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]

·
২. বিদ‘আতীদের দারসসমূহে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)’র সুস্পষ্ট ফাতওয়া—
السؤال: ما حكم حضور دروس أهل البدع؟
الجواب: إذا كان يحضر دروس أهل البدعة من أجل أن يناقشهم ويبين لهم الحق والصواب فهو واجب. وإذا كان يريد أن يتعلم منهم فلا يتعلم منهم، حتى لو كان في غير العقيدة، حتى لو كان يدرسهم في النحو أو البلاغة. لا تـقـربهم؛ لأنهـم قد يدسون السم في الدسم، وأيضاً إذا حضرتهم ربما يغتر بك أحد من الناس؛ يقول هؤلاء ليس في حضور دروسهم بأس.

প্রশ্ন: “বিদ‘আতীদের দারসে উপস্থিত হওয়ার বিধান কী?”

উত্তর: “কেউ যদি বিদ‘আতীদের সাথে (‘ইলমী) বিতর্ক করার জন্য এবং তাদের কাছে হক ও সঠিক বিষয় তুলে ধরার জন্য তাদের দারসে উপস্থিত হয়, তবে তা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে কেউ যদি তাদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করতে চায়, তবে সে যেন তাদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন না করে। যদিও তা ‘আক্বীদাহ ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ের জ্ঞান হয়। যদিও সে তাদের কাছে নাহূ (আরবি ব্যাকরণশাস্ত্র) ও বালাগাত (অলংকারশাস্ত্র) অধ্যয়ন করে। তুমি তাদের নিকটবর্তী হবে না। কেননা তারা তেলের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দেয়। [অর্থাৎ, ক্ষতিকর বিষয় আকর্ষণীয় মোড়কে উপস্থাপন করে। – সংকলক।] অনুরূপভাবে তুমি যখন তাদের কাছে উপস্থিত হবে, তখন হয়তো তোমার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি ধোঁকায় পতিত হবে। ফলে বলবে, তাদের দারসে উপস্থিত হওয়ায় কোনো সমস্যা নেই।” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), লিক্বাআতুল বাবিল মাফতূহ; ১৬২ নং অডিয়ো ক্লিপ; গৃহীত: www.sahab.net/forums/index.php?app=forums&module=forums&controller=topic&id=82749.]

·
৩. ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] প্রদত্ত ফাতওয়া—

السؤال: ما هو القول الحق في قراءة كتب المبتدعة، وسماع أشرطتهم؟
الجواب: لا يجوز قراءة كتب المبتدعة ولا سماع أشرطتهم إلا لمن يريد أن يرد علهم ويبين ضلالهم.

প্রশ্ন: “বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া এবং তাদের লেকচার ক্লিপস শোনার ব্যাপারে হক কথা কী?”
উত্তর: “বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া এবং তাদের লেকচার ক্লিপস শোনা জায়েজ নয়। তবে যে ব্যক্তি তাদেরকে রদ করতে চায় এবং তাদের ভ্রষ্টতা বর্ণনা করতে চায়, তার জন্য জায়েজ আছে।” [ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ), আল-আজউয়িবাতুল মুফীদাহ ‘আন আসইলাতিল মানাহিজিল জাদীদাহ; পৃষ্ঠা: ৭০; দারুল মিনহাজ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৪ হিজরী (৩য় প্রকাশ)]

·
৪. ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) প্রদত্ত আরেকটি ফাতওয়া—

السؤال: هل يجوز طلب العلم من أهل البدعة وقراءة كتبهم لعدم وجود كتب أهل السنة في بلدي؟
الجواب: الحمد الله، أهل السنة موجودون وكتبهم موجودة، لكن يحتاج [كلام غير واضح] إلى طلب وحرص، ولا تعتمد على أهل البدع وكتب المبتدعة، لا تعتمد عليها، لأنها كالغذاء المسموم القاتل، نعم.

প্রশ্ন: “আমার দেশে আহলুস সুন্নাহ’র বইপুস্তক না থাকার কারণে বিদ‘আতীদের নিকট থেকে ‘ইলম গ্রহণ করা এবং তাদের বইপুস্তক পড়া কি বৈধ হবে?”

উত্তর: “আল-হামদুলিল্লাহ, আহলুস সুন্নাহ বিদ্যমান রয়েছে এবং তাদের বইপুস্তকও বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু অন্বেষণ ও আগ্রহের প্রয়োজন আছে। তুমি বিদ‘আতীদের উপর এবং তাদের বইপুস্তকের উপর নির্ভর কোরো না। তুমি তাদের বইপুস্তকের উপর নির্ভর কোরো না। কেননা সেগুলো প্রাণঘাতী বিষমিশ্রিত খাদ্যের মতো।” [দ্র.: https://ar.alnahj.net/audio/1512.]

·
৫. বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম ‘আব্দুল মুহসিন আল-‘আব্বাদ আল-বাদর (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৩ হি./১৯৩৪ খ্রি.] প্রদত্ত ফাতওয়া—

السؤال: كثير من طلاب العلم يقول: إن الحق يأخذ من كلام كل أحد حتى من المبتدع، فيجوز القراءة في كتب أهل البدع والإستماع لأشرطتهم.
الجواب: ما يجوز القراءة في كتب أهل البدع والإستماع لأشرطتهم، إلا لبيان ما عندهم من الضلال، حتى يحذر ذلك.

প্রশ্ন: “অসংখ্য ত্বালিবুল ‘ইলম বলছে, নিশ্চয় হক প্রত্যেকের কথা থেকে গ্রহণ করতে হবে, যদিও সে বিদ‘আতী হয়। সুতরাং বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া এবং তাদের লেকচার ক্লিপস শোনা জায়েজ।”

উত্তর: “বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া এবং তাদের লেকচার ক্লিপস শোনা জায়েজ নয়। তবে তাদের ভ্রষ্টতা বর্ণনা করার জন্য জায়েজ, যাতে করে তা (ভ্রষ্টতা) থেকে সতর্ক থাকা যায়।” [দ্র.: https://m.youtube.com/watch?v=p5G4gb0oEJM (অডিয়ো ক্লিপ)]

·
৬. সৌদি আরবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ আবূ মুহাম্মাদ যাইদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাদী আল-মাদখালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪৩৫ হি./২০১৪ খ্রি.] বলেছেন,

وقد حذر سلفنا الصالح رضوان الله عليهم ـ من النظر في كتب المبتدعة لما يترتب على ذلك من المفاسد العظيمة فإن القلوب ضعيفة والشبه خطافة ومما يؤسف له أن كثيرا من الشباب اليوم يقرؤون في كتب أهل الأهواء والضلال ويربون أنفسهم عليها ثم يعودون حربا على السنة وأهلها وحربا على منهج السلف الحق ، فإنا لله وإنا إليه راجعون.

“আমাদের ন্যায়নিষ্ঠ সালাফগণ (রিদ্বওয়ানুল্লাহি ‘আলাইহিম) বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়া থেকে সতর্ক করেছেন, এর ফলে অপরিহার্যভাবে বড়ো বড়ো ক্ষতি ও অপকারিতা আসার কারণে। কেননা অন্তরসমূহ দুর্বল, আর সংশয়সমূহ (অন্তরস্থ ঈমানকে) লুণ্ঠনকারী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো—বর্তমান যুগে অধিকাংশ যুবক পথভ্রষ্ট বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়ছে এবং সেসবের উপর ভিত্তি করে নিজেদের গড়ে তুলছে। তারপর তারা সুন্নাহ ও তার ধারকদের বিরুদ্ধে এবং সালাফদের হক মানহাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন।” [‘আল্লামাহ যাইদ আল-মাদখালী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রণীত “মানহাজুস সালাফ ফিত তা‘আমুলি মা‘আ কুতুবি আহলিল বিদা‘”– গ্রন্থ দ্রষ্টব্য; গৃহীত: sahab.net]

·
৭. বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম ‘উবাইদ বিন ‘আব্দুল্লাহ আল-জাবিরী (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৭ হি.] বিদ‘আতীদের কিতাব পড়ার তিনটি বিধান বর্ণনা করে বলেছেন,

ﺇﻥَّ ﺍﻟﻨَّﻈﺮ ﻓﻲ ﻛﺘﺐ ﺍﻻﻧﺤﺮﺍﻑ ﻟﻪ ﺛﻼﺛﺔ ﺃﺣﻜﺎﻡ:
١ - ﻣﺎ ﻛﺎﻥ ﺑﺪﻋﺔً ﺧﺎﻟﺼﺎً ﻟﻴﺲ ﻓﻴﻪ ﺷﻲﺀٌ ﻣﻦ ﺍﻟﺴُﻨَّﺔ، ﻭﻣﺜﺎﻝ ﺫﻟﻚ: (ﺃﺻﻮﻝ ﺍﻟﻜﺎﻓﻲ) ﻟﻠﻜُﻠَﻴْﻤﻲّ ﻭﻏﻴﺮﻩ ﻣﻦ ﻛُﺘُﺐ ﺍﻟﺮﺍﻓﻀﺔ، ﻓﻬﺬﺍ ﻳﺤﺮﻡ ﺍﻟﻨﻈﺮ ﻓﻴﻪ ﻭﻣﻄﺎﻟﻌﺘﻪ ﺇﻻَّ ﻟﻌﺎﻟﻢٍ ﻣﺘﻤﻜﻦ ﻳﺮﻳﺪ ﺍﻟﺮﺩَّ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻘﻮﻡ ﻣﻦ ﻛﺘﺒﻬﻢ .
ﺳﻤﻌﺘﻢ؟ ﺷﺮﻃﻴﻦ: ١ - ﻋﺎﻟﻢ ﻣﺘﻤﻜﻦ ٢ - ﻳﺮﻳﺪ ﺍﻟﺮَّﺩ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻘﻮﻡ ﻣﻦ ﻛﺘﺒﻬﻢ.
٢ - ﻣﺎ ﻛﺎﻥ ﺧﻠﻴﻄﺎً ﻓﻴﻪ ﺳُﻨَّﺔٌ ﻭﺑﺪﻋﺔ؛ ﻓﻬﺬﺍ ﻻ ﻳﺤﻞ ﺍﻟﻨﻈﺮُ ﻓﻴﻪ ﺇﻻَّ ﻟﻌﺎﻟﻢٍ ﻣُﺘﻤﻜﻦ ﻗﺎﺩﺭٌ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺘﻤﻴﻴﺰ ﺑﻴﻦ ﺍﻟﺼﺤﻴﺢ ﻭﺍﻟﺴﻘﻴﻢ ﻭﺍﻟﻐﺚ ﻭﺍﻟﺴﻤﻴﻦ ﻭﺍﻟﺴﻨﺔ ﻭﺍﻟﺒﺪﻋﺔ؛ ﻭﻣﻦ ﺃﻣﺜﻠﺔ ﺫﻟﻚ: (ﺍﻟﻜﺸَّﺎﻑ) ﻟﻠﺰﻣﺨﺸﺮﻱ، ﺗﻔﺴﻴﺮ ﺍﻟﻜﺸَّﺎﻑ ﻟﻠﺰﻣﺨﺸﺮﻱ، ﻓﺈﻥَّ ﺍﻟﺰﻣﺨﺸﺮﻱ ﻣﻌﺘﺰﻟﻲ ﺟﻠﺪ، ﻣﺎﻛﺮٌ ﺩﺍﻫﻴﺔٌ، ﻳﺪُﺱُّ ﺍﻋﺘﺰﺍﻟﻴﺎﺗﻪ؛ ﻓﺎﻟﻤُﺘﻤﻜِّﻦُ ﻣﻦ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﻳﺴﺘﻔﻴﺪُ ﻣﻤﺎ ﻓﻴﻪ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﻌﺎﻧﻲ ﻭﺍﻟﺒﻼﻏﺔ ﻭﺍﻟﺒﺪﻳﻊ ﻭﺍﻟﻠﻐﺔ ﻭﺍﻟﻨﺤﻮ ﻭﻏﻴﺮ ﺫﻟﻚ ﻣﺎ ﺩﺍﻣﺖ ﻋﻨﺪﻩ ﺍﻟﻘﺪﺭﺓُ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺘﻤﻴﻴﺰ .
٣ - ﺍﻟﺜﺎﻟﺚُ ﻣﺎ ﻛﺎﻥ ﺧﺎﻟﻴﺎً ﻣﻦ ﺍﻟﺒﺪﻋﺔ، ﺻﺎﺣﺒﻪُ ﻣﺒﺘﺪﻉ ﻣُﺆﻟﻔﻪ ﻣﺒﺘﺪﻉ ﻭﻟﻜﻦَّ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ ﻟﻴﺲ ﻓﻴﻪ ﺑﺪﻋﺔ، ﻳﺆﻟﻒُ ﻣﺜﻼً ﻓﻲ ﺍﻟﻔﻘﻪ، ﻓﻲ ﺍﻟﻄﻬﺎﺭﺓ، ﻓﻲ ﺍﻟﺒﻴﻮﻉ، ﻭﻻ ﻳﺪﺱُّ، ﻳﻘﻮﻝ ﻟﻴﺲ ﻟﻲ ﺷﺄﻥ، ﺃﻧﺎ ﺃﺅﻟﻒ ﺃﻃﻠﺐ ﺍﻟﻤﻌﻴﺸﺔ، ﺃﻃﻠﺐ ﺍﻟﺮﺯﻕ ﻣﻦ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﺘﺄﻟﻴﻒ، ﺃﻭ ﻳﺄﺧﺬ ﻣﺜﻼً ﻛﺘﺎﺑﺎً ﻣﻦ ﻛُﺘُﺐ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻭﻳﺮﺗﺒﻪ ﻭﻳﻨﻈﻢُ ﺃﺑﻮﺍﺑﻪُ ﻭﻳُﺮﻗﻤﻪ ﻓﻘﻂ، ﻭﻻ ﻳﺪﺧﻞ ﺷﻴﺌﺎً ﻣﻦ ﺑﺪﻋﺘﻪ، ﻓﻬﺬﺍ ﺇﺫﺍ ﺃﺭﺷﺪﻙ ﺇﻟﻴﻪ ﻋﺎﻟﻢٌ ﻣﺘﻤﻜﻦٌ ﺃﺭﺷﺪﻙ ﺇﻟﻰ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ، ﻭﻗﺎﻝ ﻟﻚ :ﺇﻥ ﻛﺘﺎﺏ ﻓُﻼﻥ ﻟﻴﺲ ﻓﻴﻪ ﺑﺪﻋﺔ، ﻃﺎﻟﻌﺘﻪُ ﻭﺧﺒَﺮﺗﻪُ، ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ ﺍﻟﻔﻼﻧﻲ ﻟﻴﺲ ﻓﻴﻪ ﺷﻲﺀٌ ﻣﻦ ﺑِﺪَﻋِِﻪِ، ﻓﻼ ﻣﺎﻧﻊ ﻣﻦ ﻗﺮﺍﺀﺗﻪ.

“বিদ‘আতীদের বই পড়ার ৩ টি বিধান রয়েছে। যথা:

১. যে বই বিদ‘আতে পরিপূর্ণ এবং তাতে কোনো সুন্নাহ নেই, যেমন: কুলাইমীর “উসূলুল কাফি” এবং রাফিদ্বী শী‘আদের অন্যান্য বই। এমন বই পড়া হারাম। তবে কোনো সামর্থবান ‘আলিম যদি কোনো সম্প্রদায়কে তাদের বই দিয়ে রদ করতে চান (তাহলে জায়েজ)। তোমরা কি শুনেছ? শর্ত হলো দুটি: ক. সামর্থবান ‘আলিম হতে হবে খ. আর তিনি তাদের বই দিয়ে তাদেরকে রদ করার ইচ্ছা করবেন।

২. যে বই সুন্নাহ ও বিদ‘আহ মিশ্রিত। এই বইও সামর্থবান ‘আলিম ছাড়া অন্য কারও জন্য পড়া জায়েজ নয়; এমন ‘আলিম যিনি সাহীহ-দ্ব‘ঈফ, ভালো-মন্দ, সুন্নাহ-বিদ‘আহ প্রভৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন। এমন বইয়ের উদাহরণ হলো— যামাখশারীর “তাফসীরে কাশশাফ”। যামাখশারী ছিল কট্টর মু‘তাযিলী, আর ধূর্ত কূটকৌশলী, সে তার মু‘তাযিলী ‘আক্বীদাহ বইয়ে প্রবিষ্ট করত। ‘আলিমদের মধ্যে যারা সামর্থবান, তাঁরা এই বইয়ে উল্লিখিত শব্দার্থ, অলঙ্কারশাস্ত্র, আরবি ভাষার চমৎকার বাক্যবিন্যাস-শাস্ত্র, ভাষাবিজ্ঞান, নাহূশাস্ত্র প্রভৃতি থেকে উপকার লাভ করতে পারেন; যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর কাছে সাহীহ-দ্ব‘ঈফ, ভালো-মন্দ, সুন্নাহ-বিদ‘আহ প্রভৃতির মধ্যে পার্থক্য করার সক্ষমতা থাকে।

৩. যে বই বিদ‘আত থেকে মুক্ত। বইয়ের লেখক বিদ‘আতী, কিন্তু বইয়ে কোনো বিদ‘আত নেই। যেমন কেউ ফিক্বহশাস্ত্রের বই লিখেছে, পবিত্রতা, ব্যবসাবাণিজ্য প্রভৃতির ক্ষেত্রে বই লিখেছে এবং বইয়ে কোনো বিদ‘আত প্রবিষ্ট করেনি। সে বলে যে, “আমার (অন্য) কোনো ব্যাপার নেই, আমি জীবিকা নির্বাহের জন্য বই লিখি, আমি এই বইয়ের মাধ্যমে রিজিক অন্বেষণ করি।” সে হয়তো কোনো হাদীসগ্রন্থের অধ্যায়গুলো বিন্যস্ত করে, হাদীসের নম্বর দেয় এবং তাতে কোনো বিদ‘আত প্রবেশ করায় না। যদি কোনো সামর্থবান ‘আলিম এই বই পড়ার পরামর্শ দেন, তাহলে আমিও তোমাকে তা অধ্যয়ন করার পরামর্শ দিই। আর সেই ‘আলিম তোমাকে বলেন যে, “অমুক লোকের এই বইয়ে কোনো বিদ‘আত নেই। সেটা আমি পড়েছি এবং নিরীক্ষা করেছি। অমুক বইয়ে কোনো বিদ‘আত নেই।” তাহলে এই বই পড়ায় কোনো আপত্তি নেই।” [দ্র.: www.ajurry.com/Kotob-Manhag.htm; গৃহীত: https://tinyurl.com/yb9qkdzx (“সালাফী: ‘আক্বীদাহ্ ও মানহাজে” পেজের পোস্ট থেকে)]

·
আমি (সংকলক) বলছি, শেষোক্ত ফাতওয়াটির মধ্যে বিদ‘আতীদের বইপুস্তক পড়ার ব্যাপারে তাফসীলী তথা সুবিস্তারিত হুকুম বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আমি পাঠক মহোদয়কে উক্ত ফাতওয়ার দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে অনুরোধ করছি।

আর বিদ‘আতীদের নিকট থেকে ‘ইলম নেওয়াকে বৈধ করার জন্য বিদ‘আতীরা বেশ কিছু সংশয় পেশ করে থাকে। পরবর্তী পোস্টে এ সংক্রান্ত সংশয়গুলোর প্রামাণ্য জবাব দেওয়া হবে, ইনশাআল্লাহ। সুতরাং অনুসন্ধিৎসু পাঠক মহোদয়কে আমি পরবর্তী নিবন্ধটিও পড়ার অনুরোধ করব। বারাকাল্লাহু ফীকুম।

·
অনুবাদ ও সংকলনে: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা
পরিবেশনায়: www.facebook.com/SunniSalafiAthari

দাওয়াতি কাজ সকল মুসলিমের জন্য ফরজ এবং সাধারণ মানুষদের দাওয়াতি কাজের কতিপয় পদ্ধতি

  ▬▬▬✪✪✪▬▬▬ প্রশ্ন: সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ কি সবার উপরে ফরজ? যাদের দ্বীনের জ্ঞান নেই যেমন জেনারেল লাইনে পড়া মানুষ কিন্তু দ্বীন জানার...