Saturday, November 9, 2019

মধ্যপন্থার আবরণে শৈথিল্যবাদ



▌মধ্যপন্থার আবরণে শৈথিল্যবাদ

·
ইসলাম একটি মধ্যপন্থি শরিয়ত। ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে আমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে আদিষ্ট হয়েছি। মুসলিমরাও সবাই মধ্যপন্থা অনুসরণ করে দ্বীনে ইসলাম পালনের আদেশ স্বীকার করে নিয়েছে। এরপরেও দেখা যায়, মুসলিমদের মধ্যে সবাই মধ্যপন্থার অনুসরণ করে ইসলাম পালন করছে না। আজকে আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করব, তা হলো—মানহাজ সংক্রান্ত বিষয়ে মুসলিমদের ভুলের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থার অনুসরণ।

মানহাজের বিষয়ে কোনো মুসলিম—হোক তিনি একজন ‘আলিম, বা তালিবুল ‘ইলম, বা জনসাধারণের কেউ—যদি ভুলে পতিত হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী, তা বুঝতে হবে এই সংক্রান্ত বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ’র বিধান থেকে এবং সেই বুঝ হতে হবে সালাফদের বুঝের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, এসব ব্যাপারে মধ্যপন্থা—যেই পন্থা অনুসরণ করতে আমরা আদিষ্ট হয়েছি—অনুসরণ করার দাবিদার ভাইয়েরা এই বিষয়ে কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের বুঝ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করছেন না। এতে করে তারা মধ্যপন্থার অনুসারী না হয়ে চরমপন্থি হয়ে যাচ্ছেন, বা শৈথিল্যবাদী হয়ে যাচ্ছেন।

·
তবে মধ্যপন্থি দাবিদার চরমপন্থির চেয়ে মধ্যপন্থি দাবিদার নরমপন্থির সংখ্যাই বেশি। বিশেষ করে আমাদের দেশে এদের অনেক দেখা যায়। মানহাজ সংক্রান্ত ভুলের কারণে কোনো মুসলিমের ব্যাপারে আমরা কী অবস্থান নিব, সেই ব্যাপারে তারা শৈথিল্যবাদী। আর এ ব্যাপারে তাদের শৈথিল্যবাদী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো—তারা মানহাজের ব্যাপারে রচিত সালাফদের কিতাব থেকে এই বিষয়ে ‘ইলম নেয় না। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই বিষয়ে তাদের মধ্যপন্থা নির্ধারণের পদ্ধতি হলো নিজেদের অনুভূতি শক্তিকে কাজে লাগানো।

অর্থাৎ কোনটা মধ্যপন্থা, কোনটা চরমপন্থা, আর কোনটা শৈথিল্যবাদ—এটা তারা শিখতে চায় অনুভব করার মাধ্যমে। যেটাকে তারা মধ্যপন্থা ‘ফিল’ করে, সেটাকে তারা মধ্যপন্থা বলে। যেটাকে তারা চরমপন্থা ‘ফিল’ করে, সেটাকে তারা চরমপন্থা বলে। অথচ এটা মোটেই মধ্যপন্থা, বা চরমপন্থা, বা নরমপন্থা নির্ণয়ের পদ্ধতি নয়। যেহেতু এটি দ্বীনের অন্তর্গত বিষয়, সেহেতু এই ব্যাপারে অবশ্যই আমাদেরককে সালাফদের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহ’র দিকে ফিরে যেতে হবে।

·
উল্লেখ্য যে, মধ্যপন্থা আর চরমপন্থার ব্যাপারে এসব ভাইদেরকে মন্তব্য করতে দেখা গেলেও শৈথিল্যবাদ বিষয়ে তাদের মন্তব্য করতে দেখা যায় না। তাদেরকে আপনি দেখবেন চরমপন্থিদের সমালোচনা করতে, অথবা মধ্যপন্থিদেরকে ‘চরমপন্থি’ ট্যাগ দিয়ে সমালোচনা করতে। কিন্তু তাদেরকে শৈথিল্যবাদীদের সমালোচনা করতে দেখবেন না—বললেই চলে। এর কারণ কী, জানেন? কারণ তারা নিজেরাই শৈথিল্যবাদী।

তো ভাইয়েরা, এই শৈথিল্যবাদীরা যে অনুভবশক্তি দিয়ে মধ্যপন্থা নির্ধারণের ভুলটা করে থাকে, তাতো বললাম। তাদের তথাকথিত মধ্যপন্থা নির্ধারণের ব্যাপারে আরও কিছু পদ্ধতি বর্ণনা না করলেই নয়। মানহাজের ব্যাপারে ভুলে পতিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কেমন হবে, এ ব্যাপারে এই শৈথিল্যবাদীরা নিজেদের পক্ষে দলিলগ্রহণের ক্ষেত্রে সালাফদের রচিত মানহাজের কিতাব বাদ দিয়ে ইতিহাস ও বিচ্ছিন্ন ঘটনার ওপর নির্ভর করে থাকে।

·
উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে, ইনশাআল্লাহ। জনৈক তালিবুল ‘ইলমের একটি সংক্ষিপ্ত অডিয়ো ক্লিপে বর্ণিত হয়েছে, জনৈক শৈথিল্যবাদী তার বইয়ে লিখেছে অনেকটা এরকম কথা—“বিদ‘আতী দা‘ঈ ইবনু আবী দুআদের সাথে ইমাম আহমাদ কী আচরণ করেছিলেন তা বলা হয়, কিন্তু সাহাবীদেরকে গালিগালাজকারী রাফেজীদের সাথে তিনি কী আচরণ করেছেন তা বলা হয় না। অথচ তিনি তাদের সাথে বসেছেন এবং উত্তম আচরণ করেছেন।”

তো এই ঘটনা বর্ণনা করে ওই লেখক রেফারেন্স দিয়েছেন ‘তারীখে বাগদাদী’ নামক কিতাবের। অথচ ‘তারীখে বাগদাদী’ একটি ইতিহাসের কিতাব, মানহাজ শিক্ষার কিতাব নয়। অধিকন্তু ‘তারীখে বাগদাদী’ গ্রন্থে উক্ত ঘটনা সম্পূর্ণরূপে আসেনি, যেমনটা এসেছে ইমাম খাল্লাল বিরচিত ‘আস-সুন্নাহ’ নামক মানহাজের কিতাবে। সেখানে এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ওই রাফেজীরা যখন ইমাম আহমাদের নসিহত গ্রহণ করল না, তখন তিনি তাদের বর্জন করেছিলেন!

·
তাহলে দেখুন, ভাইয়েরা, ‘আক্বীদাহ-মানহাজের কিতাব বাদ দিয়ে ইতিহাসের কিতাব থেকে মানহাজ শিখতে গেলে কী অবস্থা হতে পারে! আরেকটা উদাহরণ দিই, যেটা সম্ভবত আপনাদের অনেকেই দেখেছেন। নিজেদের প্রিয় বক্তা বা দা‘ঈবর্গ কর্তৃক বিদ‘আতীদের সাথে না-জায়েজ কো-অপারেশনকে ডিফেন্ড করার দলিল হিসেবে প্রায় দুই বছর আগে কিছু ভাই রাবেতার ফিক্বহ কাউন্সিলের সম্মেলন থেকে তোলা গ্র্যান্ড মুফতি শাইখ ‘আব্দুল ‘আযীয আলুশ শাইখ ও বিদ‘আতীদের গুরু ক্বারদ্বাউয়ীর ছবি প্রচার করছিল, যেখানে দুজন পাশাপাশি বসে ছিলেন।

মানে সালাফি দাবিদাররা খালাফদের যুগের, বরং বর্তমান যুগের একজন জীবিত ‘আলিম ক্বারদ্বাউয়ীর সাথে বসেছেন, সেই ছবি দিয়ে নিজেদের প্রিয় বক্তা বা দা‘ঈবর্গ কর্তৃক বিদ‘আতীদের সাথে কৃত না-জায়েজ কো-অপারেশনকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করছিল! অথচ ইউসুফ আল-ক্বারদ্বাউয়ীকে আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে রাবেতার ফিক্বহ কাউন্সিল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এবং রাবেতার ইংলিশ টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এই ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। তো যেসব ভাইয়েরা মুফতির সাথে ক্বারদ্বাউয়ীর ছবি দিয়ে বিদ‘আতীদের সাথে না-জায়েজ কো-অপারেশনকে জায়েজ করতে চায়, তাদের জন্য কি রাবেতার ফিক্বহ কাউন্সিল থেকে ক্বারদ্বাউয়ীর বহিষ্কৃত হওয়াটাও বিদ‘আতীদের সাথে না বসার দলিল হওয়ার কথা না?

·
আর ব্যাপারটা যদি এমনই হয়, তাহলে চিন্তা করুন, ভাইয়েরা। ছবি দেখে এক মানহাজ শিখবেন, টুইট দেখে ওই মানহাজ চেঞ্জ করে ফেলবেন! কারণ দলিল হলো ছবি, টুইট, নিউজপেপার ইত্যাদিতে পাওয়া বিচ্ছিন্ন ও প্রেক্ষাপটবিহীন চিত্র বা ঘটনা! এরাই নাকি সালাফদের মানহাজের অনুসারী ও মধ্যপন্থি! যাইহোক, এই পর্যায়ে এসে তথাকথিত মধ্যপন্থিদের পন্থা নিরধারণের ব্যাপারে পূর্বে যা বলা হয়েছে, সেই কথায় আবার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছি। বলছিলাম যে, এই তথাকথিত মধ্যপন্থিরা মধ্যপন্থা বা চরমপন্থা নির্ণয় করে অনুভূতিশক্তির মাধ্যমে, ‘ইলমের মাধ্যমে না।

এর একটা ছোটো প্রমাণ দেওয়ার জন্যই আবার এই কথায় আসা। মধ্যপন্থার গুরুত্ব এবং চরমপন্থা ও চরমপন্থিদের নিন্দা প্রসঙ্গে আমাদের আলোচ্য তথাকথিত মধ্যপন্থিদের কথা বলতে দেখলেও, কখনো দেখবেন না অন্য কোনো বিষয়ে ‘ইলমী আলোচনা করতে। অর্থাৎ তাদের ‘ইলম যেন শুধু মধ্যপন্থা আর চরমপন্থা বিষয়ে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?! ইসলামের অন্য কোনো বিষয়ে আপনার গভীর ‘ইলম নেই, কিন্তু মধ্যপন্থা, আর চরমপন্থা বিষয়ে আপনি খুব ভালো জেনে ফেলেছেন, এটা তো বিশ্বাস্য না! তারমানে নিশ্চয়ই আপনি মধ্যপন্থা, আর চরমপন্থার ব্যাপারেও গভীর ইলম রাখেন না; বরং নিজের অনুভূতির দেওয়া রায়, জাহালত আর আবেগের ভিত্তিতেই কথা বলেন আপনি।

·
এখানে আরেকটি পয়েন্ট ভাইদের সামনে আনতে চাই, এই শৈথিল্যবাদী তথাকথিত মধ্যপন্থিদের ব্যাপারে। সেটা হলো—শৈথিল্যবাদীদের সবাই কিন্তু একই পর্যায়ের শৈথিল্যবাদী না। এদের কাউকে পাবেন “ভালোটা নিব, খারাপটা বর্জন করব”– নীতি অবলম্বন করে যার তার থেকে ‘ইলম নিচ্ছে, প্রোমোট করছে, বিদ‘আতীদের সাথে ধরাবাধাহীনভাবে ওঠাবসা করছে, সালাফী দাবিদার স্পষ্ট বিদ‘আতীকে সালাফী মনে করছে ইত্যাদি। এরা খুবই প্রকাশ্য এবং অতিমাত্রার শৈথিল্যবাদী।

আরেক প্রকার শৈথিল্যবাদী আছে, যারা হলো হালকা মাত্রার ছুপা শৈথিল্যবাদী, যাদের শৈথিল্যবাদ অনেক সময় বোঝা যায় না। এরা প্রথম গ্রুপের মতো বিদ‘আতীদের সাথে ধরাবাধাহীন ওঠাবসা করবে না, বিদ‘আতীদের লেকচার শুনবে না, তাদের প্রোমোটও করবে না, সালাফী দাবিদার স্পষ্ট বিদ‘আতীদের তেমনভাবে সালাফী বা ভালো বলে ডিফেন্ডও করবে না। কিন্তু এসব কাজ যারা করে—তথা জগাখিচুড়ী মানহাজের লোক, যে হয়তো টেনেটুনে সালাফী, অথবা বিদ‘আতী—তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা, সতর্ক করা ও অবস্থান নেওয়াকে এই দ্বিতীয় গ্রুপের শৈথিল্যবাদীরা অবৈধ ও চরমপন্থা মনে করে।

·
এরা ইয়াসির ক্বাদ্বীর বিরুদ্ধে বলবে, কিন্তু যারা ইয়াসির ক্বাদ্বীকে নিজেদের স্টেজে উঠিয়ে লেকচার দেয়ার সুযোগ করে দেয়, তাদের সাপোর্ট করবে। কেউ যদি তাদের সমালোচনা করে, তথা যারা ইয়াসিরকে নিজেদের স্টেজে কথা বলতে দিয়েছে তাদের সমালোচনা করে, তাদেরকে উক্ত শৈথিল্যবাদীরা চরমপন্থি বলবে। এই নরমপন্থি সালাফী দাবিদারদের বলতে দেখা যায়, “আমরা সংশোধন করব, কিন্তু কারও সমালোচনা করব না, আমরা সত্যটা জানিয়ে দিব, কিন্তু কারও নিন্দা করব না।” যদিও এসব কথা বিদ‘আতী ইখওয়ানীদের অবলম্বিত মানহাজ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

এদেরকে বলতে দেখা যায়, “আমরা সব ঘরানার দা‘ঈকে সম্মান করি, যদিও সেসব দা‘ঈদের বিদ‘আতী কর্মকাণ্ড আছে বা তারা বিদ‘আতী হিসেবেই পরিচিত।” অথচ সালাফগণ বিদ‘আতীদের সম্মান করতে কঠিনভাবে বারণ করেছেন, যা মানহাজের কিতাবে স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। একইভাবে এসব শৈথিল্যবাদীরা বলে, “উলামারা সমালোচনা করে, তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু তালিবুল ‘ইলম বা লেইম্যানরা কেন সমালোচনা করবে?!” শোনেন কথা! যেন যে কোনো উপায়ে বিদ‘আতীদের সমালোচনা করার রাস্তা রুদ্ধ করাই এদের অভিপ্রায়। আল-‘ইয়াযু বিল্লাহ।

·
অথচ এটি একটি সিদ্ধ বিষয় যে, ‘উলামারা সমালোচনা করে থাকলে, সে সমালোচনা ছোটোখাটো তালিব বা লেইম্যানরা প্রচার করতে পারবে এবং ‘উলামাদের থেকে উদ্ধৃতি না দিয়েও বলতে পারবে যে, অমুক লোক বিদ‘আতী। কারণ তার জানা আছে যে, ‘উলামারা বা সিনিয়র তালিবরা তাকে বিদ‘আতী বলেছেন। কিন্তু ছুপা শৈথিল্যবাদীদের মতে, যারা এমনটি করবে, তারা হলো চরমপন্থি।

সত্য বলতে কী, যে কোনো উপায়ে বিদ‘আতীদের বা বিদ‘আতীর সাপোর্টারদের সমালোচনা করার রাস্তা বন্ধ করা, অথবা নিজেদেরকে ‘মধ্যপন্থি’ হিসেবে জাহির করা, কিংবা সমালোচকদের চরমপন্থি বলাই হলো এসব সালাফী দাবিদার ছুপা শৈথিল্যবাদীদের কুটিল উদ্দেশ্য। তাই এই ধরনের শৈথিল্যবাদীদের থেকেও আমাদের সতর্ক থাকা আবশ্যক। ওয়া বিল্লাহিত তাওফীক্ব।

·
সুপথপ্রাপ্তির অভিলাষী
এক গুনাহগার বান্দা—
Md Abdullah Mridha.

No comments:

Post a Comment

দাওয়াতি কাজ সকল মুসলিমের জন্য ফরজ এবং সাধারণ মানুষদের দাওয়াতি কাজের কতিপয় পদ্ধতি

  ▬▬▬✪✪✪▬▬▬ প্রশ্ন: সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ কি সবার উপরে ফরজ? যাদের দ্বীনের জ্ঞান নেই যেমন জেনারেল লাইনে পড়া মানুষ কিন্তু দ্বীন জানার...