Showing posts with label ফাতওয়া. Show all posts
Showing posts with label ফাতওয়া. Show all posts

Sunday, May 17, 2020

"সদাকাতুল ফিতর"



সম্মানিত ভাইয়েরা আমার!  আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের শেষে একটি বিধান দিয়েছেন। অর্থাৎ ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে ‘সদকাতুল ফিতর’ আদায় করা। আজকের মজলিসে এ বিষয়ে কথা বলব। এর বিধান, উপকারীতা, শ্রেণী, পরিমাণ, অপরিহার্যতা, আদায় করার সময় ও স্থান সম্পর্কে আলোচনা করব।

সদকাতুল ফিতরের বিধান

সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মুসলিমদের উপর আবশ্যক করেছেন। 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আদেশ করেছেন তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক আদেশ করার সমতুল্য।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :
﴿مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ وَمَن تَوَلَّىٰ فَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ عَلَيۡهِمۡ حَفِيظٗا ٨٠﴾ [النساء: ٨٠]
‘যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হুকুম মান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই মান্য করল। আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল, আমি আপনাকে তাদের জন্য পর্যবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।’[1]
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :
﴿وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥﴾ [النساء: ١١٥]
‘যে কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং মুমিনদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকে ফিরাব যে দিকে সে ফিরতে চায় এবং আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। তা নিকৃষ্টতম গন্তব্যস্থল।’[2]
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :
﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٧﴾ [الحشر: ٧]
 ‘আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল তোমাদের যা আদেশ করেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক।’[3]

সাদকাতুল ফিতর মুসলিম নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, আজাদ-গোলাম সকলের উপর ওয়াজিব। 
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে আজাদ, গোলাম, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের উপর এক সা’ খেজুর, বা এক সা’ যব সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। 
পেটের বাচ্চার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর দেয়া ওয়াজিব নয়, কিন্তু কেউ যদি আদায় করে, তাহলে নফল সদকা হিসেবে আদায় হবে। ওসমান রাদিআল্লাহু আনহু পেটের বাচ্চার পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করতেন। ফিতরা নিজের পক্ষ থেকে এবং নিজের পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে আদায় করবে। যেমন স্ত্রী ও সন্তান। যদি তাদের নিজস্ব সম্পদ থাকে তবে তাদের সম্পদ থেকেই সদকাতুল ফিতর আদায় করবে।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :
﴿فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ﴾ [التغابن: ١٦]
‘তোমরা সাধ্য অনুপাতে আল্লাহকে ভয় কর।’[4]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ»
‘আমি যখন তোমাদের কোন বিষয়ে আদেশ করি, তোমরা তা সাধ্যানুযায়ী পালন কর।’[5]

সদকাতুল ফিতরের উপকারিতা

১. দরিদ্র ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা হয়
২. ঈদের দিনগুলোতে দরিদ্র ব্যক্তিরা ধনীদের ন্যায় স্বচ্ছলতা বোধ করে
৩. সদকাতুল ফিতরের ফলে ধনী-গরীব সবার জন্য ঈদ আনন্দদায়ক হয়
৪. সদকাতুল ফিতর আদায়কারী দানশীল হিসেবে পরিগণিত হয়
৫. সদকাতুল ফিতরের মাধ্যমে সিয়াম অবস্থায় ঘটে যাওয়া ক্রটিগুলোর কাফ্ফারা করা হয়
৬. সদকাতুল ফিতর দ্বারা আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা হয়। তিনি নিজ অনুগ্রহে বান্দাকে পূর্ণ একমাস সিয়াম পালনের তওফিক দিয়েছেন, সাথে সাথে সদকাতুল ফিতিরের ন্যায় আরেকটি ভাল কাজের তওফিক দান করলেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন অশ্লীল ও অনর্থক কথা-বার্তার কারণে সিয়ামে ঘটে যাওয়া ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দূর করার জন্য ও মিসকিনদের খাদ্য প্রদানের জন্য। ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করলে তা সদাকাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর ঈদের সালাতের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হিসেবে গন্য হবে।[6]

যে সব জিনিস দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করা যায়

মানুষের সাধারণ খাবার জাতীয় বস্ত্ত দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করা যায়। যেমন, খেজুর, গম, চাল, পনির, ঘি ইত্যাদি।
বুখারী ও মুসলিমে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিত্র খেজুর অথবা যব দ্বারা আদায় করতে বলেছেন। যবের ক্ষেত্রে দুই দিনের খাবারের সমপরিমণ যব প্রদান করা।
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে আমরা খাবার জাতীয় জিনিস দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম। সে সময় আমাদের সবার খাবার ছিল পনির, ঘি এবং খেজুর।[7]

মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীর খাদ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় হবে না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ফরজ করেছেন মিসকিনদের খাদ্যের অভাব পূরণ করার জন্য, কোন প্রাণীর খাদ্যাভাব পুরণের জন্য নয়। এমনকি কাপড়, বিছানা, পান পাত্র ইত্যাদি দ্বারাও আদায় হবে না। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকায়ে ফিতর খাদ্যের মাধ্যমে আদায় করা ফরজ করেছেন।[8] খাদ্যমূল্য দ্বারা আদায় করলেও আদায় হবে না। যেহেতু এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশের বিপরীত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 
যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ নেই, তা পরিত্যাজ্য।’
অন্য এক বর্ণনায় আছে, 
‘যে আমাদের ধর্মে এমন জিনিস সৃষ্টি করল, যা আমাদের ধর্মে নেই, তা পরিত্যাজ্য।’[9] 
তাছাড়া খাদ্যমূল্য প্রদান করা সাহাবাদের আমলের পরিপন্থী। কারণ, তারা খাদ্যজাতীয় বস্তু দ্বারাই সদকাতুল ফিত্র আদায় করতেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 
তোমরা আমার সুন্নত এবং আমার পরবর্তীতে সঠিক পথে পরিচালিত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত আকড়ে ধর। 
সদকাতুল ফিতর নির্দিষ্ট একটি এবাদত, তাই অনির্দিষ্ট বস্ত্ত দ্বারা আদায় করলে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। যেমন নির্দিষ্ট সময় ছাড়া আদায় করলে আদায় হয় না।

যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য দ্রব্য দ্বারা নির্ধারণ করেছেন। আর প্রত্যেক খাদ্য দ্রব্যের মূল্য সমান নয়। সুতরাং মূল্যই যদি ধর্তব্য হয়, তাহলে নির্দিষ্ট কোন এক প্রকারের এক সা’ হত এবং তার বিপরীত বস্ত্ত দ্বারা ভিন্ন মূল্যের হত। দ্বিতীয়ত মূল্য প্রদানের দ্বারা সদকাতুল ফিতর প্রকাশ্য এবাদতের রূপ হারিয়ে গোপন এবাদতের রূপ পরিগ্রহণ করে, তাই এটা পরিহার করাই বাঞ্চনীয়। এক সা’ খাদ্য সবার দৃষ্টি গোচর হয়,  কিন্তু মূল্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় না।

সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ

সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের এক সা’। যার ওজন চার শত আশি মিসকাল গম। ইংরেজী ওজনে যা দুই কেজি ৪০ গ্রাম গম। যেহেতু এক মিসকাল সমান চার গ্রাম ও এক চতুর্থাংশ হয়। সুতরাং ৪৮০ মিসকাল সমান ২০৪০ গ্রাম হয়। অতএব রাসূলের যুগের সা’ জানতে ইচ্ছা করলে, তাকে দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম গম ওজন করে এমন পাত্রে রাখতে হবে, যা মুখ পর্যন্ত ভরে যাবে। অতঃপর তা পরিমাপ করতে হবে।

সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ায় সময়

ঈদের রাতে সূর্যাস্তের সময় জীবিত থাকলে তার উপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক, নতুবা নয়। সুতরাং কেউ সূর্যাস্তের এক মিনিট পূর্বে মারা গেলে তার উপর ওয়াজিব হবে না। এক মিনিট পরে মারা গেলে অবশ্যই তার পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে। যদি কোন শিশু সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পর ভূমিষ্ট হয়, তার উপরও আবশ্যক হবে না, তবে আদায় করা সুন্নত। যার আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে। আর সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পূর্বে ভুমিষ্ট হলে তার পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে।
সদকাতুল ফিতর আবশ্যক হওয়ার ওয়াক্ত রমজানের শেষ দিনের সূর্যাস্তের পরবর্তী সময় নির্ধারণ করার কারণ হচ্ছে, তখন থেকে ফিতর তথা খাওয়ার মাধ্যমে রমজানের সিয়াম সমাপ্ত হয়। এ কারণেই একে রমজনের সদকাতুল ফিতর বা সিয়াম খোলার ফিতর বলা হয়। বুঝা গেল, ফিতর তথা সিয়াম শেষ হওয়ার সময়টাই সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়।[10]

সদকাতুল ফিতর আদায়ের সময় দু’ধরণের : ১. ফজিলতপূর্ণ সময় ও ২. ওয়াক্ত জাওয়াজ বা সাধারণ সময়
১. ফজিলতপূর্ণ সময় : ঈদের দিন সকালে ঈদের সালাতের পূর্বে। বুখারীতে বর্ণিত, আবূ সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহ আনহু বলেন, 
আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সদকাতুল ফিতর হিসেবে ঈদুল ফিতরের দিন এক সা’ পরিমাণ খাদ্য আদায় করতাম। 
ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, 
রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের ঈদের সালাত পড়তে যাওয়ার পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করার আদেশ দিয়েছে।
ইবনে উয়াইনা স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে আমর বিন দীনারের সূত্রে ইকরামা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, 
মানুষ ঈদের দিন সদকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করবে।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন : 
‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় এবং তার পালনকর্তার নাম স্বরণ করে, অতঃপর সালাত আদায় করে।’[11]
সুতরাং ঈদুল ফিতরের সালাত একটু বিলম্বে আদায় করা উত্তম। যাতে মানুষ সদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারে।

২. জায়েজ সময় : ঈদের একদিন দু’দিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করা।
বুখারীতে আছে, নাফে রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু নিজের এবং ছোট-বড় সন্তানদের পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন, এমনকি আমার সন্তানদের পক্ষ হতেও। তিনি জাকাতের হকদারদের ঈদের একদিন বা দুদিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর দিতেন। ঈদের সালাতের পর আদায় করা জায়েজ নেই। অতএব, বিনা কারণে সালাতের পর বিলম্ব করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশের পরিপন্থী। পূর্বে ইবনে আববাস রাদিআল্লাহু আনহু এর হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে, 
যে ব্যক্তি সদকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করবে, তার দান সদকাতুল ফিতর হিসেবে গণ্য হবে। আর যে ঈদের সালাতের পর আদায় করবে, তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হিসেবে গণ্য হবে।[12] 
যদি কোন কারণ বশত বিলম্ব করে, তাহলে কোন অসুবিধা নেই। যেমন সে এমন স্থানে আছে যে, তার নিকট আদায় করার মত কোন বস্তু নেই বা এমন কোন ব্যক্তিও নেই, যে এর হকদার হবে। অথবা হঠাৎ তার নিকট ঈদের সালাতের সংবাদ পৌঁছল, যে কারণে সে সালাতের পূর্বে আদায় করার সুযোগ পেল না। অথবা সে কোন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়েছিল, যে তা আদায় করতে ভুলে গেছে। এমতাবস্থায় সালাতের পর আদায় করলে কোন অসুবিধা নেই। কারণ সে অপারগ।

ওয়াজিব হচ্ছে, সদকাতুল ফিতর তার প্রাপকের হাতে সরাসরি বা উকিলের মাধ্যমে যথাসময়ে সালাতের পূর্বে পৌঁছানো। যদি নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে প্রদানের নিয়ত করে, অথচ তার সঙ্গে বা তার নিকট পৌঁছতে পারে এমন কারো সঙ্গে সাক্ষাত না হয়, তাহলে অন্য কোন উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রদান করবে, বিলম্ব করবে না।

সদকাতুল ফিতর প্রদানের স্থান

সদকাতুল ফিতর প্রদানের সময় যে এলাকায় সে অবস্থান করছে ঐ এলাকার গরীবরাই বেশী হকদার। উক্ত এলাকায় সে স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী। কিন্তু যদি তার বসতি এলাকায় কোন হকদার না থাকে বা হকদার চেনা অসম্ভব হয়, তাহলে তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবে। সে উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে তার সদকাতুল ফিতর আদায় করে দিবে ।

সদকাতুল ফিতরের হকদার

সদকাতুল ফিতর হকদার হচেছ (১) দরিদ্র (২) ঋণ আদায়ে অক্ষম (৩) ঋণগ্রস্ত, তাকে প্রয়োজন পরিমাণ দেয়া যাবে। এক সদকাতুল ফিতর অনেক ফকীরকে দেয়া যাবে এবং অনেক সদকাতুল ফিতর এক মিসকিনকেও দেয়া যাবে। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন, কিন্তু হকদারকে কি পরিমাণ দিতে হবে তা নির্ধারণ করেননি। সুতরাং যদি অনেক ব্যক্তি তাদের সদকাতুল ফিতর ওজন করার পর একটি পাত্রে জমা করে এবং সেখান থেকে তা পুনরায় পরিমাপ ছাড়া বণ্টন করে, তবে তা বৈধ হবে। কিন্তু ফকীরকে জানিয়ে দেয়া উচিৎ। তাকে তারা যা দিচ্ছে তার পরিমাণ তারা জানে না। ফকীরের জন্য বৈধ, কারো থেকে সদকাতুল ফিতর গ্রহণের পর নিজের পক্ষ থেকে বা পরিবারের অন্য সদস্যের পক্ষ থেকে দাতার কথায় বিশ্বাস করে পরিমাপ ছাড়াই কাউকে কিছু দেয়া।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার সন্তুষ্টি অনুযায়ী আনুগত্য করার তওফিক দিন। আমাদের আত্মা, কথা ও কাজ শুদ্ধ করে দিন। আমাদেরকে বিশ্বাস, কথা ও কাজের ভ্রষ্টতা থেকে পবিত্র করুন। নিশ্চয়ই আপনি উত্তম দানশীল ও করুনাময়। হে আল্লাহ! আখেরী নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এবং তার সকল পরিবার ও সাহাবাগণের উপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন। আমীন

সমাপ্ত

[1] নিসা : ৮০
[2] নিসা : ১১৫
[3] হাশর : ৭
[4] তাগাবুন : ১৬
[5] বুখারী ও মুসলিম
[6] আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ
[7] বুখারী
[8] হানাফি মাজহাবের ওলামায়ে কেরামের মত অনুসারে মূল্য দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করলে, সদকায়ে ফিতর আদায় হয়ে যাবে।
[9] মুসলিম
[10] হানাফী মাজহাবে ঈদের দিনের সুবহে সাদিকের সময় সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়।
[11] আলা : ১৪-১৫
[12] আবু দাউদ, ইবনে মাজা
_________________________________________________________________________________

লেখক : শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-উসাইমীন
অনুবাদক: মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম চান্দ মিয়াঁ - সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদক: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

Saturday, November 9, 2019

মহিলাদের দাওয়াতি কাজের হুকুম



▌মহিলাদের দাওয়াতি কাজের হুকুম

·
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও মুজাদ্দিদ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) কে প্রশ্ন করা হয় (শাইখ প্রশ্নটি পড়ছেন, যেটি সম্ভবত কোনো বোনের পক্ষ থেকে), “এখানে একটি প্রশ্ন যেটাকে আমার খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে: দা‘ওয়াহ দেয়ার সর্বোত্তম উপায় কী? দা‘ওয়াহ কীভাবে দেওয়া হয়?”

উত্তর: ❝নারীদের আমি বলছি, তোমরা তোমাদের বাড়িতে থাকো। দা‘ওয়াহর কাজটি তোমাদের চিন্তার বিষয় নয়। আমি তরুণদের মাঝে দা‘ওয়াহ শব্দটির (এরূপ) ব্যবহার প্রত্যাখ্যান করি যে, “এরা হলো দা‘ঈ”, যেনো দা‘ওয়াহ যুগের একটি ফ্যাশন হয়ে গিয়েছে। যে কারো কিছু পরিমাণ ‘ইলম রয়েছে, সে একজন দা‘ঈ হয়ে গিয়েছে। এটি শুধু অল্পবয়স্ক ছেলেদের আক্রান্ত করেনি, এটি অল্পবয়স্ক মেয়েদের এবং গৃহ অভ্যন্তরীণ নারীদের পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। তারা তাদের বাড়ির ও স্বামীর প্রতি দায়িত্ব থেকে দূরে সরে গিয়েছে এবং এমন জিনিসের অভিমুখী হয়েছে যা তাদের জন্য ওয়াজিব না, অর্থাৎ দা‘ওয়াহর কাজ করা। পূর্বের একটি প্রশ্ন একজন নারীর ব্যাপারে ছিলো যে আমার কুয়েতের মিটিং এর রেকর্ডিং থেকে শুনেছে যে নারীদের জন্য দা‘ওয়াহর কাজে বাইরে যাওয়া জায়েজ না। এবং এখানে এই প্রশ্নে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, "দা‘ওয়াহ দেয়ার সর্বোত্তম উপায় কি? দা‘ওয়াহ কীভাবে দেয়া হয়?" বিধান হলো একজন নারী বাড়িতে থাকবে এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তার জন্য বাইরে যাওয়া জায়েজ না। পূর্বে আমরা নাবী ﷺ এর বাণী উল্লেখ করেছি, “আর মসজিদে সালাত আদায়ের চেয়ে তাদের বাড়ি তাদের জন্য উত্তম।” বর্তমানে আমরা নারীদের মধ্যে একটি বহুবিস্তৃত ব্যাপার দেখি তা হলো, জুম‘আহ ছাড়াও জামা‘আতে সালাত আদায় করতে খুব বেশি মসজিদে যাওয়া। তাদের বাড়ি তাদের জন্য উত্তম, তবে যেমনটি আমি পূর্বে বলেছি, মসজিদের ইমাম যদি জ্ঞানী হন এবং যারা উপস্থিত আছেন তাদের দ্বীনের ব্যাপারে কিছু শেখান, আর এতে করে একজন নারী মাসজিদে সালাত আদায় করতে ও ‘ইলম নিতে যায়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু দা‘ওয়াহর কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়াটা, (তাহলে এটা জায়েজ না), তার উচিৎ বাড়িতে থাকা এবং তার স্বামী, অথবা ভাই, অথবা অন্য মাহরাম আত্মীয়দের দেয়া কিতাবাদি পড়া। তা করার পর এটা করা তার জন্য ঠিক আছে যে সে একটি দিন নির্ধারণ করবে এবং অন্য নারীদের তার বাড়িতে আসার দাওয়াত দিবে, অথবা সে অন্য কোনো নারীর বাড়িতে যাবে, একদল নারী বাইরে যাওয়ার চেয়ে এটি উত্তম, তাদের একজনের অন্যদের কাছে যাওয়াটা অন্যদের সকলের তার নিকট আসা থেকে উত্তম। আর (দা‘ওয়াহর জন্য) তার ভ্রমণে বের হওয়া হলো বর্তমান সময়ের একটি বিদ‘আত, যা এমনকি মাহরাম ছাড়াও হয়ে থাকে। আর আমি এটি শুধু নারীদের ব্যাপারেই বলছি না, এটা ওইসব তরুণ ছেলেদের জন্যও প্রযোজ্য যারা দা‘ওয়াহ বিষয়ে কথা বলতে পছন্দ করে, যদিও তাদের ‘ইলমের স্তর অগভীর।❞

·
তথ্যসূত্র:

https://youtu.be/kmu7QdqmSW0 [Manhaj ul-Haqq (সালাফী ইউটিউব চ্যানেল)]

·
অনুবাদক: রিফাত রাহমান সিয়াম
www.facebook.com/SunniSalafiAthari

ইয়াযীদের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ’র অবস্থান



▌ইয়াযীদের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ’র অবস্থান

·
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফতোয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটি (আল-লাজনাতুদ দা’ইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) প্রদত্ত ফতোয়ায় বলা হয়েছে—

وأما يزيد بن معاوية فالناس فيه طرفان ووسط، وأعدل الأقوال الثلاثة فيه أنه كان ملكًا من ملوك المسلمين له حسنات وسيئات ولم يولد إلاَّ في خلافة عثمان رضي الله عنه، ولم يكن كافرًا ولكن جرى بسببه ما جرى من مصرع الحسين وفعل ما فعل بأهل الحرة، ولم يكن صاحبًا ولا من أولياء الله الصالحين. قال شيخ الإِسلام ابن تيمية رحمه الله : وهذا قول عامة أهل العقل والعلم والسنة والجماعة، وأما بالنسبة للعنه فالناس فيه ثلاث فرق: فرقة لعنته، وفرقة أحبته، وفرقة لا تسبه ولا تحبه، قال شيخ الإِسلام ابن تيمية رحمه الله تعالى: وهذا هو المنصوص عن الإِمام أحمد وعليه المقتصدون من أصحابه وغيرهم من جميع المسلمين، وهذا القول الوسط مبني على أنه لم يثبت فسقه الذي يقتضي لعنه أو بناء على أن الفاسق المعين لا يلعن بخصوصه إما تحريمًا وإما تنزيهًا، فقد ثبت في [ صحيح البخاري ] عن عمر في قصة عبد الله بن حمار الذي تكرر منه شرب الخمر وجلده رسول الله صلى الله عليه وسلم لما لعنه بعض الصحابة قال النبي صلى الله عليه وسلم: لا تلعنه، فإنه يحب الله ورسوله ، وقال صلى الله عليه وسلم: لعن المؤمن كقتله متفق عليه.
وهذا كما أن نصوص الوعيد عامة في أكل أموال اليتامى والزنا والسرقة فلا يشهد بها على معين بأنه من أصحاب النار لجواز تخلف المقتضى عن المقتضي لمعارض راجح: إما توبته، وإما حسنات، وإما مصائب مكفرة، وإما شفاعة مقبولة، وغير ذلك من المكفرات للذنوب هذا بالنسبة لمنع سبه ولعنه. وأما بالنسبة لترك المحبة فلأنه لم يصدر منه من الأعمال الصالحة ما يوجب محبته، فبقي واحدًا من الملوك السلاطين، ومحبة أشخاص هذا النوع ليست مشروعة، ولأنه صدر عنه ما يقتضي فسقه وظلمه في سيرته، وفي أمر الحسين وأمر أهل الحرة. وبالله التوفيق. وصلى الله على نبينا محمد، وآله وصحبه وسلم.

“ইয়াযীদ বিন মু‘আউয়িয়াহর ব্যাপারে মানুষ দুটো প্রান্তিক ও একটি মধ্যপন্থি দলে বিভক্ত। ইয়াযীদের ব্যাপারে তিনটি অভিমতের মধ্যে সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ মত হলো—সে মুসলিমদের একজন রাজা ছিল, তার ভালোকর্ম ছিল, আবার মন্দকর্মও ছিল। সে ‘উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র খেলাফত-আমলে জন্মগ্রহণ করে। সে কাফির ছিল না। কিন্তু তার কারণে হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র হত্যাকাণ্ড ও হার্রাহ’র যুদ্ধের মতো ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। সে না ছিল সাহাবী, আর না ছিল সৎকর্মপরায়ণ আল্লাহ’র ওলি।

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “এটাই অধিকাংশ প্রাজ্ঞ ও বিবেকবান আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অভিমত।” [১]

আর ইয়াযীদকে লানত করার ব্যাপারেও মানুষ তিনটি দলে বিভক্ত। একদল ইয়াযীদকে লানত করে। একদল ইয়াযীদকে ভালোবাসে। আরেক দল ইয়াযীদকে গালি দেয় না, আবার ভালোও বাসে না। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “ইমাম আহমাদ এই মত ব্যক্ত করেছেন। আর এই মতের ওপরই রয়েছেন ইমাম আহমাদের অনুসারী ও অন্যান্য মুসলিমদের মধ্য থেকে মধ্যপন্থি ব্যক্তিবর্গ।”

এই মধ্যপন্থি মত এ বিষয়ের ওপর ভিত্তিশীল যে, ইয়াযীদের এমন কোনো পাপকাজ প্রমাণিত হয়নি, যা তাকে লানত করার দাবি করে; অথবা নির্দিষ্টভাবে একজন পাপী লোককে লানত করা হয় হারাম আর নাহয় মাকরূহে তানযীহী (অপছন্দনীয় কর্ম)। সাহীহ বুখারীতে ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ বিন হিমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বেশ কয়েকবার মদ্যপান করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বেত্রাঘাত করেছিলেন। এ কারণে জনৈক সাহাবী ওই মদ্যপায়ী সাহাবীকে লানত করেন। তখন নাবী ﷺ বলেন, “তুমি ওকে লানত কোরো না। নিশ্চয় সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে।” [২]

নাবী ﷺ অন্যত্র বলেছেন, “মুমিনকে লানত করা হত্যার সমতুল্য।” [৩]

ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, জেনায় লিপ্ত হওয়া, চুরি করা প্রভৃতি পাপের ক্ষেত্রে যেসব ব্যাপকার্থবোধক ও শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞাযুক্ত দলিল বর্ণিত হয়েছে, সেসব দলিলের ভিত্তিতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে এরকম সাক্ষ্য দেওয়া যায় না যে, সে ব্যক্তি জাহান্নামী। কেননা বিভিন্ন অগ্রাধিকারযোগ্য কারণে এরকম বিষয় বিমোচিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। হয়তো সে তওবা করেছে, অথবা তার পুণ্যকর্ম আছে, কিংবা সে পাপমোচনকারী দুর্যোগে পতিত হয়েছে, অথবা তার জন্য কারও কৃত শাফায়াত (সুপারিশ) গৃহীত হয়েছে, কিংবা এগুলো ছাড়াও তার অন্য কোনো পাপমোচনকারী বিষয় সংঘটিত হয়েছে। এটা গেল গালি না দেওয়া ও লানত না করার প্রসঙ্গ।

পক্ষান্তরে ইয়াযীদকে না ভালোবাসার কারণ—তার থেকে এমন কোনো ভালো কাজ প্রকাশিত হয়নি, যা তার ভালোবাসাকে জরুরি করে। সে একজন শাসক বা রাজা মাত্র। এ ধরনের লোককে ভালোবাসা শরিয়তসম্মত (বিধেয়) নয়। তাছাড়া ইয়াযীদের জীবনীতে এবং হুসাইন ও হার্রাহ-সংক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের ঘটনায় তার নিকট থেকে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা দাবি করে যে, সে একজন ফাসেক ও জালেম ছিল।

আর আল্লাহই তৌফিকদাতা। হে আল্লাহ, আমাদের নাবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর আপনি দয়া ও শান্তি বর্ষণ করুন।”

ফতোয়া প্রদান করেছেন—
চেয়ারম্যান: শাইখ ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)।
ডেপুটি চেয়ারম্যান: শাইখ ‘আব্দুর রাযযাক্ব ‘আফীফী (রাহিমাহুল্লাহ)।
মেম্বার: শাইখ ‘আব্দুল্লাহ বিন গুদাইয়্যান (রাহিমাহুল্লাহ)।

·
পাদটীকা:
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂

[১]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪০৯ ও ৪১৪; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪৪৩, ৪৮৪ ও ৫০৬।

[২]. সাহীহ বুখারী, হা/৬৭৮০।

[৩]. সাহীহ বুখারী, হা/৬১০৫; সাহীহ মুসলিম, হা/১১০।

·
তথ্যসূত্র:

ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৮৫-২৮৬; ফতোয়া নং: ১৪৬৬; ফতোয়ার আরবি টেক্সট আজুর্রি (ajurry) ডট কম থেকে সংগৃহীত।

·
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/SunniSalafiAthari

মহিলাদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার শার‘ঈ নীতিমালা



▌মহিলাদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার শার‘ঈ নীতিমালা

·
আলজেরিয়ার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, ড. মুহাম্মাদ ‘আলী ফারকূস (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৭৪ হি./১৯৫৪ খ্রি.] প্রদত্ত ফতোয়া—

প্রশ্ন: “বাজারে যাওয়ার সময় মহিলার সাথে কি মাহরাম থাকা শর্ত? জাযাকুমুল্লাহু খাইরা।”

উত্তর: ❝যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ’র জন্য। দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর ওপর, যাঁকে আল্লাহ প্রেরণ করেছেন বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ, এবং দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর পরিবার পরিজন, সঙ্গিবর্গ ও কেয়ামত অবধি আসতে থাকা তাঁর ভ্রাতৃমণ্ডলীর ওপর। অতঃপর:

যদি মহিলার এমন কোনো প্রয়োজন থাকে, যার ফলে তার বাড়ির বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়—যেমন: চিকিৎসা নেওয়া, বাজারসদাই করা, মসজিদে যাওয়া প্রভৃতি—তাহলে তার দ্বীন পালনের স্বার্থে ও স্বাস্থ্য রক্ষার্থে বাড়ির বাইরে বের হওয়া জায়েজ। কেননা নাবী ﷺ সাওদাহ বিনতে যাম‘আহর উদ্দেশে বলেছেন, قَدْ أَذِنَ اللهُ لَكُنَّ أَنْ تَخْرُجْنَ لِحَوَائِجِكُنَّ “আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।” [সাহীহ বুখারী, হা/৫২৩৭; সাহীহ মুসলিম, হা/২১৭০]

তবে প্রয়োজনের কারণে বৈধভাবে বাইরে যেতে হলে অবশ্যই তা শরিয়তের একগুচ্ছ নীতিমালার মাধ্যমে পরিবেষ্টিত হতে হবে। নিম্নে মহিলাদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার শার‘ঈ নীতিমালা ধারাবাহিকভাবে আলোকপাত করা হলো।

প্রথমত, মহিলাকে তার অভিভাবক কিংবা তার স্বামীর অনুমতি নিয়ে বের হতে হবে, এবং তার বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে স্বামীর সন্তুষ্টি থাকতে হবে। মূলত উক্ত শর্ত যাবতীয় ভালোকাজে স্বামীর আনুগত্য করার আওতাভুক্ত। যাতে করে তাদের দাম্পত্যজীবন হয় সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ও কলহমুক্ত। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন, فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ “পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে ওই বিষয়ের হেফাজত করে, যা আল্লাহ হেফাজত করেছেন।” [সূরাহ নিসা: ৩৪]

নাবী ﷺ বলেছেন, إِذَا صَلَّتِ الْمَرْأَةُ خَمْسَهَا، وَصَامَتْ شَهْرَهَا، وَحَفِظَتْ فَرْجَهَا، وَأَطَاعَتْ زَوْجَهَا؛ قِيلَ لَهَا: ادْخُلِي الْجَنَّةَ مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ الجَنَّةِ شِئْتِ “যদি কোনো মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানের রোজা রাখে, নিজের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করে, তাহলে তাকে বলা হবে, তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে খুশি সে দরজা দিয়ে তাতে প্রবেশ করো।” [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৬১; সাহীহুল জামি‘, হা/৬৬১; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

নাবী ﷺ আরও বলেছেন, إِذَا اسْتَأْذَنَكُمْ نِسَاؤُكُمْ بِاللَّيْلِ إِلَى المَسْجِدِ فَأْذَنُوا لَهُنَّ “তোমাদের স্ত্রীগণ রাত্রিবেলায় তোমাদের কাছে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তোমরা তাদের অনুমতি দাও।” [সাহীহুল বুখারী, হা/৮৬৫; সাহীহ মুসলিম, হা/৪৪২]

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মসজিদে যাওয়ার জন্যই যদি অনুমতির প্রয়োজন হয়, তাহলে বাজারসদাই করা বা অন্যান্য কাজের জন্য বাইরে যেতে হলে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আরও বেশি, আরও উপযোগী।

দ্বিতীয়ত, মহিলা তার স্বামী বা অভিভাবকের সম্পদ থেকে কেবল ততটুকু নিবে, যতটুকু নেওয়ার অনুমতি তাকে দেওয়া হয়েছে। স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতি ও পরামর্শ না নিয়ে সে সম্পদ খরচে স্বেচ্ছাচারিতা করবে না; এমনকি মহিলা তার নিজের সম্পদ খরচেও স্বেচ্ছাচারিতা করবে না। যাতে করে মহিলার ওপর তার স্বামীর পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় থাকে। কেননা নাবী ﷺ বলেছেন, وَلَيْسَ لِلْمَرْأَةِ أَنْ تَنْتَهِكَ شَيْئًا مِنْ مَالِهَا إِلَّا بِإِذْنِ زَوْجِهَا “কোনো মহিলার জন্য বৈধ নয় যে, সে তার স্বামীর অনুমতি ব্যতীত তার নিজের সম্পদ নষ্ট করবে।” [ত্বাবারানী, মু‘জামুল কাবীর, ২২/৮৩; সাহীহুল জামি‘, হা/৫৪২৪; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

তৃতীয়ত, যদিও সফর ব্যতীত অন্যক্ষেত্রে মহিলার জন্য মাহরাম থাকা ওয়াজিব নয়, তথাপি সে কোনো বিশ্বস্ত সখীর সাথে বাইরে বেরোবে। যাতে তার ইজ্জত-আবরু ও দ্বীন-ধর্ম নিরাপদে থাকে। কেননা নাবী ﷺ বলেছেন, لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ تُسَافِرُ مَسِيرَةَ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ عَلَيْهَا “আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, এমন মহিলার জন্য বিনা মাহরামে একদিন ও একরাতের পথ সফর করা জায়েজ নয়।” [সাহীহ বুখারী, হা/১০৮৮; সাহীহ মুসলিম, হা/১৩৩৯]

নতুবা একাকী বাজারে বের হলে সে ফেতনা, ফাসাদ ও অনিষ্ট ডেকে আনে—এমন বিষয়ের সম্মুখীন হতে পারে। কেননা নাবী ﷺ বলেছেন, خَيْرُ البِقَاعِ المَسَاجِدُ، وَشَرُّ البِقَاعِ الأَسْوَاقُ “সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদ। আর সর্বনিকৃষ্ট স্থান হলো বাজার।” [ত্বাবারানী, মু‘জামুল কাবীর, হা/১৩৭৯৮, হাকেম, মুস্তাদরাক, হা/৩০৬; সাহীহুল জামি‘, হা/৫৪২৪; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

চতুর্থত, মহিলা বাজারের পানে বাড়ি থেকে বের হলে, নিজের সম্পূর্ণ শরীর পর্দা দিয়ে আবৃত করবে। তার জন্য সৌন্দর্য প্রকাশ করে, সুগন্ধি ব্যবহার করে, নানাবিধ অলঙ্কার দ্বারা সুশোভিত হয়ে, সৌন্দর্যবর্ধক পাউডার ব্যবহার করে, অর্ধনগ্ন পোশাক পরিধান করে, অহংকারী হয়ে, নিজের দেহসৌষ্ঠব ও রূপের ব্যাপারে আত্মগর্বিতা হয়ে, পুরুষদেরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে বাইরে বের হওয়া না-জায়েজ। তাই পোশাক ও লজ্জার ভূষণে নিজেকে আবৃত করা তার জন্য আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেছেন, وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ “আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে; প্রাক-জাহেলি যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না।” [সূরাহ আহযাব: ৩৩]

মহান আল্লাহ আরও বলেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا “হে নাবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিন নারীদেরকে বলো, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। বস্তুত আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরাহ আহযাব: ৫৯]

নাবী ﷺ বলেছেন, وأَيُّمَا امْرَأَةٍ وَضَعَتْ ثِيَابَهَا فِي غَيْرِ بَيْتِ زَوْجِهَا فَقَدْ هَتَكَتْ سِتْرَ مَا بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللهِ “যে নারী তার স্বামীর বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও তার কাপড় খোলে, সে আল্লাহ ও তার মধ্যকার পর্দা ছিঁড়ে ফেলে।” [সুনানে তিরমিযী, হা/২৮০৩; সাহীহুল জামি‘, হা/২৭১০; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

নাবী ﷺ আরও বলেছেন, ثَلَاثَةٌ لَا تَسْأَلْ عَنْهُمْ، وفيه: وَامْرَأَةٌ غَابَ عَنْهَا زَوْجُهَا قَدْ كَفَاهَا مُؤْنَةَ الدُّنْيَا فَتَبَرَّجَتْ بَعْدَهُ “তিন ব্যক্তিকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না (সরাসরি জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে)। তার মধ্যে রয়েছে ওই নারী, যার স্বামী বাইরে গিয়েছে, তার দুনিয়ার খোরপোশের জোগান দিতে, অথচ সে (স্বামীর অনুপস্থিতিতে) তার সৌন্দর্য প্রকাশ করেছে।” [মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৯৪৩, আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৯০; সিলসিলাহ সাহীহাহ, হা/৫৪২; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

নাবী ﷺ অন্যত্র বলেছেন, وَشَرُّ نِسَائِكُمُ المُتَبَرِّجَاتُ المُتَخَيِّلَاتُ وَهُنَّ المُنَافِقَاتُ، لَا يَدْخُلُ الجَنَّةَ مِنْهُنَّ إِلَّا مِثْلُ الْغُرَابِ الأَعْصَمِ “তোমাদের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট নারী তারাই, যারা সৌন্দর্য প্রকাশ করে, আর অহংকার করে। তারা তো মুনাফেক রমনী। ওই নারীদের মধ্য থেকে ‘সাদা পা-বিশিষ্ট কাকের মতো’ অতীব বিরল সংখ্যক নারী জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [বাইহাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/১৩৪৭৮; সিলসিলাহ সাহীহাহ, হা/১৮৪৯; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

নাবী ﷺ বলেছেন, أَيُّمَا امْرَأَةٍ اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ عَلَى قَوْمٍ لِيَجِدُوا مِنْ رِيحِهَا فَهِيَ زَانِيَةٌ “কোনো নারী যদি সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, আর সম্প্রদায়ের লোকেরা তার ঘ্রাণ পায়, তাহলে সে একজন ব্যভিচারিণী।” [সুনানে নাসায়ী, হা/৫১২৬; সাহীহুল জামি‘, হা/২৭০১; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

নাবী ﷺ আরও বলেছেন, صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، وذَكَر: وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ المَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الجَنَّةَ وَلَا يَجِدْنَ رِيحَهَا، وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا “দুই শ্রেণির জাহান্নামীকে আমি কখনো দেখিনি। তার মধ্যে এক শ্রেণি হলো—ওই সমস্ত নারী, যারা কাপড় পরিধান করেও উলঙ্গ। তারা পুরুষদের আকর্ষণ করবে এবং নিজেরাও তাদের দিকে আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা হবে উটের পিঠের কুঁজোর মতো। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি এত এত দূর থেকে পাওয়া যায়।” [সাহীহ মুসলিম, হা/২১২৮; ‘পোশাক-পরিচ্ছদ ও প্রসাধনী’ অধ্যায়]

পঞ্চমত, সে যখন বাজারে বা অন্য কোথাও যাবে, তখন সে তার স্বামী অথবা অভিভাবকের আমানত রক্ষা করবে। সে কোনোভাবেই তার স্বামী বা অভিভাবকের সাথে খেয়ানত করবে না। তাই সে কোনো পরপুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করবে না, এমনকি ইতস্তত দৃষ্টিতেও পরপুরুষকে দেখবে না। সে পরপুরুষের সাথে সম্মোহনকারী প্রলোভিত কথা বলবে না এবং নিষিদ্ধ অবাধ মেলামেশায় লিপ্ত হবে না। সে স্বামী বা অভিভাককে ধোঁকা দিয়ে পরপুরুষের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবে না এবং পাপাচারমূলক সাক্ষাতে লিপ্ত হবে না। বস্তুত এগুলো এমন সব কাজ, যা তার দ্বীন-ধর্ম ও ইজ্জত-আবরুকে কদর্য করে দেয়। সুতরাং স্বীয় চোখের চাহনি অবনমিত করা, গলার আওয়াজ নিচু করা এবং স্বীয় জবান ও হাতকে অন্যায়, অশ্লীলতা ও কদর্যতা থেকে হেফাজত করা তার জন্য অপরিহার্য—ওয়াজিব।

কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ “পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে ওই বিষয়ের হেফাজত করে, যা আল্লাহ হেফাজত করেছেন।” [সূরাহ নিসা: ৩৪]

মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, وَقُل لِّلْمُؤْمِنَٰتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَٰرِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَاۖ “আপনি মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে।” [সূরাহ নূর: ৩১]

মহান আল্লাহ বলেছেন, يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِىِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ ٱلنِّسَآءِۚ إِنِ ٱتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِٱلْقَوْلِ فَيَطْمَعَ ٱلَّذِى فِى قَلْبِهِۦ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا “হে নাবীপত্নীরা, তোমরা অন্য নারীদের মতো নও। যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করে থাক, তাহলে পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বল না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। বরং তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।” [সূরাহ আহযাব: ৩২]

মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, لَّا يُحِبُّ ٱللَّهُ ٱلْجَهْرَ بِٱلسُّوٓءِ مِنَ ٱلْقَوْلِ إِلَّا مَن ظُلِمَۚ وَكَانَ ٱللَّهُ سَمِيعًا عَلِيمًا “আল্লাহ কোনো মন্দকথার প্রচারণা ভালোবাসেন না, তবে কেউ অত্যাচারিত হয়ে থাকলে তার কথা স্বতন্ত্র; বস্তুত আল্লাহ শ্রবণকারী মহাজ্ঞানী।” [সূরাহ নিসা: ১৪৮]

ষষ্ঠত, মহিলার জন্য বাইরে বের হওয়ার সময় পরপুরুষদের সাথে অবাধ মেলামেশায় লিপ্ত হওয়া জায়েজ নয়। যেমনভাবে তার জন্য বৈধ নয়—কোনো পরপুরুষের ব্যবসাকেন্দ্রে বা অন্য কোনো জায়গায় একাকী সেই পরপুরুষের কাছে প্রবেশ করে তার সাথে হারাম নির্জনতা অবলম্বন করা। ফিতনার রাস্তা রুদ্ধ করার জন্যই তা বৈধ নয়। যেহেতু সে কুনজর, কুকথা ও কুকর্মের বেষ্টন থেকে নিরাপদ নয়। কেননা অন্তর যে কাজের প্রতি প্ররোচিত করে, আর শয়তান যে কাজ করার কুমন্ত্রণা দেয়, সে কাজের পুরো পরিণামই কেবল ক্ষতি আর ক্ষতি, নিন্দা আর নিন্দা! তাইতো নাবী ﷺ বলেছেন, أَلَا لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ “কোনো মহিলা পরপুরুষের সাথে একাকী মিলিত হলেই, তাদের তৃতীয়জন হিসেবে সেখানে উপস্থিত হয় শয়তান।” [সুনানে তিরমিযী, হা/২১৬৫; সাহীহুল জামি‘, হা/২৫৪৬; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

সপ্তম ও সর্বশেষ মূলনীতি হলো—মহিলা যদি তার দ্বীন ও দুনিয়ার প্রয়োজনে বাইরে বেরও হয়, তথাপি তার স্কন্ধে যে আমানত অর্পিত হয়েছে, তার দাবি অনুযায়ী তার জন্য স্বেচ্ছাচারিতা করে এমন কাজ করা জায়েজ নয়, যা আল্লাহ’র কাছে পছন্দনীয় নয়। তাই সে এমন জায়গায় যাবে না, যেখানে অসার ক্রিয়াকলাপ ও পাপাচার সংঘটিত হয়। সে এমন জায়গায় যাবে না, যেসব জায়গা অশ্লীল কর্মকাণ্ডে ভরপুর, অথবা যেসব জায়গায় মন্দ ও অকল্যাণ ছড়ানো হয়; সাধারণত যে জায়গাগুলোতে অসভ্য ও ইতর শ্রেণির লোকেরাই যেয়ে থাকে। কেননা সন্দেহাতীতভাবে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারমূলক পদচারণা আমানতের খেয়ানত, নিজের বিনাশ এবং ধ্বংস ও দুর্যোগে নিপাতিত হওয়ার অসিলা।

বস্তুত প্রকৃত ‘ইলম আল্লাহ’র নিকট রয়েছে। সর্বোপরি যাবতীয় প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালকের জন্য। হে আল্লাহ, আমাদের নাবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার পরিজন, সাহাবীবর্গ ও কেয়ামত অবধি আসতে থাকা তাঁর ভ্রাতৃবর্গের ওপর আপনি দয়া ও শান্তি বর্ষণ করুন।❞

·
তথ্যসূত্র:

https://ferkous.com/home/?q=fatwa-451।

·
অনুবাদক: ‘আব্দুর রাহমান মৃধা
www.facebook.com/SunniSalafiAthari

Sunday, August 25, 2019

বিদ‘আতীদের খণ্ডন করা আবশ্যক, আর তাদের ব্যাপারে চুপ থাকা নিষিদ্ধ


▌বিদ‘আতীদের খণ্ডন করা আবশ্যক, আর তাদের ব্যাপারে চুপ থাকা নিষিদ্ধ

·
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর:

এটি সুবিদিত যে, বিদ‘আত একটি গর্হিত অপরাধ এবং অন্যায় কাজ। বিদ‘আতের ভয়াবহতা উপলব্ধি করার জন্য এই দুটি হাদীসই যথেষ্ট, ইনশাআল্লাহ:
ক. নাবী ﷺ বলেছেন, “(দ্বীনের মধ্যে) যাবতীয় নবআবিষ্কৃত বিষয় থেকে সাবধান! কারণ প্রত্যেক নবআবিষ্কৃত বিষয় হলো বিদ‘আত, আর প্রত্যেক বিদ‘আত হলো ভ্রষ্টতা।” [আবূ দাউদ, হা/৪৬০৭; সনদ: সাহীহ]

·
খ. নাবী ﷺ বলেছেন, “আমি তোমাদের আগে হাউযের নিকট পৌঁছব। যে আমার নিকট দিয়ে অতিক্রম করবে, সে হাউযের পানি পান করবে। আর যে পান করবে সে কখনো পিপাসার্ত হবে না। নিঃসন্দেহে কিছু সম্প্রদায় আমার সামনে (হাউযে) উপস্থিত হবে। আমি তাদেরকে চিনতে পারব আর তারাও আমাকে চিনতে পারবে। এরপর আমার এবং তাদের মাঝে আড়াল করে দেয়া হবে। আমি তখন বলব, এরা তো আমারই উম্মত। তখন বলা হবে, আপনি তো জানেন না আপনার পরে এরা (দ্বীনের মধ্যে) কী সব নতুন নতুন কথা ও কাজ (বিদ‘আত) সৃষ্টি করেছে। রাসূল ﷺ বলেছেন, তখন আমি বলব, আমার পরে যারা দ্বীনের ভিতর পরিবর্তন এনেছে, তারা দূর হও, দূর হও!” [সাহীহ বুখারী, হা/৬৫৮৩-৬৫৮৪]

আর মহান আল্লাহ বলেছেন, لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرائيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ، كَانُواْ لاَ يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُواْ يَفْعَلُونَ “বানী ইসরাঈলের মধ্যে যারা অবিশ্বাস করেছিল, তারা দাঊদ ও মারইয়াম তনয় ‘ঈসা কর্তৃক অভিশপ্ত হয়েছিল। কেননা তারা ছিল অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী। তারা যেসব গর্হিত কাজ করত তা থেকে তারা একে অন্যকে নিষেধ করত না। নিশ্চয় তারা যা করত তা কতইনা নিকৃষ্ট!” [সূরাহ মাইদাহ: ৭৮-৭৯]

·
ত্বারিক্ব ইবনু শিহাব (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেছেন,

أَوَّلُ مَنْ بَدَأَ بِالْخُطْبَةِ يَوْمَ الْعِيدِ قَبْلَ الصَّلاَةِ مَرْوَانُ فَقَامَ إِلَيْهِ رَجُلٌ فَقَالَ الصَّلاَةُ قَبْلَ الْخُطْبَةِ.‏ فَقَالَ قَدْ تُرِكَ مَا هُنَالِكَ‏.‏ فَقَالَ أَبُو سَعِيدٍ أَمَّا هَذَا فَقَدْ قَضَى مَا عَلَيْهِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ: مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ.

“মারওয়ান সর্বপ্রথম ‘ঈদের দিন সালাতের পূর্বে খুত্ববাহ দেয়ার (বিদ‘আতী) প্রথা প্রচলন করেন। এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, খুত্ববাহ’র আগে সালাত (সম্পন্ন করুন)। মারওয়ান বললেন, এখন থেকে সে নিয়ম পরিত্যাগ করা হল। তখন সাহাবী আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন, ওই ব্যক্তি তার কর্তব্য পালন করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি, তোমাদের কেউ গৰ্হিত কাজ হতে দেখলে সে যেন স্বহস্তে (শক্তি প্রয়োগে) তা পরিবর্তন করে, যদি তার সে ক্ষমতা না থাকে, তবে জবান দ্বারা তা পরিবর্তন করবে। আর যদি সে সাধ্যও না থাকে, তখন অন্তর দ্বারা করবে, তবে এটা ঈমানের সবচেয়ে দুর্বলতম অবস্থা।” [সাহীহ মুসলিম, হা/৪৯; ‘ঈমান’ অধ্যায়; পরিচ্ছেদ- ২০]

‘আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَا مِنْ نَبِيٍّ بَعَثَهُ اللَّهُ فِي أُمَّةٍ قَبْلِي إِلاَّ كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لاَ يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لاَ يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ‏.

“আমার পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা যে নাবীকেই কোনো উম্মতের মধ্যে পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে তাঁর জন্য একদল অনুসারী ও সঙ্গী ছিল। তারা তাঁর আদর্শকে সমুন্নত রাখত এবং তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করত। তারপর তাদের অবর্তমানে কতগুলো মন্দ লোক স্থলাভিষিক্ত হয়। তারা মুখে যা বলে নিজেরা তা করে না। আর (দ্বীনের ব্যাপারে) যা করে, তার জন্য তাদেরকে নির্দেশ করা হয়নি (অর্থাৎ, বিদ‘আত)। অতএব যে ব্যক্তি তাদেরকে হাত (শক্তি) দ্বারা মোকাবিলা করবে, সে মু’মিন। যে ব্যক্তি জবান দারা মোকাবিলা করবে সে মু’মিন এবং যে ব্যক্তি অন্তর দ্বারা মোকাবিলা করবে সেও মু’মিন। এরপর আর সরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নেই।” [সাহীহ মুসলিম, হা/৫০; ‘ঈমান’ অধ্যায়; পরিচ্ছেদ- ২০]

·
মুহাম্মাদ বিন বুনদার সাব্বাক আল-জুরজানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, একদা আমি আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪১ হি.] কে বললাম,
إنه ليشتد علي أن أقول: فلان ضعيف، فلان كذاب، قال أحمد: إذا سكت أنت و سكت أنا فمن يعرف الجاهل الصحيح من السقيم.
“অমুক দ্ব‘ঈফ (দুর্বল), অমুক কাযযাব (মিথ্যুক)– বলা আমার কাছে খুব ভারী মনে হয়।” আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বললেন, “কিন্তু তুমি যদি চুপ থাক, আর আমিও যদি চুপ থাকি, তাহলে অজ্ঞ মানুষকে সাহীহ-দ্ব‘ঈফ জানাবে কে?” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২৮; পৃষ্ঠা: ২৩১; বাদশাহ ফাহাদ প্রিন্টিং প্রেস, মাদীনাহ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি. (বাদশাহ ফাহাদ রাহিমাহুল্লাহ’র রাজকীয় ফরমানে মুদ্রিত)]

ইমাম আবূ মুহাম্মাদ হাসান বিন ‘আলী বিন খালফ আল-বারবাহারী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৩২৯ হি.] বলেছেন,
واعلم أن الخروج عن الطريق على وجهين: أما أحدهما فرجل قد زل عن الطريق، وهو لا يريد إلا الخير؛ فلا يقتدى بزلته فإنه هالك، ورجل عاند الحق وخالف من كان قبله من المتقين؛ فهو ضالّ مضِلّ، شيطان مريد في هذه الأمة، حقيقٌ على من عرفه أن يحذر الناس منه، ويبين للناس قصته، لئلا يقعَ في بدعته أحدٌ فيهلكَ.
“জেনে রেখো, সঠিক পথ থেকে বের হয়ে যাওয়া দুই ধরনের হয়ে থাকে। হয় ব্যক্তি পথ ভুল করেছে, অথচ সে স্রেফ কল্যাণের অভিলাষীই ছিল। এক্ষেত্রে তাঁর ভুলের অনুসরণ করা যাবে না। নতুবা সে (জেনেশুনে ভুলের অনুসরণকারী) ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আর না হয় ব্যক্তি সত্য গ্রহণে হঠকারিতা করেছে এবং তার পূর্ববর্তী মুত্তাক্বী ব্যক্তিদের বিরোধিতা করেছে। এই ব্যক্তি নিজে ভ্রষ্ট এবং অপরকে ভ্রষ্টকারী। সে এই উম্মতের অবাধ্য শয়তান। যে ব্যক্তি তার প্রকৃত অবস্থা জানে, তার উচিত ওর থেকে মানুষকে সতর্ক করা এবং ওর ঘটনা মানুষের কাছে বর্ণনা করা। যাতে করে কেউ ওর বিদ‘আতে পতিত হয়ে ধ্বংস না হয়।” [ইমাম বারবাহারী (রাহিমাহুল্লাহ), শারহুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা: ৬৯-৭০; মাকতাবাতুল গুরাবাইল আসারিয়্যাহ, মাদীনাহ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৪ হি./১৯৯৩ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]

·
ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] পূর্বোক্ত কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন,

هذا الذي خرج عن الحق متعمدًا لا يجوز السكوت عنه بل يجب أن يكشف أمره ويفضح خزيه حتى يحذره الناس ولا يقال: الناس أحرار في الرأي، حرية الكلمة، إحترام الرأي الآخر، كما يدندنون به الآن من إحترام الرأي الآخر فالمسألة ليست مسألة أرآء المسألة مسألة إتباع نحن قد رسم الله لنا طريقًا واضحًا وقال لنا سيروا عليه حينما قال وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ [ الأنعام: ١٥٣] فأي شخصٍ يأتينا ويريد منا أن نخرج عن هذا الصراط فإننا: أولا نرفض قوله. وثانيا :نبين ونحذر الناس منه ولا يسعنا السكوت عنه، لأننا إذا سكتنا عنه اقترّ به الناس، لاسيما إذا كان صاحب فصاحة ولسان وقلم وثقافة فإن الناس يغترون به فيقولون هذا مؤهل هذا من المفكرين كما هو حاصل الآن فالمسألة خطيرة جداً.
وهذا فيه وجوب الرد على المخالف عكس ما يقوله أولئك يقولون اتركوا الردود دعوا الناس كل له رأيه واحترامه وحرية الرأي وحرية الكلمة بهذا تهلك الأمة فالسلف ما سكتوا عن امثال هؤلاء بل فضحوهم وردوا عليهم لعلمهم بخطرهم على الأمة، نحن لا يسعنا ان نسكت على شرهم بل لابد من بيان ما أنزل الله وإلا فأننا نكون كاتمين من الذين قال الله فيهم: إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ [البقرة: ١٥٩] فلا يقتصر الأمر على المبتدع بل يتناول الأمر من سكت عنه فإنه يتناوله الذم والعقاب لأن الواجب البيان والتوضيح للناس وهذه وظيفة الردود العلمية المتوفرة الآن في مكتبات المسلمين كلها تذب عن الصراط المستقيم وتحذر من هؤلاء فلا يروج هذا الفكرة فكرة حرية الرأي وحرية الكلمة واحترام الآخر إلا مضلل كاتم للحق نحن قصدنا الحق ما قصدنا نجرح الناس نتكلم في الناس القصد هو بيان الحق وهذه أمانة حمّلها الله العلماء فلا يجوز السكوت عن أمثال هولاء لكن مع الأسف لو يأتي عالم يرد على أمثال هولاء قالوا هذا متسرع إلى غير ذلك من الوساوس فهذا لا يخذّل أهل العلم أن يبينوا شر دعاة الضلال لا يخذلونهم.

“যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় হক থেকে বেরিয়ে গেছে, তার ব্যাপারে চুপ থাকা বৈধ নয়। বরং তার বিষয়টি প্রকাশ করা এবং তার রহস্য উন্মোচন করা ওয়াজিব। যাতে করে মানুষ তার থেকে সতর্ক থাকতে পারে। একথা বলা হবে না যে, মানুষ তার মতপ্রকাশে স্বাধীন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, অন্যের মতকে সম্মান করতে হবে। যেমন তারা ইদানীং ‘অন্যের মতকে সম্মান করতে হবে’ বলে বকবক করছে। এটি নানাজনের মতামতের ইস্যু নয়। এটি ইত্তিবা‘ তথা অনুসরণের ইস্যু। আল্লাহ আমাদেরকে সুস্পষ্ট পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদেরকে ওই পথে চলতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, “আর এটি তো আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ করো এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ কোরো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করো।” (সূরাহ আন‘আম: ১৫৩)

সুতরাং যে ব্যক্তিই আমাদের কাছে আসে এবং চায় যে, আমরা এই পথ থেকে বের হয়ে যাই, আমরা প্রথমত তার কথা প্রত্যাখান করব। দ্বিতীয়ত, আমরা বিষয়টি বর্ণনা করব এবং তার থেকে মানুষকে সতর্ক করব। আমাদের কাছে তার ব্যাপারে চুপ থাকার কোনো স্কোপ নেই। কেননা আমরা যদি তার ব্যাপারে চুপ থাকি, তাহলে মানুষ তার দ্বারা ধোঁকাগ্রস্ত হবে। বিশেষত সে যখন বাগ্মিতা, ক্ষুরধার লেখনী ও উচ্চশিক্ষার অধিকারী হয়। কেননা মানুষ তার দ্বারা ধোঁকাগ্রস্ত হবে, আর বলবে—ইনি তো যোগ্য লোক, ইনি একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ইত্যাদি। যেমনটি বর্তমানে হচ্ছে। সুতরাং এটি খুবই বিপজ্জনক বিষয়।

এতে আমাদের জন্য শরিয়ত বিরোধীকে রদ করার আবশ্যকীয়তার বর্ণনা রয়েছে। ওই ব্যক্তিদের বক্তব্যের বিপরীতে, যারা বলে, ‘তোমরা রদ করা বাদ দাও এবং সকল মানুষকে দা‘ওয়াত দাও, প্রত্যেকের মতামতের সম্মান রয়েছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কথা বলার স্বাধীনতা আছে, একারণে উম্মত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’ সালাফগণ ওদের মত ব্যক্তিদের ব্যাপারে চুপ থাকেননি। বরং তাঁরা তাদের বিষয় প্রকাশ করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে রদ করেছেন। কারণ তাঁরা জানতেন, উম্মতের জন্য ওরা কতটা বিপজ্জনক।

আমাদের নিকটেও তাদের অনিষ্টের ব্যাপারে চুপ থাকার কোনো স্কোপ নেই। বরং আবশ্যিকভাবে আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান বর্ণনা করতে হবে। নতুবা আমরা শরিয়ত গোপনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব, যাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আমি যে সব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, সেগুলিকে সর্বসাধারণের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা সেসব বিষয়কে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাতকারীরাও তাদেরকে অভিসম্পাত করে থাকে।” (সূরাহ বাক্বারাহ: ১৫৯)

বিষয়টি শুধু বিদ‘আতীর উপরই সীমাবদ্ধ নয়। বরং যে বিদ‘আতীর ব্যাপারে চুপ থেকেছে, বিষয়টি তাকেও শামিল করে। উল্লিখিত ভর্ৎসনা ও শাস্তি তাকেও শামিল করে। কেননা মানুষের কাছে বিশদভাবে বর্ণনা করা ওয়াজিব। বর্তমানে মুসলিমদের লাইব্রেরিগুলোতে বিদ্যমান পর্যাপ্ত ‘ইলমী রুদূদের (রিফিউটেশনস) সকল গ্রন্থ সিরাত্বে মুস্তাক্বীম তথা সরল-সঠিক পথকে ডিফেন্ড করে এবং ওই ব্যক্তিদের থেকে সতর্ক করে। সুতরাং এই মতবাদ –সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কথা বলার স্বাধীনতা আছে, অন্যের মতের সম্মান আছে ইত্যাদি বলার মতবাদ– হককে গোপনকারী এবং অন্যকে পথভ্রষ্টকারী ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ প্রচার করে না।

আমরা হক বর্ণনা করতে চাই। আমরা মানুষকে জারাহ করা, বা মানুষের সমালোচনা করার অভিলাষ করি না। আমাদের অভিলাষ তো স্রেফ হক বর্ণনা করা। এটি একটি আমানত, যা আল্লাহ ‘আলিমদের উপর অর্পণ করেছেন। সুতরাং ওদের মত ব্যক্তিদের ব্যাপারে চুপ থাকা না-জায়েজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো ‘আলিম এসে ওদের মত ব্যক্তিদের রদ করলে তারা বলে, ‘ইনি তাড়াহুড়া করছেন’ ইত্যাদি কুমন্ত্রণামূলক কথাবার্তা। সুতরাং কেউ ‘আলিমদেরকে পথভ্রষ্ট দা‘ঈদের অনিষ্ট মানুষের কাছে বর্ণনা করতে বারণ করবে না, তাঁদেরকে (এ থেকে) বারণ করবে না।” [ইমাম সালিহ আল ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ), ইতহাফুল ক্বারী বিত তা‘লীক্বাতি ‘আলা শারহিস সুন্নাহ লিল ইমাম আল-বারবাহারী; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৯৩-৯৫; মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩০ হি./২০০৯ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]

·
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন,

ومثل أئمة البدع من أهل المقالات المخالفة للكتاب والسنة، أو العبارات المخالفة للكتاب والسنة، فإن بيان حالهم وتحذير الأمة منهم واجب باتفاق المسلمين، حتى قيل لأحمد بن حنبل: الرجل يصوم ويصلي ويعتكف أحب إليك أو يتكلم في أهل البدع؟ فقال: إذا قام وصلى واعتكف فإنما هو لنفسه، وإذا تكلم في أهل البدع فإنما هو للمسلمين هذا أفضل.
فبيّن أن نفع هذا عام للمسلمين في دينهم من جنس الجهاد في سبيل الله، إذ تطهير سبيل الله ودينه ومنهاجه وشرعته ودفع بغي هؤلاء وعدوانهم على ذلك واجب على الكفاية باتفاق المسلمين، ولولا من يقيمه الله لدفع ضرر هؤلاء لفسد الدين، وكان فساده أعظم من فساد استيلاء العدو من أهل الحرب، فإن هؤلاء إذا استولوا لم يفسـدوا القلوب وما فيها من الدين إلا تبعاً، وأما أولئك فهم يفسدون القلوب ابتداءً.

“যেমন কিতাব ও সুন্নাহ বিরোধী বক্তব্য বা কিতাব ও সুন্নাহ বিরোধী কথার অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত বিদ‘আতের ইমামগণ। তাদের অবস্থা বর্ণনা করা এবং উম্মাহকে তাদের থেকে সতর্ক করা মুসলিমদের সর্বসম্মতিক্রমে ওয়াজিব। এমনকি আহমাদ বিন হাম্বালকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, “একজন ব্যক্তি সিয়াম পালন করে, সালাত পড়ে, ই‘তিকাফ করে– সে আপনার কাছে অধিক প্রিয়, না কি সে ব্যক্তি যে বিদ‘আতীদের সমালোচনা করে?” তখন তিনি বলেন, “যখন সে সিয়াম পালন করে, সালাত পড়ে এবং ই‘তিকাফ করে, তখন সে তা নিজের জন্য করে। আর যখন সে বিদ‘আতীদের সমালোচনা করে, তখন সে তা মুসলিমদের জন্য করে; সুতরাং এটি উত্তম।”

তিনি বর্ণনা করেছেন যে, মুসলিমদের জন্য তাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে এই কাজের উপকারিতা ব্যাপক, যা আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদ করার অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু আল্লাহ’র রাস্তা, দ্বীন, মানহাজ ও শরিয়তকে পরিশুদ্ধ করা এবং এর উপর এদের বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘনকে প্রতিহত করা মুসলিমদের ঐক্যমতে ওয়াজিবে কিফায়াহ। [ওয়াজিবে কিফায়াহ’র অর্থ: উম্মাহ’র কতিপয় আদায় করলে, বাকিদের উপর থেকে তা আদায় না করার পাপ ঝরে পড়ে। – সংকলক।] আল্লাহ যদি কতিপয় ব্যক্তিকে এদের অনিষ্ট প্রতিহত করতে নিয়োগ না করতেন, তাহলে অবশ্যই দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত। যেহেতু এর অনিষ্ট শত্রু যোদ্ধাদলের কাছে পরাভূত হওয়ার অনিষ্ট থেকেও বেশি। কেননা তারা যখন পরাভূত করে, তখন তারা (মানুষের) অন্তর এবং অন্তরিস্থ দ্বীনকে নষ্ট করে না; তবে কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজের দ্বীন নষ্ট করে, তবে তার কথা ভিন্ন। পক্ষান্তরে এরা শুরুতেই মানুষের অন্তরকে নষ্ট করে।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২৮; পৃষ্ঠা: ২৩১-২৩২; বাদশাহ ফাহাদ প্রিন্টিং প্রেস; বাদশাহ ফাহাদ (রাহিমাহুল্লাহ)’র রাজকীয় ফরমানে মুদ্রিত; সন: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি.]

·
বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,

فالواجب على علماء المسلمين توضيح الحقيقة ومناقشة كل جماعة أو جمعية ونصح الجميع بأن يسيروا في الخط الذي رسمه الله لعباده ودعا إليه نبينا محمد ﷺ، ومن تجاوز هذا أو استمر في عناده لمصالح شخصية أو لمقاصد لا يعلمها إلا الله- فإن الواجب التشهير به والتحذير منه ممن عرف الحقيقة، حتى يتجنب الناس طريقهم وحتى لا يدخل معهم من لا يعرف حقيقة أمرهم فيضلوه ويصرفوه عن الطريق المستقيم الذي أمرنا الله باتباعه في قوله جل وعلا: وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.

“মুসলিমদের ‘আলিমদের উপর প্রকৃত বিষয় বর্ণনা করা, প্রত্যেক দল বা সংগঠনের সাথে (শার‘ঈ) বিতর্ক সম্পন্ন করা এবং সবাইকে ওই পথের উপর চলতে নসিহত করা ওয়াজিব, যে পথ স্বয়ং আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য চিত্রিত করেছেন, আর যে পথের দিকে আমাদের নাবী মুহাম্মাদ ﷺ আমাদেরকে আহ্বান করেছেন। যে ব্যক্তি এই পথের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে, কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে বা কেবল আল্লাহ জানেন এমন কোনো (গুপ্ত) উদ্দেশ্যের কারণে নিজের জিদ ও হঠকারিতায় অটল থাকে, তাহলে যারা প্রকৃত বিষয়টি জানে তাদের জন্য ওই ব্যক্তির সমালোচনা করা এবং তার থেকে সতর্ক করা ওয়াজিব। যাতে করে মানুষ এই ব্যক্তিদের পথ বর্জন করে, আর যে ব্যক্তি প্রকৃত বিষয় জানে না সে তাদের দলে প্রবেশ না করে। নতুবা তারা ওই অজ্ঞ ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করবে এবং সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। যেই সঠিক পথ অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আর এটি তো আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ করো এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ কোরো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন কর।” (সূরাহ আন‘আম: ১৫৩)” [ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২০৩; দারুল ক্বাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২০ হিজরী (১ম প্রকাশ)]

ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন,

ﻓﻼ ﻳﺠﻮﺯ ﻷﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﺍﻟﺴﻜﻮﺕ ﻭﺗﺮﻙ ﺍﻟﻜﻼﻡ ﻟﻠﻔﺎﺟﺮ ﻭﺍﻟﻤﺒﺘﺪﻉ ﻭﺍﻟﺠﺎﻫﻞ ﻓﺈﻥ ﻫﺬﺍ ﻏﻠﻂ ﻋﻈﻴﻢ ﻭﻣﻦ ﺃﺳﺒﺎﺏ ﺍﻧﺘﺸﺎﺭ ﺍﻟﺸﺮ ﻭﺍﻟﺒﺪﻉ ﻭﺍﺧﺘﻔﺎﺀ ﺍﻟﺨﻴﺮ ﻭﻗﻠﺘﻪ ﻭﺧﻔﺎﺀ ﺍﻟﺴﻨﺔ. ﻓﺎﻟﻮﺍﺟﺐ ﻋﻠﻰ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﺃﻥ ﻳﺘﻜﻠﻤﻮﺍ ﺑﺎﻟﺤﻖ ﻭﻳﺪﻋﻮﺍ ﺇﻟﻴﻪ ﻭﺃﻥ ﻳﻨﻜﺮﻭﺍ ﺍﻟﺒﺎﻃﻞ ﻭﻳﺤﺬﺭﻭﺍ ﻣﻨﻪ ﻭﻳﺠﺐ ﺃﻥ ﻳﻜﻮﻥ ﺫﻟﻚ ﻋﻦ ﻋﻠﻢ ﻭﺑﺼﻴﺮﺓ.

“পাপাচারী, মূর্খ ও বিদ‘আতীর বিরুদ্ধে কথা বলা বর্জন করা এবং নীরব থাকা ‘আলিমদের জন্য বৈধ নয়। কেননা এটি একটি মারাত্মক গলত। এটি অকল্যান ও বিদ‘আত প্রসারিত হওয়ার অন্যতম কারণ। এটি কল্যাণ কমে যাওয়া, কল্যাণ দূরীভূত হওয়া এবং সুন্নাহ অপসৃত হওয়ারও অন্যতম কারণ। সুতরাং ‘আলিমদের জন্য হক বলা, এর দিকে লোকদের আহ্বান করা, বাতিলকে রদ করা এবং এ থেকে লোকদেরকে সতর্ক করা ওয়াজিব। তবে অবশ্যই তা হতে হবে শার‘ঈ ‘ইলম ও জাগ্রত জ্ঞান সহকারে।” [প্রাগুক্ত; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৫৩]

·
❏ যারা বিদ‘আতীদের ব্যাপারে চুপ থাকে, তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বনকারী:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,

ولو سكت أهل الحق عن بيانه: لاستمر المخطئون على أخطائهم، وقلدهم غيرهم في ذلك، وباء الساكتون بإثم الكتمان الذي توعدهم الله في قوله سبحانه: إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَبَيَّنُوا فَأُولَٰئِكَ أَتُوبُ عَلَيْهِمْ ۚ وَأَنَا التَّوَّابُ الرَّحِيمُ.
وقد أخذ الله على علماء أهل الكتاب الميثاق لتبيننه للناس ولا تكتمونه، وذمهم على نبذه وراء ظهورهم، وحذرنا من اتباعهم.
فإذا سكت أهل السنة عن بيان أخطـاء من خالف الكتاب والسنة شَـابَهُوا بذلك أهل الكتاب المغضوب عليهم والضالين.

“হকপন্থিরা যদি হক বর্ণনা করা থেকে চুপ থাকে, তাহলে ভুলকারীরা তাদের ভুলে অটল থাকবে এবং অন্যরা সেই ভুলের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করবে। আর নীরবতা অবলম্বনকারীরা শরিয়ত গোপনের পাপ বহন করবে, যে ব্যাপারে আল্লাহ তাদের হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি যেসব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, সেগুলিকে সর্বসাধারণের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা সেসব বিষয়কে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাতকারীরাও তাদেরকে অভিসম্পাত করে থাকে। তবে তারা ছাড়া, যারা তাওবাহ করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব আমি তাদের তাওবাহ কবুল করব। বস্তুত আমি তাওবাহ কবুলকারী, পরম দয়ালু।” (সূরাহ বাক্বারাহ: ১৫৯-১৬০)

আল্লাহ আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ‘আলিমদের নিকট থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তারা তা মানুষের কাছে বর্ণনা করবে, গোপন করবে না। কিন্তু তারা সে অঙ্গীকার তাদের পিছনে ছুঁড়ে ফেলার কারণে আল্লাহ তাদের ভর্ৎসনা করেছেন এবং আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করা থেকে সতর্ক করেছেন।

কিতাব ও সুন্নাহ’র বিরোধীদের ভুল বর্ণনা করা থেকে আহলুস সুন্নাহ যদি চুপ থাকে, তাহলে তারা এর মাধ্যমে ইহুদি-খ্রিষ্টানের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে, যে ইহুদি-খ্রিষ্টানরা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট।” [প্রাগুক্ত; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৭২-৭৩]

·
❏ বিদ‘আতীদের রদ না করে তাদের ব্যাপারে চুপ থাকা মুসলিমদের সাথে ধোঁকা হিসেবে পরিগণিত:

ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) কে প্রশ্ন করা হয়েছে,

يقول السَّائل: هل عدم الرَّد على أهل البدع وكتمان باطلهم والدِّفاع عنهم يعتبر من الغشّ للمسلمين؟

“প্রশ্নকারী বলছেন, বিদ‘আতীদের রদ না করা, তাদের বাতিল কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে চুপ থাকা এবং তাদেরকে ডিফেন্ড করা কি মুসলিমদের সাথে ধোঁকা হিসেবে পরিগণিত হবে?”

তিনি (হাফিযাহুল্লাহ) জবাবে বলেছেন,

هذا من أكبر الغش للمسلمين، السكوت على أهل البدع وعدم بيان بدعهم هذا من الغش للمسلمين، فإذا انضاف إلى هذا أنه يمدحهم ويثني عليهم فهذا أشد وأنكر والعياذ بالله، فالواجب على من عنده علم أن يُبَيِّن البدع والمحدثات وأن ينهى عنها ويُحذِّر منها ولا يسكت،السكوت هذا من الكتمان ﴿إِنَّ الذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ البَيِّنَاتِ وَالهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الكِتَابِ أُوْلَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللاَّعِنُونَ إِلَّا الذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَبَيَّنُوا فَأُوْلَئِكَ أَتُوبُ عَلَيْهِمْ وَأَنَا التَّوَّابُ الرَّحِيمُ﴾ لا يجوز للمسلم الذي عنده علم أن يسكت على البدع والمخالفات ولا يُبَيِّنُها للناس لأنه إذا سكت احتجَّ الناس به وقالوا لو كان هذا محرمًا أو ممنوعًا ما سكت العالم الفلاني وهو يراه، نعم.

“এটি মুসলিমদের সাথে সবচেয়ে বড় ধোঁকাবাজির অন্তর্ভুক্ত। বিদ‘আতীদের ব্যাপারে চুপ থাকা এবং তাদের বিদ‘আত বর্ণনা না করা মুসলিমদের সাথে ধোঁকাবাজির অন্তর্ভুক্ত। আর যখন এর সাথে এটা যুক্ত হয় যে, সে তাদের প্রশংসা ও গুণকীর্তন করছে, তখন তা হয় অধিক ভয়ানক ও গুরুতর। সুতরাং যার ‘ইলম আছে, তার উপর ওয়াজিব হলো বিদ‘আতসমূহ বর্ণনা করে তা থেকে নিষেধ ও সতর্ক করা এবং এ ব্যাপারে চুপ না থাকা। কেননা চুপ থাকা শরিয়ত গোপন করার অন্তর্ভুক্ত।

মহান আল্লাহ বলেছেন, “আমি যেসব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, সেগুলিকে সর্বসাধারণের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা সেসব বিষয়কে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাতকারীরাও তাদেরকে অভিসম্পাত করে থাকে। তবে তারা ছাড়া, যারা তাওবাহ করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব আমি তাদের তাওবাহ কবুল করব। বস্তুত আমি তাওবাহ কবুলকারী, পরম দয়ালু।” (সূরাহ বাক্বারাহ: ১৫৯-১৬০)

যে মুসলিমের কাছে ‘ইলম আছে, তার জন্য বিদ‘আত ও শরিয়ত বিরোধিতার ব্যাপারে চুপ থাকা এবং মানুষের কাছে তা বর্ণনা না করা বৈধ নয়। কেননা সে যদি চুপ থাকে, তাহলে মানুষ তা দলিল হিসেবে গ্রহণ করবে এবং বলবে, “এটা যদি হারাম বা নিষিদ্ধই হত, তাহলে অমুক ‘আলিম তা দেখা সত্ত্বেও চুপ করে থাকতেন না”।” [দ্র.: www.sahab.net/forums/index.php?app=forums&module=forums&controller=topic&id=122996 (টেক্সট-সহ অডিয়ো ক্লিপ)]

·
পরিশেষে প্রার্থনা করছি, আল্লাহ আমাদেরকে বিদ‘আতীদের থেকে সতর্ক থাকার, অন্যদের সতর্ক করার এবং যারা বিদ‘আতীদের থেকে সতর্ক করা থেকে বারণ করে, তাদের থেকে সাবধান থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল ‘আলামীন।

·
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা
www.facebook.com/SunniSalafiAthari

Saturday, August 17, 2019

আলিম কে?



▌‘আলিম কে?

·
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি।

যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। যিনি বলেছেন, “তোমরা যদি না জানো, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো।” [সূরাহ নাহল: ৪৩]

দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। যিনি বলেছেন, “অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে যে ‘ইলম দান করেছেন তা তোমাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো তুলে নেবেন না। বরং ‘আলিম-‘উলামা তুলে নিয়ে ‘ইলম তুলে নেবেন। এমতাবস্থায় যখন কেবল জাহিল নেতাবর্গ অবশিষ্ট থাকবে, তখন লোকেরা তাদেরকেই ফাতওয়া জিজ্ঞেস করবে। আর তারা নিজেদের রায় দ্বারা ফাতওয়া দেবে, ফলে তারা নিজেরা ভ্রষ্ট হবে এবং অপরকেও ভ্রষ্ট করবে।” [সাহীহ বুখারী, হা/১০১]

·
প্রারম্ভিকা:

‘আলিম’ অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি অবস্থান, যে অবস্থান আল্লাহ স্বীয় ইচ্ছা অনুযায়ী স্রেফ তাঁর অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দাদেরকে দান করে থাকেন। ‘আলিমগণ সম্মানিত নাবীদের ওয়ারিশ। আল্লাহ’র কাছে তাঁদের বিশাল মর্যাদা রয়েছে। এই অবস্থানের অধিকারী নির্বাচিত বান্দারা ইসলাম প্রচার ও প্রসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দেন। তাঁরা দ্বীনের ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন এবং জনসাধারণকে শার‘ঈ পদ্ধতিতে পথনির্দেশ করেন।

কেউ চাইলেই ‘আলিম হতে পারে না, এমনকি সারাজীবন ‘ইলম অর্জনে ব্যাপৃত থাকার পরও কেউ ‘আলিম হতে পারে না, যতক্ষণ না আল্লাহ তাকে ‘আলিম হিসেবে কবুল করেন।

সম্প্রতি উপমহাদেশীয় পরিমণ্ডলে একটি বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, আম জনসাধারণ—এমনকি কতিপয় দা‘ঈও—‘আলিম লকবটি যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে। কেউ কওমি মাদরাসা থেকে দাওরা পাস করেই ‘আলিম বিবেচিত হচ্ছে, কেউ আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল পাস করেই ‘আলিম বিবেচিত হচ্ছে, কেউ ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেই ‘আলিম বিবেচিত হচ্ছে, আবার কেউ কেউ দুচারটা হাদীস ও ফিক্বহের কিতাব পড়েই ‘আলিম বিবেচিত হচ্ছে। আল্লাহুল মুস্তা‘আন।

অথচ বিষয়টি এরকম জলবত তরলং নয়। ‘আলিম হওয়ার জন্য বিস্তর ‘ইলম, ফিক্বহ ও হিকমাহ’র প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন আছে প্রকৃত ‘আলিমদের পক্ষ থেকে ‘আলিম হওয়ার শাহাদাহ’র।

বর্তমান সময়ে উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষ ‘আলিমের পরিচয় সম্পর্কে অবগত নয়। ফলে তারা অনির্ভরযোগ্য দা‘ঈ এবং সেলিব্রেটি বক্তাদেরকে ‘আলিম গণ্য করে তাদের কাছে ফাতওয়া জিজ্ঞেস করে, ফলে তারা ভ্রষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন, “দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে আধা বক্তা, আধা ফাক্বীহ (‘আলিম), আধা ডাক্তার ও আধা ভাষাবিদ। আধা বক্তা ক্ষতি করে দ্বীনের, আধা ফাক্বীহ ক্ষতি করে দেশের, আধা ডাক্তার ক্ষতি করে শরীরের, আর আধা ভাষাবিদ ক্ষতি করে ভাষার।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১১৮-১১৯; বাদশাহ ফাহাদ প্রিন্টিং প্রেস, মাদীনাহ ছাপা; ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি. (বাদশাহ ফাহাদের রাজকীয় ফরমানে মুদ্রিত)]

এহেন বিপজ্জনক পরিস্থিতির নিরসনকল্পেই আমাদের এই নিবন্ধের অবতারণা। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে  আমরা যথাক্রমে ‘আলিমের পরিচয়, ‘আলিম হওয়ার শর্ত এবং ‘আলিম চেনার উপায় প্রসঙ্গে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করেছি। আল্লাহ আমাদের এই সামান্য প্রয়াসকে সালাফী দা‘ওয়াহর অংশ হিসেবে কবুল করুন এবং এটাকে আমাদের জান্নাতে দাখিল হওয়ার মাধ্যমে পরিণত করুন। (আমীন)

·
‘আলিমের পরিচয়:

‘আলিম ও মুজতাহিদ—অভিধা দুটি অভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, المُجتهِدُ في الحقيقةِ هو العَالِمُ “প্রকৃতপক্ষে মুজতাহিদ ব্যক্তিই হলেন ‘আলিম।” [ইমাম ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), শারহুল উসূল মিন ‘ইলমিল উসূল; পৃষ্ঠা: ৬৭২; দারু ইবনিল জাওযী, দাম্মাম কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩৫ হিজরী (৪র্থ প্রকাশ)]

‘মুজতাহিদ’ একটি বিশেষ্য, যা ‘ইজতিহাদ’ ক্রিয়ামূল থেকে উদ্‌গত হয়েছে। ইজতিহাদের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের দিকে লক্ষ করলে আমরা মুজতাহিদের পরিচয় সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা লাভ করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।

·
আভিধানিক অর্থে—

بذل المجهود واستفراغ الوسع في فعل من الأفعال، ولا يستعمل إلا فيما فيه مشقة، يقال: اجتهد في حمل الصخرة، ولا يقال: اجتهد في حمل العصا أو النواة.

“কোনো কাজে চেষ্টাপ্রচেষ্টা করা এবং শক্তিসামর্থ্য ব্যয় করাকে ইজতিহাদ বলে। এই অভিধাটি শুধুমাত্র ওই কাজের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়, যাতে কষ্ট ও ক্লেশ যুক্ত থাকে। একারণে বলা হয়, সে (ভারি) প্রস্তরখণ্ডটি বহন করতে ইজতিহাদ করেছে। এ কথা বলা হয় না যে, সে একটি লাঠি বা একটি আঁটি বহন করতে ইজতিহাদ করেছে।” [ইমাম ‘আব্দুল মুহসিন আল-‘আব্বাদ (হাফিযাহুল্লাহ) প্রমুখ; তাসহীলুল উসূল ইলা ফাহমি ‘ইলমিল উসূল; পৃষ্ঠা: ১১৪; দারুল ইমাম আহমাদ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩২ হি./২০১১ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]

·
পারিভাষিক অর্থে—

ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, بذل الجهد لإدراك حكم شرعي “কোনো একটি শার‘ঈ বিধান জানার জন্য চেষ্টাপ্রচেষ্টা করাকে ইজতিহাদ বলে।” [ইমাম ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), আল-উসূল মিন ‘ইলমিল উসূল; পৃষ্ঠা: ৮৫; দারু ইবনিল জাওযী, দাম্মাম কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৬ হিজরী]

ইমাম মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৯৩ হি.] বলেছেন, بذلُ الفقيهِ وسعَهُ بالنظر في الأدلة لأجل أن يحصل له الظنُّ أو القطعُ بأنَّ حكم الله في المسألة كذا “কোনো ফাক্বীহ কর্তৃক দলিলসমূহ পর্যবেক্ষণ করতে স্বীয় প্রচেষ্টা প্রয়োগ করাকে ইজতিহাদ বলে; যাতে করে তিনি অকাট্যতার ভিত্তিতে বা প্রবল ধারণার ভিত্তিতে জানতে পারেন যে, এই মাসআলাহ’য় আল্লাহ’র বিধান এটা।”‌ [ইমাম শানক্বীত্বী (রাহিমাহুল্লাহ), মুযাক্কিরাতু উসূলিল ফিক্বহি ‘আলা রাওদ্বাতিন নাযির, পৃষ্ঠা: ৪৮৫; দারু ‘আলামিল ফাওয়াইদ, মক্কা কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৬ হিজরী (১ম প্রকাশ)]

আর মুজতাহিদের পরিচয় দিতে গিয়ে ইমাম ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, المجتهد من بذل جهده لذالك “যে ব্যক্তি এর জন্য (অর্থাৎ, কোনো শার‘ঈ বিধান জানার জন্য) স্বীয় প্রচেষ্টা ব্যয় করেন, তাঁকে মুজতাহিদ বলে।” [আল-উসূল মিন ‘ইলমিল উসূল; পৃষ্ঠা: ৮৫]

·
ইজতিহাদের শর্ত:

ইজতিহাদের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। স্রেফ একজন মুজতাহিদই ইজতিহাদ করবেন, ‘আম্মী (লেইম্যান) ব্যক্তি ইজতিহাদ করবে না। ইজতিহাদ করার জন্য বেশ কিছু শর্ত আছে, যে শর্তগুলো পূরণ হলে একজন ব্যক্তি মুজতাহিদ হতে পারেন। যার মধ্যে ইজতিহাদের একটি শর্তেরও অবিদ্যমানতা পাওয়া যাবে, তিনি মুজতাহিদ তথা ‘আলিম বলে গণ্য হবেন না। এ ব্যাপারে আমরা পর্যায়ক্রমে কয়েকজন বিখ্যাত ইমামের উক্তি উল্লেখ করব, ইনশাআল্লাহ।

ইমাম বাগাউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৫১৬ হি.] বলেন—

“যে ব্যক্তি (নিজের মধ্যে) পাঁচ প্রকার ‘ইলম একত্র করেছেন তিনি মুজতাহিদ। ‘ইলমগুলো হলো: আল্লাহ’র কিতাবের ‘ইলম, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাতের ‘ইলম, ‘উলামায়ে সালাফের ইজমা‘ (মতৈক্য) ও ইখতিলাফের (মতানৈক্য) ক্ষেত্রে তাঁদের বক্তব্যসমূহের ‘ইলম, ভাষার ‘ইলম এবং কিয়াসের ‘ইলম। এটা হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে (আল্লাহ’র) বিধান উদ্‌ঘাটন করার পদ্ধতি। যখন তিনি কুরআন, সুন্নাহ, বা ইজমা‘র সুস্পষ্ট বক্তব্যের মধ্যে (আল্লাহ’র) বিধানকে স্পষ্টভাবে পাবেন না, তখন তাঁর জন‍্য কুরআন থেকে এই বিষয়গুলো জানা ওয়াজিব হয়ে যাবে—নাসিখ (রহিতকারী), মানসূখ (রহিত), মুজমাল (সংক্ষিপ্ত), মুফাসসাল (বিস্তৃত), খাস (নির্দিষ্ট), ‘আম (ব্যাপক), মুহকাম (দ্ব্যর্থহীন), মুতাশাবিহ (দ্ব্যর্থবোধক), মাকরূহ (অপছন্দনীয়), হারাম (নিষিদ্ধ), মুবাহ (বৈধ), মানদূব (পছন্দনীয়), ওয়াজিব (আবশ্যকীয়)। অনুরূপভাবে সুন্নাহ থেকেও এই বিষয়গুলো জানা ওয়াজিব হয়ে যাবে। তাঁর জন্য সুন্নাহ থেকে সাহীহ ও দ্ব‘ঈফ এবং মুসনাদ ও মুরসাল সম্পর্কে জানা, কুরআনের ওপর সুন্নাহ’র বিন্যাস এবং সুন্নাহ’র উপর কুরআনের বিন্যাস সম্পর্কে জানা ওয়াজিব হয়ে যাবে।

যাতে করে তিনি যদি এমন হাদীস পান, যার বাহ্যিক দিক কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না, তাহলে হাদীসটির প্রায়োগিক দিকের সন্ধান লাভ করতে পারেন। কেননা সুন্নাহ হলো কুরআনের ব্যাখ্যা, কুরআনের বিরোধী নয়। অবশ্যই তাঁর জন্য শরিয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে যে সুন্নাহ বর্ণিত হয়েছে তা জানা ওয়াজিব; বিধিবিধান ছাড়া এতে যে ঘটনাবলি, খবরাখবর ও উপদেশসমূহ রয়েছে তা এর আওতাভুক্ত নয়। অনুরূপভাবে কুরআন-সুন্নাহ’য় বিধিবিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে যে ভাষাবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয়েছে, সে সম্পর্কে জানাও তাঁর জন্য আবশ্যক; আরবদের সমগ্র ভাষা সম্পর্কে জানা এর আওতাভুক্ত নয়। তবে তাঁর জন্য ভাষা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করা বাঞ্ছনীয়; যাতে করে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে আরবদের কথা যে উদ্দেশ্যের অর্থ দেয়, সে উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি অবগত হতে পারেন। কেননা (শরিয়তের) সম্বোধন আরবদের ভাষার মাধ্যমেই বর্ণিত হয়েছে; তাই যে ব্যক্তি তা জানে না, সে শরিয়তপ্রণেতার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জানবে না।

তাঁর জন্য বিধিবিধানের ক্ষেত্রে সাহাবী ও তাবি‘ঈগণের বক্তব্যসমূহ জানা এবং উম্মাহর ফাক্বীহদের অধিকাংশ ফাতওয়া জানা আবশ্যক, যাতে করে তাঁর উদ্‌ঘাটিত বিধান তাঁদের বক্তব্যের বিরোধী না হয়, যার ফলে কোনো বিধানে ইজমা‘ লঙ্ঘিত হয়। যখন তিনি এই প্রত্যেক প্রকার ‘ইলমের অধিকাংশই জানবেন, তখন তিনি মুজতাহিদ হিসেবে গণ্য হবেন। উল্লিখিত প্রত্যেক প্রকার ‘ইলমের সমগ্র অংশ জানাকে শর্ত করা হবে না, তবে কোনো শাস্ত্রের জ্ঞানই অপর্যাপ্ত থাকা যাবে না। যখন কেউ এই প্রকারগুলোর মধ্য থেকে কোনো এক প্রকার ‘ইলম সম্পর্কে জানবে না, তখন তার (অবলম্বন করার) রাস্তাই হলো তাক্বলীদ।” [আল-ইমামুল ‘আল্লামাহ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ), ‘ইক্বদুল জীদ ফী আহকামিল ইজতিহাদি ওয়াত তাক্বলীদ; পৃষ্ঠা: ২১-২৩; দারুল ফাতহ, শারিক্বাহ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]

·
আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১২৫০ হি./১৮৩৪ খ্রি.] বলেছেন,

“ইজতিহাদ করার জন্য বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলো হলো—
১. কুরআন-সুন্নাহ’র নস (মূল বক্তব‍্য) সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। সে যদি কেবল একটি সম্পর্কে অবগত থাকে, তাহলে সে মুজতাহিদ নয়। তার জন্য ইজতিহাদ করা বৈধ নয়।
২. ইজমা‘র মাসআলাহসমূহ জানা থাকতে হবে। যেন সে ইজমা‘ বিরোধী ফাতওয়া না দেয়।
৩. আরবি ভাষা সম্পর্কে জানা থাকতে হবে, যেন সে কুরআন-সুন্নাহ’য় বর্ণিত অপরিচিত শব্দের ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।
৪. তার উসূলে ফিক্বহ সম্পর্কে জানা থাকতে হবে, যেহেতু তা অত্যন্ত জরুরি (‘ইলমী) বিষয়কে শামিল করে। তার উচিত এই বিষয়ে বিশেষ (‘ইলমী) যোগ্যতা অর্জন করা।
৫. তার নাসিখ (রহিতকারী) ও মানসূখ (রহিত) সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। যেন এ সংক্রান্ত কোনো মাসআলাহই তার অজানা না থাকে। আর তা একারণে যে, এর অন্যথা হলে সে হয়তো মানসূখ বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে বসবে।” (সংক্ষেপিত) [ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ), ইরশাদুল ফুহূল ইলা তাহক্বীক্বিল হাক্বক্বি মিন ‘ইলমিল উসূল, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১০২৭-১০৩৫; দারুল ফাদ্বীলাহ, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২১ হি./২০০০ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]

·
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন—

“ইজতিহাদের জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। যথা:

১. শার‘ঈ দলিল থেকে যা তার ইজতিহাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে তা জানা থাকা। যেমন: বিধিবিধানের আয়াত ও হাদীসসমূহ।
২. হাদীসের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতার সাথে যা সংশ্লিষ্ট তা জানা থাকা। যেমন: সনদ ও তার বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে জানা।
৩. নাসিখ (রহিতকারী) মানসূখ (রহিত), ইজমা‘ (মতৈক্য) সংঘটিত হওয়ার স্থান সম্পর্কে জানা থাকা। যাতে করে সে মানসূখ বিধান বা ইজমা‘ বিরোধী বিধান অনুযায়ী ফায়সালা না দেয়।
৪. দলিলসমূহ থেকে যার কারণে বিধান ভিন্নতর হয় তথা খাসকরণ (নির্দিষ্ট), মুক্বাইয়্যাদকরণ (শর্তযুক্ত) প্রভৃতি সম্পর্কে জানা থাকা। যাতে করে সে এগুলোর বিরোধী বিষয়ের দ্বারা ফায়সালা না দেয়।
৫. ভাষা ও ফিক্বহের মূলনীতি থেকে যা কিছু শব্দের মর্মার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট তা জানা থাকা। যেমন: ‘আম (ব্যাপক), খাস (নির্দিষ্ট), মুত্বলাক্ব (শর্তহীন), মুক্বাইয়্যাদ (শর্তযুক্ত), মুজমাল (সংক্ষিপ্ত), মুবাইয়্যান (বিস্তৃত) প্রভৃতি। যাতে করে সে ওই মর্মার্থের দাবি অনুযায়ী ফায়সালা দেয়।
৬. তার কাছে এমন সক্ষমতা থাকা, যার দ্বারা সে দলিল থেকে (শার‘ঈ) বিধান উদ্‌ঘাটন করতে পারে।” [ইমাম ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), আল-উসূল মিন ‘ইলমিল উসূল; পৃষ্ঠা: ৮৫-৮৬; দারু ইবনিল জাওযী, দাম্মাম কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৬ হিজরী]

·
সুপ্রিয় পাঠক, এখন কিছু প্রশ্ন করি। বর্তমান সময়ে ‘আলিম হওয়ার এসব যোগ্যতা পূরণকারী লোকদের সংখ্যা কেমন হতে পারে? প্রত্যেক সুবক্তা ও বিতার্কিক, বা ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী, কিংবা সেলিব্রেটি লেখক ও কিতাবের তাহক্বীক্বকারীর মধ্যেই কি এসব গুণ রয়েছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যেতে পারে বিগত শতাব্দীর প্রখ্যাত ‘আলিমে দ্বীন, আল-ফাক্বীহ, আল-উসূলী, আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, ড. ‘আব্দুস সালাম বিন বারজিস বিন নাসির আলে ‘আব্দুল কারীম (রাহিমাহুল্লাহ)’র নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকে।

‘আল্লামাহ ‘আব্দুস সালাম বিন বারজিস আলে ‘আব্দুল কারীম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি.] বলেছেন—

“নিশ্চয়ই ‘আলিম বলে ডাকা যায় এমন লোকের সংখ্যা খুবই সামান্য। এবং এটা অতিরঞ্জন হবে না, যদি বলা হয় বিরল। এর কারণ হলো একজন ‘আলিমের কতগুলো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আর বর্তমানে নিজেদের ‘ইলমের সাথে সংযুক্তকারী অধিকাংশের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্যের অধিকাংশই পাওয়া যায় না। সুতরাং একজন ‘আলিম সে নয় যে একজন সুবক্তা, এবং একজন ‘আলিম সে নয় যে একটি কিতাব সংকলন করে অথবা একটি পাণ্ডুলিপির তাহক্বীক্ব করে। আর শুধু এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকার কারণেই যদি কাউকে ‘আলিম বোঝানো হয়, এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘আলিম কে—এই বিষয়টির সাথে অপরিচিত অনেকের মনের মধ্যেই এই বিষয়টি রয়েছে (অর্থাৎ কেউ সুবক্তা হলে, বা কিতাব সংকলন করলে, কিংবা পাণ্ডুলিপির তাহক্বীক্ব করলেই তাকে তারা ‘আলিম ভাবে), আর একারণে সাধারণ জনগণের অনেকেই অ-‘আলিম (‘আলিম নয় এমন) লোকদের বাগ্মিতা ও লেখালেখির কাছে নিজেদের বিনম্র করেছে। সুতরাং এই বিষয়গুলো (বাগ্মী হওয়া, কিতাব সংকলন করা, পাণ্ডুলিপির তাহক্বীক্ব করা ইত্যাদি) তাদের কাছে একটি বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে গেছে। সত্যিকারার্থে একজন ‘আলিম হলেন তিনি, যিনি শার‘ঈ ‘ইলমের ব্যাপারে বিজ্ঞ এবং কিতাব ও সুন্নাহ’র হুকুম আহকামের সাথে পরিচিত, নাসিখ-মানসূখ, মুত্বলাক্ব-মুক্বাইয়্যাদ, মুজমাল-মুফাসসারের মতো বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত, এবং যিনি সেসব ব্যাপারেও সালাফদের বক্তব্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, যেসব ব্যাপারে তাঁরা মতপার্থক্য করেছেন।” [শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ)’র “মান হুমুল ‘উলামা”– শীর্ষক অডিয়ো ক্লিপ থেকে সংগৃহীত; সোর্স: সালাফিটক (salafitalk) ডট নেট]

·
‘আলিম চেনার উপায়:

পদমর্যাদা, ডিগ্রি, ক্ষমতা, বাগ্মিতা, যশ, খ্যাতি—এগুলোর কোনো কিছুই মানুষকে ‘আলিমে পরিণত করে না, যা অজ্ঞতাবশত অনেক ব্যক্তি ধারণা করে থাকে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন,

المنصب والولاية لا يجعل من ليس عالما مجتهداً عالما مجتهداً، ولو كان الكلام في العلم والدين بالولاية والمنصب لكان الخليفة والسلطان أحق بالكلام في العلم والدين، وبأن يستفتيه الناس ويرجعوا إليه فيما أشكل عليهم في العلم والدين.

“যে ব্যক্তি মুজতাহিদ ‘আলিম নয়, পদমর্যাদা ও ক্ষমতা তাকে মুজতাহিদ ‘আলিমে পরিণত করে না। যদি দ্বীন ও (শার‘ঈ) ‘ইলমের ব্যাপারে কথা বলা পদমর্যাদা ও ক্ষমতার ভিত্তিতে হত, তাহলে অবশ্যই খলিফা ও বাদশাহই দ্বীন ও (শার‘ঈ) ‘ইলমের ব্যাপারে কথা বলার সবচেয়ে বড়ো হকদার হতো। আর লোকেরা তার কাছে ফাতওয়া জিজ্ঞেস করবে এবং (শার‘ঈ) ‘ইলম ও দ্বীনের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে তার দিকে প্রত্যাবর্তন করবে, এমন অবস্থানেরও সবচেয়ে বড়ো হকদার হতো।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২৪; পৃষ্ঠা: ২৯৬; বাদশাহ ফাহাদ প্রিন্টিং প্রেস, মাদীনাহ ছাপা; ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি. (বাদশাহ ফাহাদের রাজকীয় ফরমানে মুদ্রিত)]

আমাদের দেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে—“রতনে রতন চেনে, মানিকে চেনে মানিক।” আর‌ও বলা হয়—“জহুরি জহর চেনে, কামার চেনে লোহা।” আর তাইতো প্রকৃত চিকিৎসককে একজন চিকিৎসকই চিনতে পারে এবং প্রকৃত প্রকৌশলীকে একজন প্রকৌশলীই চিনতে পারে। মানুষ এটা দুনিয়াবি ক্ষেত্রে খুব ভালোভাবে মেনে চলে। কিন্তু হায়! পারলৌকিক বিষয়ে তাদের যত অবহেলা, অবজ্ঞা ও হঠকারিতা। সুস্থ মস্তিষ্কে একটু চিন্তাও করে না যে, একজন প্রকৃত ‘আলিমই দ্বীনের পথনির্দেশক, আর একজন ‘আলিমই কেবল চিনতে পারেন—কে প্রকৃত ‘আলিম, আর কে ভুয়া ‘আলিম তথা পাক্কা জাহিল। আল্লাহুল মুস্তা‘আন।

সালাফদের যুগ থেকেই এই সিলসিলা চলে আসছে যে, একজন ‘আলিমকে চেনা হবে সামসময়িক ‘আলিমদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। বর্তমান যুগেও একজন ‘আলিমকে চিনতে হলে ‘আলিমগণের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ ‘আলিমগণ ব্যক্তির যে অবস্থা বর্ণনা করবেন, সেটাই ওই ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি কিবার ‘আলিম, নাকি সাধারণ ‘আলিম, অথবা ত্বালিবুল ‘ইলম, নাকি ‘আম্মী তথা লেইম্যান—তা কেবল ‘আলিমকে জিজ্ঞেস করার মাধ্যমেই জানা সম্ভব।

·
শাইখুল ইসলাম, হুজ্জাতুল উম্মাহ, ইমামু দারিল হিজরাহ, আবূ ‘আব্দুল্লাহ মালিক বিন আনাস আল-আসবাহী আল-মাদানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৭৯ হি.] বলেছেন,

ﻣﺎ ﺃﺟَﺒْﺖ ﻓﻲ ﺍﻟﻔَﺘْﻮﻯ ﺣﺘﻰ ﺳﺄﻟﺖ ﻣﻦ ﻫﻮ ﺃﻋْﻠَﻢ ﻣﻨﻲ : ﻫﻞ ﺗَﺮﺍﻧﻲ ﻣَﻮﺿِﻌﺎ ﻟﺬﻟﻚ؟ ﺳﺄﻟﺖ ﺭَﺑﻴﻌَﺔ، ﻭﺳﺄﻟﺖ ﻳﺤﻴﻰ ﺑﻦ ﺳﻌﻴﺪ، ﻓﺄَﻣَﺮﺍﻧﻲ ﺑﺬﻟﻚ، ﻓﻘﻠﺖ ﻟﻪ : ﻳﺎ ﺃﺑﺎ ﻋَﺒْﺪ ﺍﻟﻠﻪ : ﻟﻮ ﻧَﻬَﻮْﻙ؟ ﻗﺎﻝ : ﻛﻨﺖ ﺃﻧْﺘَﻬﻲ؛ ﻻ ﻳَﻨﺒَﻐﻲ ﻟﺮَﺟُﻞ ﺃﻥ ﻳﺮﻯ ﻧَﻔﺴَﻪ ﺃﻫﻼ ﻟِﺸَﻲﺀ، ﺣﺘﻰ ﻳَﺴﺄَﻝ ﻣﻦ ﻫﻮ ﺃﻋْﻠَﻢ ﻣﻨﻪ.

“আমি ফাত‌ওয়ার জবাব দিইনি, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার চেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে আমি জিজ্ঞেস করেছি যে, তিনি আমাকে এর উপযুক্ত মনে করেন কিনা। আমি রাবী‘আহকে জিজ্ঞেস করেছি, আমি ইয়াহইয়া বিন সা‘ঈদকে জিজ্ঞেস করেছি। তাঁরা আমাকে এর নির্দেশ দিয়েছেন।” বর্ণনাকারী বলেন, আমি তাঁকে (ইমাম মালিককে) বললাম, “হে আবূ ‘আব্দুল্লাহ, তাঁরা যদি আপনাকে নিষেধ করতেন?” তিনি বললেন, “তাহলে আমি বিরত থাকতাম। কোনো ব্যক্তির উচিত নয় নিজেকে কোনো বিষয়ের উপযুক্ত মনে করা, যতক্ষণ না সে (সংশ্লিষ্ট বিষয়ে) তার চেয়ে বেশি জানা ব্যক্তিকে (নিজের ব্যাপারে) জিজ্ঞেস করে।” [ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ), সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৬২; মুআসসাসাতুর রিসালাহ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২২ হি./২০০১ খ্রি.]

ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) আর‌ও বলেন, ﻣَﺎ ﺃَﻓْﺘَﻴْﺖُ ﺣَﺘَّﻰ ﺷَﻬِﺪَ ﻟِﻲ ﺳَﺒْﻌُﻮﻥَ ﺃَﻧِّﻲ ﺃَﻫْﻞٌ ﻟِﺬَﻟِﻚَ “আমি ততক্ষণ পর্যন্ত ফাতওয়া দিইনি, যতক্ষণ না সত্তরজন (‘আলিম) আমার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, আমি এ কাজের উপযুক্ত।” [আবূ নু‘আইম আল-আসবাহানী (রাহিমাহুল্লাহ), হিলইয়াতুল আউলিয়া, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৩১৬; আসার নং: ৮৯৭০]

·
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন,

الناس في حقائق الإيمان متفاضلون تفاضلا عظيما، فأهل الطبقة العليا يعلمون حال أهل السفلى من غير عكس، كما أن أهل الجنة في الجنة ينزل الأعلى إلى الأسفل، ولا يصعد الأسفل إلى الأعلى، والعالم يعرف الجاهل؛ لأنه كان جاهلا والجاهل لا يعرف العالم لأنه لم يكن عالماً.

“ইমানের প্রকৃতত্বের ক্ষেত্রে মানুষ বিশাল (মর্যাদাগত) পার্থক্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। সর্বোচ্চ স্তরের অধিবাসীরা কোনোরূপ বৈপরীত্য ছাড়াই নিচের স্তরের অধিবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে জানে। যেমনভাবে জান্নাতে জান্নাতবাসীদের মধ্যে উঁচু স্তরের অধিবাসী নিচু স্তরের অধিবাসীর নিকট নামতে পারবে, কিন্তু নিচু স্তরের অধিবাসী উঁচু স্তরের অধিবাসীর নিকট উঠতে পারবে না। ‘আলিম জাহিলকে চিনতে পারেন, কেননা তিনি একসময় জাহিল ছিলেন। কিন্তু জাহিল ‘আলিমকে চিনতে পারে না, কারণ সে কখনো ‘আলিম ছিল না।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ২৩৫; বাদশাহ ফাহাদ প্রিন্টিং প্রেস, মাদীনাহ ছাপা; ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি. (বাদশাহ ফাহাদের রাজকীয় ফরমানে মুদ্রিত)]

ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৪৮ হি.] বলেছেন, ﺍﻟﺠﺎﻫﻞ ﻻ ﻳﻌﻠﻢ ﺭﺗﺒﺔ ﻧﻔﺴﻪ، ﻓﻜﻴﻒ ﻳﻌﺮﻑ ﺭﺗﺒﺔ ﻏﻴﺮﻩ “জাহিল ব্যক্তি নিজের অবস্থান সম্পর্কেই অবগত নয়, সে কীভাবে অন্যের অবস্থান সম্পর্কে জানবে?!” [ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ), সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা, খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৩২১; মুআসসাসাতুর রিসালাহ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২২ হি./২০০১ খ্রি.]

·
উপসংহার:

পরিশেষে বলছি, আমাদের জন্য প্রকৃত ‘আলিম চেনা অতীব জরুরি কাজ। কারণ আমাদেরকে দ্বীন বুঝতে হলে তাঁদের শরণাপন্ন হতে হয়, তাঁদেরকে দ্বীনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে হয়। আর যাকে তাকে ‘আলিম গণ্য করে তাদের নিকট থেকে ‘ইলম গ্রহণ করলে ধ্বংস অনিবার্য। মহান আল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি সত্য পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মু’মিনদের (অর্থাৎ, সালাফদের) পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে পথেই ফিরাব যে পথে সে ফিরে যায় এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব। আর কতই না মন্দ সে আবাসস্থল!” [সূরাহ নিসা: ১১৫]

আল্লাহ আমাদেরকে প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য ‘আলিম চেনার এবং তাঁদের কাছ থেকে ‘ইলম গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল ‘আলামীন।

·
অনুবাদ ও সংকলনে: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা
পরিবেশনায়: www.facebook.com/SunniSalafiAthari

দাওয়াতি কাজ সকল মুসলিমের জন্য ফরজ এবং সাধারণ মানুষদের দাওয়াতি কাজের কতিপয় পদ্ধতি

  ▬▬▬✪✪✪▬▬▬ প্রশ্ন: সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ কি সবার উপরে ফরজ? যাদের দ্বীনের জ্ঞান নেই যেমন জেনারেল লাইনে পড়া মানুষ কিন্তু দ্বীন জানার...